Advertisement
E-Paper

তুতান ও মিল্টি

শেষ রাতে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তুতানের। ক্লাস ফাইভের তুতানের ভাল নাম দেবল। মনে হয় বারান্দার দিক থেকে আসছে আওয়াজটা। তুতানের বাথরুমে যাওয়ার দরকার ছিল। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকে টর্চের আলো ফেলে সে। না, কেউ নেই! পর দিন আবার ওই খুটখাট। কে যেন বারান্দা থেকে খাবার ঘরে যাওয়ার দরজার কড়া নাড়ছে। আজ টর্চ জ্বালার দরকার হয় না।

শৈবাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ রাতে খুটখাট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তুতানের। ক্লাস ফাইভের তুতানের ভাল নাম দেবল। মনে হয় বারান্দার দিক থেকে আসছে আওয়াজটা। তুতানের বাথরুমে যাওয়ার দরকার ছিল। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকে টর্চের আলো ফেলে সে। না, কেউ নেই!
পর দিন আবার ওই খুটখাট। কে যেন বারান্দা থেকে খাবার ঘরে যাওয়ার দরজার কড়া নাড়ছে। আজ টর্চ জ্বালার দরকার হয় না। পুব দিক ফর্সা হয়ে এসেছে। জানলার দিকে তাকিয়ে তুতান আবিষ্কার করে আগন্তুককে। বেড়াল নয়, বেড়ালছানা বলাই ঠিক হবে। দরজা বন্ধ পেয়ে শোবার ঘরের জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। তুতান ‘যাঃ’ বলে হাত তুলতেই সে জানলা থেকে নেমে আসে।
তুতান দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট্ট বেড়ালটা কেমন করে পালায় দেখার জন্য। অত উঁচু দোতলা থেকে বাগানে লাফ মারবে নাকি ও! না, তুতান দেখে বারান্দার রেলিংয়ে উঠে ও নিমগাছের ডাল বেয়ে অনেকটা নীচে নেমে তার পর লাফ দিয়ে পড়ে মাটিতে।
সকালে ঠাম্মাকে এই ঘটনা বলতে তিনি বলেন, ‘আহা রে, সব বাড়ির চার ধরে এখন উঁচু পাঁচিল। কোনওটা লোহার, কোনওটা ইটের। কুকুর বেড়ালদের বাড়িতে ঢোকা বন্ধ। অথচ, ওদের তো খিদে পায়, কিছু খাবার জোগাড় করার জন্যেই ঘোরে ওরা এ-বাড়ি ও-বাড়ি।

ওই নিমগাছটা বেয়ে ও দোতলায় উঠেছিল জানো তো ঠাম্মা, দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে তুতান।

এ কথা বলতেই ঠাম্মা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নিমগাছটার দিকে। সরু একচিলতে জমির ওপর পাশাপাশি মোটে তিনটি গাছ— নিম, জবা আর শিউলি। তার মধ্যে নিমগাছটার বাড়বাড়ন্ত সবার চেয়ে বেশি।

এই গাছটার সঙ্গে একটা গল্প জড়িয়ে আছে, ঠাম্মার কাছে শুনেছে তুতান। এই গাছটি তুতানের ঠাকুর্দার নিজের হাতে পোঁতা। অন্য গাছগুলি পরে হয়েছে। তুতানের ঠাকুর্দা যাঁকে সে ‘দাদুভাই’ বলে ডাকত, তাঁর জীবনের এক দুঃখ— বাড়ি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। নিমগাছটা পুঁতেছিলেন জমি কেনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। পরে যখন বাড়ির ভিত খোঁড়া হচ্ছে, তখনই হঠাৎ এক দিন চলে গিয়েছিলেন সবাইকে ছেড়ে।

‘জীবজন্তুর ওপর খুব মায়া ছিল ওঁর’, ছলছল চোখে বলেন ঠাম্মা, ‘ইচ্ছে ছিল কুকুর, বেড়াল পোষার— চাইতেন বাগানের গাছগুলোয় পাখিরা এসে বসুক। বলতেন, পশুপাখিরা মানুষের খুব বড় বন্ধু। আমরা তাদের ‘দূর ছাই’ করি, কিন্তু তাদের কাছে টানলে আমাদেরই মঙ্গল। আমাকে এক জন ডাক্তার বলেছিলেন পশুপাখি পুষলে মানুষের মন ভাল থাকে, মন ভাল থাকলে শরীরও থাকে ফিট।’

কিন্তু সে কথা কে বোঝে। এখন গ্রিন পার্কের সব বাড়ির চার ধারে উঁচু পাঁচিল। কোনও কোনও বাড়িতে দারোয়ান থাকে দিনেরাতে, তারা উটকো লোক দেখলে তেড়ে যায় লাঠি উঁচিয়ে। তাড়া খেয়ে পালায় বুড়ো ভিখারি আর রাস্তার কুকুর। ওই যে বেড়ালছানাটা সে দিন জানলার ওপর দেখেছিল তুতান, ধরা যাক তার নাম মিল্টি। মা টুনি, বাবা জগাই। ও একটু বড় হতেই টুনি, জগাইরা কোথায় চলে গিয়েছে মিল্টি তা জানেই না। তাই এখন নিজেই খাবারের খোঁজে ঘোরে এ-দিক সে-দিক। কোথাও একটা মাছের কাঁটা পায়, কোথাও আবার কারও লাঠির তাড়া।

‘বড় দয়ার শরীর ছিল তোর দাদুভাইয়ের’, তুতানের প্লেটে একটা বাটার টোস্ট দিয়ে বলেন ঠাম্মা, ‘ভাড়া বাড়িতে কুকুর, বেড়াল দু-ই পুষতেন। পরে বাড়িওলার আপত্তিতে তাড়াতে হয় তাদের। ইচ্ছে ছিল নিজে বাড়ি করে সিঁড়ির তলায় ওদের থাকার মতো ভদ্রগোছের একটা জায়গা করে দেবেন। তা আর হল কই। বাড়ির কাজ শুরু হল আর উনিও চোখ বুজলেন’, আঁচল তুলে নিজের চোখ মোছেন সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধা।

কিন্তু নিমগাছটা রয়ে গিয়েছে। এখন এই রাস্তার মধ্যে এত বড় গাছ আর নেই। সে দিন বটানির ছাত্রীরা এসেছিল ওটার ছবি তুলতে। এই রাস্তায় কেউ কোনও বাড়ি বা দোকান বোঝাতে চাইলে বলে, ‘ওই যে নিমগাছওলা বাড়িটা দেখছেন, ওটার তিনটে বাড়ি পরে...’। কত পাতা গাছটায়! কত পাখি যে ওর ডালে এসে বসে তার হিসেব নেই। ওটা তুতানের ‘দাদুভাই’য়ের রেখে যাওয়া একটা চিহ্ন। গাছটা যেন পাতার আওয়াজ তুলে বলতে চায়, ‘এক দিন এক জন ছিল, সে এখন নেই, কিন্তু আমি আছি। যদি কারও কোনও কাজে লাগতে পারি, তা হলে খুশি হব আমি খুব।’

পর দিন আবার সেই খুটখাট। মিল্টি বোধ হয়— ‘ম্যাঁ’, সে-ই। ও ভেবেছে দরজা ঠেললেই খুলে যাবে, কিন্তু ওতে যে শেকল তোলা, তা জানা নেই ওর। তুতান বিছানা ছে়ড়ে উঠে দরজা খুলে দেয়। মিল্টি ভয়ে ভয়ে তাকায় তুতানের দিকে, ভেতরে ঢোকার আগে যেন জেনে নিতে চায়— মানুষটা ভাল, না অন্য রকম!

তুতান ফ্রিজের দরজা খোলে। সে জানত রাতে খাওয়ার সময় বাবা বলেছিল, ‘অতখানি মাংস খেলাম, মাছটা আজ থাক।’ রুইমাছের একটা বড় পেটি, বাবা বাটিটা সরিয়ে দিতে মা সেটা ফ্রিজে তুলে রেখেছিল। তুতান এখন সে বাটিটা বার করে তার ওপর একমুঠো ভাত ছড়িয়ে দিয়ে মিল্টির সামনে রাখে। মিল্টির বুঝতে বাকি থাকে না, এই ভাবে পাত পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা তারই জন্যে। বাটিতে মুখ দিয়ে মনের আনন্দে খায় সে মাছভাত। তার পর তাকায় তুতানের মুখের দিকে। কী বলতে চায় কে জানে! পরে চলে যায় নিমগাছটার দিকে। বারান্দার রেলিংয়ে উঠে পৌঁছয় গাছের ডালে। ডাল বেয়ে খানিকটা নীচে নেমে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার আগে ফের এক বার তুতানের মুখের দিকে তাকিয়ে ডাকে ‘মিঁউ’, তার পরই রাস্তায়।

ঠিক তখনই হাওয়ার দোলা লেগে নিমগাছের ডালগুলো নড়েচড়ে ওঠে, অজস্র হালকা সবুজ পাতাগুলো যেন বাতাসের সুড়সুড়ি পেয়ে খিলখিল করে হাসে, তাদের সেই হাসির মধ্যেই এক জন মানুষের গলা শুনতে পায় তুতান— ‘আমি খুব খুশি হয়েছি দাদুভাই’, বয়স্ক মানুষের স্নেহভরা নরম গলা। ‘ওর তো তোমায় কিছু বলার উপায় নেই, আমি বলছি তোমায়, খুব ভাল কাজ করেছ তুমি...’।

তুতানের গায়ে যেন কাঁটা দেয়।
সে এত অবাক হয় যে, ছোট করে একটা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতেও কথা সরে না তার মুখে।

saibal chakraborty story cat bathroom
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy