Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
পা ন্তা ভা তে...

স্টুডিয়ো আলোময় হয়ে উঠল

আমস্টারডাম থেকে আমরা ফিরলাম বম্বে আর পণ্ডিতজি চলে গেলেন নিউ ইয়র্ক। বললেন, ‘তোমাদের অসুবিধে হবে না। সেপ্টেম্বরেই গান রেকর্ডিং করতে পারবে।’ সেই ভরসায় বুক বেঁধে আমরা ফের কাজে নেমে পড়লাম। কিন্তু মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরতেই থাকল, লতাদিদি গাইবে না, আশাজি গাইবে না, তা হলে মীরার গলায় পণ্ডিতজির সুরে মণিমাণিক্য ছড়াবে কে? সমাধান রবিদাদাই দিলেন। বললেন, ‘যদি বাণী জয়রাম গানগুলো গায় তোমার আপত্তি আছে?’

গুলজার
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

আমস্টারডাম থেকে আমরা ফিরলাম বম্বে আর পণ্ডিতজি চলে গেলেন নিউ ইয়র্ক। বললেন, ‘তোমাদের অসুবিধে হবে না। সেপ্টেম্বরেই গান রেকর্ডিং করতে পারবে।’ সেই ভরসায় বুক বেঁধে আমরা ফের কাজে নেমে পড়লাম।

কিন্তু মাথার মধ্যে একটা কথা ঘুরতেই থাকল, লতাদিদি গাইবে না, আশাজি গাইবে না, তা হলে মীরার গলায় পণ্ডিতজির সুরে মণিমাণিক্য ছড়াবে কে? সমাধান রবিদাদাই দিলেন। বললেন, ‘যদি বাণী জয়রাম গানগুলো গায় তোমার আপত্তি আছে?’ আমি তো সবে হাতে চাঁদ পেয়েছি, অসুবিধে কী? বললাম, ‘মোটেই নয়। আর ওর প্রথম গাওয়া হিন্দি গান আমারই তো লেখা। গুড্ডি সিনেমার— বোলে রে পাপিহারা। কী অসামান্য গেয়েছিল।’

রবিদাদা বললেন, ‘হ্যাঁ, আসলে আমার এক জন ট্রেন্ড ক্লাসিকাল গাইয়ে দরকার। কারণ মীরার ভজনের নতুন আঙ্গিকে ক্লাসিকাল সুর আর তার মোহ ফুটিয়ে তুলতে পারবে এমন একটা চোস্ত গলা চাই, বুঝলে কিনা! বাণী মনে হয় পারবে।’

এ বার ছোট বাচ্চার মতো উত্তেজিত হয়ে পড়লাম আমি। কী যেন একটা হতে চলেছে। আমার মধ্যে মীরার মোহ তখন উথালপাথাল করছে। পণ্ডিতজি সেপ্টেম্বরে এলেন। বাকি গান তৈরি তত দিনে। রেকর্ডিং শুরু হল। সুর তার মায়াজাল বিস্তারে ভারী মগ্ন হয়ে পড়ল। আমাদের শিফ্ট থাকত সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা। প্রথম দু-তিন দিন যেন স্বপ্নের মতো বাস্তব তৈরি হল। গান রেকর্ডিং হচ্ছে, তার মূর্ছনায় আমরা আবিষ্ট।

কিন্তু তিন-চার দিনের মাথায় লক্ষ করলাম, পণ্ডিতজি সব কিছুই করছেন, গান হচ্ছে, রেকর্ডিং হচ্ছে, রিহার্সাল হচ্ছে, ভুল ধরা হচ্ছে, ফের গাওয়া হচ্ছে— সব নিখুঁত, কিন্তু তিনি যেন কোথাও বিষাদগ্রস্ত, কোথায় যেন ছিন্ন। চার দিনের দিন রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর বললেন, ‘আচ্ছা, আমরা কি কাল থেকে দুপুর দুটো নাগাদ রেকর্ডিং রাখতে পারি?’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ কেন, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি। ভেবেছি ওঁর তেমন কোনও প্রয়োজন আছে, যার জন্য উনি এটা বলছেন।

পরের দিন ঠিক দুটোয় স্টুডিয়োয় ঢুকলেন রবিদাদা, এক রাশ হাসি, প্রচুর ফুর্তি আর সাংঘাতিক হইচই নিয়ে। গোটা স্টুডিয়ো যেন আলোময় হয়ে উঠল। কিছু পরে আমায় ডেকে বললেন, ‘আসলে কী হয়েছিল জানো? গত চার দিন ধরে আমি সেতারে হাত দিইনি। রেওয়াজ না করলে আমার মনে হয় আমার নাড়ি থেকে কী যেন ছিঁড়ে গিয়েছে। আমি অসম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছি। আজ ভোর চারটে থেকে বারোটা টানা বাজিয়ে সেই ঘাটতি কিছুটা মেটালাম। মনে হচ্ছিল অনেক দিন খাইনি। অভুক্ত ছিলাম। এখন আমি বেশ চাঙ্গা। চলো, গিরধর গোপালকে গিয়ে এ বার জাপটে ধরি।’

আমি স্তব্ধবাক। সাধনা যে আসলে প্রায় শারীরিক একটা ব্যাপার, সে দিন বুঝেছিলাম। ডিসিপ্লিন, ভোরে ওঠা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ— এগুলো সাধনার উপাদান, কিন্তু সাধনা সার্থক স্তরে পৌঁছয় তখনই, যখন সাধনায় না বসলে শারীরিক কষ্ট হয়। আমরা কেউ কেউ নিজের সম্পর্কে ‘সাধনা করছি’ কথাটা যদি বা সাহস করে উচ্চারণ করে ফেলি, এই সব মানুষ ও তাঁদের আত্মোৎসর্গ চোখের সামনে দেখলে, মনে মনে জিভ কেটে কূল পাই না। এ সত্যিই উপলব্ধির বস্তু, বাক্যের কারিকুরি দিয়ে বোঝানোর নয়।

রেকর্ডিং শেষ হল, রেকর্ড বেরোল, আমার স্বপ্নের সাধনা, ‘মীরা’ সিনেমাও এক দিন তৈরি হল। এর পর পণ্ডিতজির সঙ্গে যে খুব নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তা নয়। তবে দেখা হত মাঝে মাঝে, যাকে বলে অকেশনালি। এক বার এ রকমই একটা দেখা হয়েছিল ব্যাঙ্গালোরে। তখন মেয়ে অনুষ্কা ছোট। ওঁর স্ত্রী সুকন্যার সঙ্গেও আলাপ হল, সেই প্রথম।

তবে একটা অদ্ভুত স্মৃতি, অস্বস্তিকর কিংবা মজাদার, যা-ই বলি না কেন, সেই সাক্ষাৎকে স্মরণীয় করে রেখেছে। বেশ গল্পগুজব আড্ডার পর, সুকন্যা আমায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমায় অনেকটা রাখীজির মতো দেখতে না?’ আমি থতমত। এ প্রশ্নের ঠিক কী জবাব হয়, তা আমার কল্পনারও বাইরে।

শব্দ, ভাষা আর বাক্য নিয়ে যতই লোফালুফি করি, বিরাট স্মার্ট উত্তর দিয়ে ফেলব, দেখলাম সে বিদ্যে আয়ত্ত করতে পারিনি। কেবল ভারী আমতা আমতা করে বললাম, ‘আপনাদের দুজনের সৌন্দর্য তো এক্কেবারে আলাদা। আমার পক্ষে এর বিচার করা খুবই দুরূহ।’

তবে, খেয়াল করলাম, পণ্ডিতজির ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি মিলিয়ে গেল। সেটাকে আর ডিকোড করার চেষ্টা করিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE