ওয়ালিসকে অভিবাদন জানাচ্ছেন হিটলার, দেখছেন এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড নাৎসিপন্থী, এই অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে
১৯৩৬ সালটা ব্রিটেনের ইতিহাসে খুব অন্য রকম একটা বছর। এই বছরে ব্রিটিশ সিংহাসন তিন জন রাজাকে পেয়েছিল। রাজা পঞ্চম জর্জ মারা গেলে ইংল্যান্ডের রাজা হয়েছিলেন তাঁর বড় ছেলে অষ্টম এডওয়ার্ড। মাত্র দশ মাসের মাথায় দেশ মুখোমুখি হল এক অদ্ভুত সাংবিধানিক সঙ্কটের। নভেম্বর মাসের এক দিন বাকিংহাম প্যালেসে প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বল্ডউইনকে ডেকে এডওয়ার্ড বলেন, তিনি ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করতে চান, শুধু আর্নেস্টের সঙ্গে ওঁর বিবাহবিচ্ছেদের অপেক্ষা করছেন। স্ট্যানলি তৎক্ষণাৎ জানালেন, এই বিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি পাবে না। ইংল্যান্ডের রাজা শুধু দেশের প্রধান নন, গির্জারও প্রধান। আর সেই সুবাদে তিনি এমন কোনও নারীকে বিয়ে করতে পারেন না যাঁর দু’বার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, এমনকী যাঁর প্রাক্তন স্বামীরা জীবিত। স্ট্যানলি এডওয়ার্ডকে সতর্ক করেছিলেন, ওয়ালিসকে বিয়ে করা নিয়ে এডওয়ার্ড বেশি বাড়াবাড়ি করলে স্ট্যানলি বাধ্য হবেন পদত্যাগ করতে, তাতে আর একটা নির্বাচন করতে হবে দেশে। অবশ্য এডওয়ার্ডের সময় ব্রিটেন ক্রমশ সাংবিধানিক সমস্যায় নিমজ্জিত হচ্ছিল। ‘দ্য উইন্ডসর ফাইল’ নামের এক প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ পল সুইট দাবি করেছেন, ১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জ মারা যাওয়ার পর থেকেই সরকারি নিয়মে নাক গলাতে শুরু করেন এডওয়ার্ড। সাংবিধানিক প্রোটোকল লঙ্ঘন করে তিনি নিজে জার্মান রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলেন।
ওয়ালিসকে বিয়ে করলে পরিণতি কী হতে পারে জেনেও এডওয়ার্ড মনস্থির করেছিলেন, তিনি সিংহাসন ছাড়বেন তবু ওয়ালিসকে ছাড়বেন না। এডওয়ার্ডের এই সিদ্ধান্ত জানার পর ওয়ালিস তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি একটা মাথামোটা!’’ এডওয়ার্ড কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন।
১১ ডিসেম্বর ১৯৩৬। রাতে এডওয়ার্ড সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল সেই বার্তা। ‘‘রাজা হিসেবে আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব, যদি না আমি সেই নারীর সমর্থন ও সাহায্য পাই, যাঁকে আমি ভালবেসেছি।’’ গোটা দেশ চমকে উঠেছিল এডওয়ার্ডের এই ঘোষণায়। বাবা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি রাজা হয়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। তার পর এক বছরও কাটল না, ১১ ডিসেম্বর সিংহাসন ত্যাগের ঘোষণা। ব্রিটিশ রাজপরিবারে তিনিই সবচেয়ে কম দিন, মাত্র ৩২৬ দিনের রাজা। ছোট ভাই, ডিউক অব ইর্য়ক আলবার্টের উপস্থিতিতে এডওয়ার্ড তাঁর পদত্যাগপত্রে সই করেছিলেন। রাজা হলেন আলবার্ট— অভিষেকের পর তাঁর নাম হয় ষষ্ঠ জর্জ। আর এডওয়ার্ড রাজা থেকে হয়ে যান ‘ডিউক অব উইন্ডসর’।
পদত্যাগের পরের দিনই ইংল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রিয়ায় চলে যান এডওয়ার্ড। ১৯৩৭ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের এক দুর্গে এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের কোনও সদস্যকে দেখা যায়নি। রাজা ষষ্ঠ জর্জের কড়া নির্দেশ ছিল, এডওয়ার্ডের বিয়েতে যেন রাজপরিবারের কেউ উপস্থিত না থাকেন। সেই আদেশ অমান্য করার সাহস কারও ছিল না। তা ছাড়া ওয়ালিসকে কেউ পছন্দও করতেন না। ওয়ালিসের চেহারায় কোমলতার অভাব, বরং প্রকট কাঠিন্যই। তাঁর মার্কিন উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধা হত ব্রিটিশদের। উপরন্তু ওয়ালিসের উপর বেজায় চটে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি, রানি মেরি। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মেয়ে এডওয়ার্ডের উপর জাদু করেছে, তাঁকে সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে সরিয়ে এনেছে। ওয়ালিস আবার একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না আলবার্টের স্ত্রী, ডাচেস অব ইয়র্ককে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় ওয়ালিসের আত্মচরিত ‘দ্য হার্ট হ্যাজ ইটস রিজনস’। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ডাচেস অব ইয়র্ক তাঁকে ঘৃণা করতেন, কারণ আলবার্ট ও তাঁর নিশ্চিন্ত জীবন ওয়ালিসের জন্যই তছনছ হয়ে গিয়েছিল বলেই ডাচেসের বিশ্বাস ছিল। আলবার্টেরও নাকি রাজা হওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না, ওয়ালিসের জন্যই তাঁকে বাধ্য হয়ে রাজা হতে হয়েছিল!
এখন জানা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ওয়ালিসের সঙ্গে প্রেমের জন্যই যে এডওয়ার্ডকে সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল, ব্যাপার আদৌ তা নয়। এর পিছনে আর একটি কারণ ছিল। এডওয়ার্ড এবং ওয়ালিস নাকি প্রবল নাৎসিপন্থী ছিলেন! ব্রিটিশ সরকার সে জন্যই প্রশাসনের পথ থেকে এডওয়ার্ড নামের কাঁটাটিকে সরাতে চেয়েছিল। এও শোনা যায়, এডওয়ার্ডের সঙ্গে বিয়ের আগে নাৎসি বিদেশমন্ত্রী জোয়াখিম ভন রিবেনট্রপের প্রেমিকা ছিলেন ওয়ালিস! কিন্তু এটা সত্যি কথা, বিয়ের চার মাস পরে এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন জার্মানিতে তাঁর হলিডে হোমে। ফ্রান্সেস ডোনাল্ডসন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ডিউক হিটলারকে পুরোদস্তুর নাৎসি স্যালুট ঠুকেছিলেন!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন কূটনীতিবিদরা জার্মানির মারবুর্গ কাসল থেকে প্রায় ৪০০ টন নাৎসি নথিপত্র উদ্ধার করেন। নথিপত্রের ভিড়ে পাওয়া যায় ‘উইন্ডসর ফাইলস’ নামের এক তাড়া কাগজ। চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, অন্যান্য কাগজপত্র মিলিয়ে প্রায় ৬০টি নথি মিলেছে, যুদ্ধের সময় ডিউকের কাছের লোকেদের লেখা। এমনকী তার মধ্যে কয়েক জন জার্মান এজেন্টও! এই সব কাগজের তথ্য থেকে জার্মানদের করা একটা পরিকল্পনার কথাও জানা যায়। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন উইলি’। জার্মানরা চেয়েছিল ষষ্ঠ জর্জকে সিংহাসনচ্যুত করে এডওয়ার্ডকে আবার রাজসিংহাসন ফিরিয়ে দেওয়া। তাতে ব্রিটেনের উপর জার্মানি ছড়ি ঘোরাতে পারবে। রাজা ষষ্ঠ জর্জের চেয়ে হিটলার-অনুরাগী এডওয়ার্ড নাৎসিদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই প্রিয় ছিলেন। জার্মান অফিসাররা এডওয়ার্ডকে এও বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ষষ্ঠ জর্জ তাঁকে খুন করার ফন্দি আঁটছেন!
টেলিগ্রামগুলো থেকে জানা যায়, ডিউক এডওয়ার্ডকে আবার রাজা করার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস দুজনেই। একটা টেলিগ্রামে লেখা, ওয়ালিস এ নিয়ে খুবই ভাবিত। আর একটা টেলিগ্রামের ইঙ্গিত, ওয়ালিস রানি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন: ‘জার্মানরা উইন্ডসরের ডিউক ও ডাচেসের সাহায্য কামনা করছে, ডাচেস যে কোনও মূল্যে রানি হওয়ার জন্য মরিয়া।’ অনেকগুলো টেলিগ্রামে বলা হয়েছে এডওয়ার্ডের নানান বিবৃতিও। একটাতে বলা, ‘এডওয়ার্ড নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি সিংহাসনে থাকলে বরং জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানো যেত’, আর একটাতে: ‘জার্মানির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়ার তিনি দৃঢ় সমর্থক।’
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ-এর গবেষক, ‘গো-বিটুইনস ফর হিটলার’ গ্রন্থের লেখক কারিনা আরবাক এই সব নথিপত্র দেখেশুনে জানাচ্ছেন, নাৎসিদের সঙ্গে এডওয়ার্ডের মজবুত আঁতাত ছিল। ২৫ জুন ১৯৪০ তারিখে স্প্যানিশ কূটনীতিক দন জেভিয়ার বারমেজিলোর সঙ্গে এডওয়ার্ডের কথোপকথনের একটা রিপোর্ট উদ্ধৃত করে তিনি জানাচ্ছেন এডওয়ার্ডের মন্তব্য— ইংল্যান্ডের উপরে বোমা ফেললেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। এই রিপোর্ট নাকি প্রথমে স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে, পরে জার্মানিকে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ১০ জুলাই জার্মানরা ব্রিটেনে প্রথম বোমা ফেলে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, তখন এডওয়ার্ডকে ফ্রান্সে মেজর জেনারেল পদ দেওয়া হয়। তাতে কী, তিনি নাকি পাশাপাশি শত্রুপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন!
১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে হেগ শহরে এক জার্মান মন্ত্রীর লেখা থেকে পাওয়া যায়, তাঁর সঙ্গে এডওয়ার্ডের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে। তাঁর কাছ থেকেই জার্মানরা জানতে পারে, তাঁদের ফ্রান্স আক্রমণের পরিকল্পনার কথা মিত্রশক্তি জেনে গিয়েছে। হিটলার ব্যাপারটা জেনে তাঁর পরিকল্পনা বদলে ফেলেন। ফ্রান্সের পতন ঠেকানো যায়নি।