Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

A fear of pain [shy]মা-বাবা বুড়ো হয়ে গেল!!! বেশ কয়েক বছর আগে এক দুপুরবেলা এই কথাটা ধড়াস করে এসে বুকে বিঁধল। তেমন কোনও ইমিডিয়েট কারণ ছিল না বোঝার। অফিসে বসে কম্পিউটারে বেশ কাজ করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল, মনে হল গোটা কম্পিউটার স্ক্রিনটা জুড়ে যেন লেখা হয়ে গেল— আমার মা এবং বাবা, দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছে। যেন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

মা-বাবা বুড়ো হয়ে গেল!!! বেশ কয়েক বছর আগে এক দুপুরবেলা এই কথাটা ধড়াস করে এসে বুকে বিঁধল। তেমন কোনও ইমিডিয়েট কারণ ছিল না বোঝার। অফিসে বসে কম্পিউটারে বেশ কাজ করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কী যে হল, মনে হল গোটা কম্পিউটার স্ক্রিনটা জুড়ে যেন লেখা হয়ে গেল— আমার মা এবং বাবা, দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছে। যেন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা।

অথচ এরা দুজন আমাদের চোখের সামনেই বয়স বাড়াচ্ছিল। ছোট-বড় অসুখ নিয়ে চিন্তায় ফেলছিল। আমরা হম্বিতম্বিও করছিলাম, ‘বয়স হয়ে গেছে, খেয়াল রাখো না। এখন কি আর অত খাটনি পোষায়?’ মায়ের যেন কোথাও ভুল করার উপায় নেই। মা যেন ঠিক তেমন তাড়াতাড়িই চিংড়ি-ভাপে নামিয়ে দিতে পারবে। বাবাকে এখনও নিউ মার্কেটে ছেড়ে দিলে ঠিক তাক করে বাঁয়ের একটা গলি পার করেই পারফিউমের দোকানটার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। ইতিহাসের কোনও নাম নিয়ে বাজি ধরলে হারবই। মা কাল অফিস যাওয়ার আগে আমার বন্ধ ঘড়িটা সারিয়ে তুলে দেবে আমার হাতে।

আমি কি জানি না, আমার মায়ের দু-দুটো বড় অসুখ করেছে? আমি কি জানি না, আমার বাবার সব সময় হাত কাঁপে? কিন্তু আমি জানতাম না, ওরা জেনে গেছে যে ওরা এখন নির্ভরশীল। সব ব্যাপারে। ওরা বুঝে গেছে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে কারও না কারও সাহায্য নিয়ে চলতে হবে। যে বাবা বন‌্ধ অবধি পরোয়া না করে হেঁটে অফিস চলে গিয়েছে, সেই বাবা এখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে থরথর কাঁপে। কিন্তু-কিন্তু করে লাঠিটা চেয়ে নেয়। মুখে একটা লজ্জা আর কুণ্ঠা ফুটে ওঠে। অন্যকে বিব্রত করার লজ্জা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার লজ্জা।

আমার মা কোনও দিন শাড়ি ছাড়া কিছু পরেনি। আজ বাধ্য হয়ে নাইটি (যে পোশাকটা মা অন্তর থেকে ঘেন্না করত। আমি আর দিদি কম বকুনি খাইনি এই রাত-পোশাককে আপন করার জন্য) পরে। আর কেউ ঘরে ঢুকলেই কেমন থতমত খেয়ে নিজেকে কোথায় লুকিয়ে রাখবে ভাবে। কখনও পায়ের দিকটা টেনে নেয়, কখনও গলার কাছটা টেনে নেয়। নাইটি পরা প্রতিটি এনকাউন্টার মায়ের কাছে অসহ লজ্জার। বুঝতে পারি, মায়ের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। নিজেকে মেনে নিতে। মাড় দেওয়া পাট-পাট শাড়ি পরা যার অভ্যেস, সে কী করে এত বয়সে নাইটি পরে দারুণ স্মার্ট হবে?

আমরা কত বলি, কত বোঝাই— কী করবে বলো, তোমরা তো আর ইচ্ছে করে এমনটা করছ না? সম্ভবত এই কথাটাই ওদের আরও লজ্জায় ফেলে দেয়। কেন ওরা ইচ্ছে করলেই নিজেদের ওপর কন্ট্রোল রাখতে পারছে না? এই তো কিছু দিন আগেও নিজেরটা নিজেরাই বেশ গুছিয়ে করে নিতে পারত। কী এমন হল যে এই নিদারুণ লজ্জার ফাঁদে নিয়ত পড়ে গেল। সব কিছুতেই ফ্যালফ্যাল করে অন্যের মুখের দিকে চাইতে হয়?

আমি বুঝি, ওদের শরীরের কলকবজা খারাপ হয়েছে, মাথাটা তো খারাপ হয়নি। আর আমাদের সবার মতোই ওদেরও মনের বয়স যে খুব বেড়ে গিয়েছে, তা তো নয়। বাবা হয়তো এখনও পঁয়তাল্লিশ ভেবে নিজের মতো হাঁটাচলা করতে গিয়ে ধুপধাপ পড়ে যায়। আর মা নিশ্চয়ই বিশ্বাসই করতে পারে না, অন্যের ওপর ভরসা করে জীবন কাটাবে। আর তাই ওদের কষ্টের চেয়ে লজ্জা অনেক বেশি। বয়সের সঙ্গে লজ্জা পাওয়া, কষ্ট পাওয়া, আনন্দ পাওয়া যে কমে আসবে, এমন কোনও নিয়ম ব্রেন করেনি। আর তাই ওদের লজ্জাটা খুব জেনুইন, তীব্র, খুব নুন-ছাল ওঠা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Robibashoriya Sanchari Mukherjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE