Advertisement
E-Paper

জন্মদিনের উপহার

কাল থেকে রাতের ঘুম চলে গেছে ঘেঁটুর। পড়াশোনা তো কোন দূরের কথা খেলাতে পর্যন্ত মন লাগছে না তার। রথীনস্যর যখন থেকে কথাটা ঘোষণা করেছেন, তখন থেকে তার অস্বস্তি শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা অন্য কেউ হলে সে পাশ কাটিয়ে ম্যানেজ করে নিত। কিন্তু রথীনস্যরের নিমন্ত্রণ ফেরাবে, এত শক্তি কোথায় তার? এ দিকে কী ভাবে কথাটা মায়ের কাছে বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না! ঘেঁটুরা খুব গরিব।

সীমা জানা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০৩
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

কাল থেকে রাতের ঘুম চলে গেছে ঘেঁটুর। পড়াশোনা তো কোন দূরের কথা খেলাতে পর্যন্ত মন লাগছে না তার। রথীনস্যর যখন থেকে কথাটা ঘোষণা করেছেন, তখন থেকে তার অস্বস্তি শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা অন্য কেউ হলে সে পাশ কাটিয়ে ম্যানেজ করে নিত। কিন্তু রথীনস্যরের নিমন্ত্রণ ফেরাবে, এত শক্তি কোথায় তার? এ দিকে কী ভাবে কথাটা মায়ের কাছে বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছে না! ঘেঁটুরা খুব গরিব। ওর বাবা বাদল একটা দোকানের সামান্য কর্মচারী। কোনওমতে দিন চলে। তার ওপর ক’দিন থেকে অসুস্থ। ওর মা কাল সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখিয়ে এনেছে। এ অবস্থায় বাবা মাকে কথাটা বলা মানেই দুশ্চিন্তায় ফেলা। অথচ না বলেও কোনও উপায় নেই।

ঘেঁটু এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছোট থেকেই ও পড়াশোনায় খুব ভাল। কিন্তু বাড়িতেও ওর পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার বিদ্যে ওর বাপ-মায়ের নেই আবার টিউশন দেওয়ার পয়সাও নেই। প্রাইমারি স্কুল থেকে ও যখন ফাইভে উঠে হাই স্কুলে ভর্তি হল, তখন রথীনস্যর ওর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘তুই কার কাছে অঙ্ক করিস রে?’

‘আজ্ঞে স্যর একা একাই।’

‘কাল থেকে সপ্তাহে তিন দিন করে আমার বাড়ি যাবি। তোর ক্লাসের ছেলেরা যে তিন দিন পড়তে যায়, সে তিন দিন আমি তোকে অঙ্ক করাব।’

সেই থেকে রথীনস্যর বিনে পয়সায় ওকে তিন বছর পড়িয়ে যাচ্ছেন। এই যে স্কুলের সবাই ওকে অঙ্কবিদ বলে, সে তো রথীনস্যরের কৃতিত্ব! প্রতিবারই পাশ করে ঘেঁটু ভাবে স্যরকে একটা না একটা কিছু উপহার দেবে, কিন্তু পয়সার টানাটানিতে সে আর হয়ে ওঠে না। কাল রথীনস্যর কথার ফাঁকে বলে ফেলেছিলেন, ‘জানিস, আগামী পরশু আমার জন্মদিন।’

‘তা হলে কিন্তু আমাদের খাওয়াতে হবে স্যর।’ সমস্বরে ছেলেমেয়েগুলো বলে উঠল। রথীনস্যরও উদার মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন, ‘বেশ সামনের রবিবার তোরা দুপুরে আমার বাড়িতে খাস। নেমন্তন্ন রইল।’ খাওয়ার কথায় সবাই খুব খুশি।

পড়ানোর শেষে স্যরের বাড়ি থেকে বেরোনর সময় বন্ধুরা মিলে স্যরের জন্য গিফ্ট কেনার কথা আলোচনা করছিল। প্রিয়ম বলল, ‘আমরা সবাই মিলে স্যরকে একটা ভাল গিফ্ট দেব।’ বাবলু দলের মাতব্বর গোছের। সে বলল, ‘শোন যে যার বাড়ি থেকে গিফ্ট আনবি। আমি যদি বাবাকে টাকা চাই তা হলে বাবা আমাকে কিছুতেই টাকা দেবে না। বলবে ছোটদের টাকা হাতে নিতে নেই।’ সবাই তাতে রাজি। আর সেই খুশির খবরটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ হয়ে কাল থেকে তার কপালে ঘুরছে! ভেবে কূল পাচ্ছে না।

না না করে বাধ্য মাকে কথা বলে ফেলল ঘেঁটু, ‘জানো মা, পরশু রথীনস্যরের জন্মদিন। আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে।’

‘বাহ, এ তো খুব ভাল কথা। তা এত ভাল কথাটা তুই অমন মুখ শুকনো করে কেন বলছিস?’

‘বন্ধুরা সবাই স্যরের জন্য উপহার নিয়ে যাবে। আমি কি খালি হাতে যাব বলো?’

‘তা কেন? একটা কিছু উপহার নিয়েই যাবি। কাল বাজার থেকে কিনে এনে দেব।’

‘কী আনবে?’

‘দেখি চিন্তা করে, কী আনা যায়!’

‘বাবার শরীর যে খারাপ, মা! এর মধ্যে পয়সা কোথায় পাবে তুমি?’

‘তোকে অত কিছু ভাবতে হবে না? তুই শুধু স্যরের জন্মদিনে কী ভাবে আনন্দ করবি সেটা ভাব।’

পরের দিন স্কুল থেকে দুপুরে ফিরেছে ঘেঁটু। ফিরেই দেখে মায়ের মুখটা হাসি হাসি। ঘেঁটু অবাক হয়ে যায়, ‘তোমাকে আজ খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেন, মা?’

‘তোর স্যরের জন্মদিনের উপহার এনেছি। খেয়ে নে, দেখাব।’

উপহারটা দেখে ঘেঁটুর মুখটা একমুহূর্তে শুকিয়ে চিমসে হয়ে গেল। এমা, মা এটা কি এনেছে? নিজেকে প্রশ্ন করল সে। ঘেঁটুর মা বাজার থেকে একটা টব সহ চারাগাছ এনেছে। ওর মা বুঝতে পেরেছে উপহার ঘেঁটুর পছন্দ হয়নি। কাছে সরে এসে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কী রে, পছন্দ হয়নি তোর?’

‘এটা নিয়ে গেলে সব বন্ধুরা হাসাহাসি করবে মা?’

‘দেখিস এই উপহারটা তোর স্যরের
খুব পছন্দ হবে, অন্য জিনিস তো নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু গাছটা সব সময় তোর স্যরকে ঘিরে রাখবে।’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও টবটা নিয়ে রবিবারের দুপুরে রথীনস্যরের জন্মদিনে গেল ঘেঁটু। স্যরের বাড়ির ছাদে বড় করে প্যান্ডেল হয়েছে। টিউশনের যত ছাত্র সবাই এসেছে। ঘর একদম গমগম করছে। স্যরের মেয়ের আবদারে মাইকসেটও আনানো হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পর গান-বাজনার আসর বসবে। স্যর হেসে হেসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢুকেই ওদের ক্লাসের কয়েকজনকে দেখতে পেল ঘেঁটু। ওরাও ওকে দেখে দৌড়ে এল, ‘দেখি দেখি ঘেঁটু তুই কী উপহার এনেছিস?’ ঘেঁটু তো কাঁচুমাচু! সে টবটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতর লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঘেঁটু কিছুতেই দেখাবে না, বন্ধুরাও ছাড়বে না। ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না ঘেঁটু। জোর করে দেখে ফেলল ওরা। তার পর শুরু হল হাসির ধুম! ঘেঁটুর চোখ দুটো জলে ভরে গেল।

স্যর সুন্দর সাজানো চেয়ারে বসেছেন। এ ব্যবস্থাটা করেছে টেন ইলেভেনের দাদা দিদিরা। সবাই এক এক করে গিয়ে স্যরকে একএকটা গিফ্ট দিয়ে আসছে। এক সময় এল ঘেঁটুর পালা। সে যেন হাঁটতে পারছে না। পা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। কোনও মতে স্যরের কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগের ভেতর থেকে টবটা বার করে রথীনস্যরের দিকে বাড়িয়ে দিল। রথীনস্যর ওটা দেখে কথা হারিয়ে ফেললেন। হাত বাড়াননি উনি। অন্য ছেলেদের অনেকেই তখন শব্দ করে হাসতে শুরু করে দিয়েছে। মিনিটখানেক তো হবেই! অঙ্ক ভুল করলে রথীনস্যর যে ভাবে গর্জন করে ওঠেন, তেমনি গর্জন করে উঠলেন। মুহূর্তেই সব স্তব্ধ! রথীনস্যর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টব সহ ঘেঁটুকে কোলে তুলে নিলেন। তার পর সবাইকে বললেন, ‘তোরা সবাই আমার জন্য উপহার এনেছিস। ঘেঁটু যে উপহার এনেছে তাতে শুধু একা আমি নই, সমাজের সব মানুষের উপকার হবে। যখন সবাই গাছ কেটে শহর বাড়াচ্ছে, তখন ও গাছ উপহার দিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছে। আমার জন্মদিন সার্থক হল, ঘেঁটু।’

সবাই মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। রথীনস্যর বললেন, ‘আয় আজ আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি এ বার থেকে কাউকে কিছু উপহার দিলে গাছই দেব। আর আমাদের এই প্রোজেক্টটার নাম হোক— ‘সবুজের অভিযান’। সবাই একসুরে রথীনস্যরের কথা সমর্থন করে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। মায়ের মুখটা মনে করে চোখ দুটো ভিজে উঠল ঘেঁটুর।

Rabibashariya Sima Jana
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy