Advertisement
০৮ মে ২০২৪

প্রেমতক্তির পরানকথা

যে কাঠের টুকরোয় গাঁজা কুচোনো হয়, তার নাম প্রেমতক্তি। আর ছুরির নাম রতনকাটারি। বাঙালির গাঁজাপ্রেম কি আজকের? অ্যালেন গিন্সবার্গ, বব মার্লেদের ঢের আগে পক্ষীর দল, টেকচাঁদ ঠাকুর, হুতোম। রাষ্ট্রপুঞ্জ এত দিনে বিপজ্জনক মাদকের তালিকা থেকে বাদ দিল গাঁজা ও চরস। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশপাশে লেখা অথর্ব বেদ,  গাঁজাকে স্বীকৃতি দিয়েছে পবিত্র ঘাস হিসেবে। সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত থেকে গাঁজা গাছের উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে। 

মৌতাত: সাধুসন্তদের গঞ্জিকা সেবন কুম্ভমেলার অন্যতম পরিচিত দৃশ্য

মৌতাত: সাধুসন্তদের গঞ্জিকা সেবন কুম্ভমেলার অন্যতম পরিচিত দৃশ্য

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

জোড়াসাঁকোর গলি, সোনাগাছি চত্বর, গ্রে স্ট্রিট, আহিরীটোলার আকাশে দিনদুপুরেই তারা ফুটছে! সঙ্গে রাতচরা হুল্লোড়ের রেশ, বটকেরা। শৌখিন কুঠিওয়ালা সাহেবরা এস্রাজ নিয়ে জলবিহার করতে বসেছেন দূরে। তাঁরা যেন ভিনগ্রহ, উচ্চমন্য। তাঁরা বাগানে যান ব্রাউহ্যাম, ফিটন-এ। তাঁদের মাধ্বী মহোৎসবের বিরাম নেই।

কিন্তু এই রেস্তহীন গুলিখোর গেঁজেলরা আর কী করে! লাঠি হাতে অনেকেই কানা সেজেছে মৌতাতের সম্বল বা পারানির কড়িটুকু জোগাড়ের ধান্দায়। ধূম্রনদী পেরোলেই মিলবে অলকানন্দার সন্ধান! ‘অন্ধকে কিছু দান করো গো বাপ আমার’ — তাদের সেই মেকি করুণ আর্তিকে সঙ্গত দিচ্ছে দু’পাশের বেড়ে চলা খেমটার তালিমের আওয়াজ। সুতানুটির পশ্চিম থেকে আসা বাতাসে ম-ম করছে বেলি-আতরের সঙ্গে গাঁজার ধোঁয়ার গন্ধও।

এই তো উনিশ শতকের কলকেতা! এঁরাই তো সেই ‘আফাঁ তেরিবল’ বাঙালির পূর্বপুরুষ! হাড়কাটা লেন থেকে শাঁখারিটোলা লেন পর্যন্ত যাঁরা মহাস্থবির জাতক হয়ে থেকেছেন। মাথার উপর সূর্য বদলে গিয়েছে চাঁদে, কিন্তু নেশা টসকায়নি। কলকেতাই তো শুধু নয়, রূপসী বাংলার হৃৎকমলেও কি গাঁজার ধূম লাগেনি?

টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ গ্রন্থের শুরুটাই তো মদ নয়, সেই গ্রামীণ গাঁজা বচনে। বলা হচ্ছে, ‘কথিত আছে, কোন ভদ্রলোক এক গ্রামে কিছু দিবস অবস্থিতি করিয়াছিলেন; তথায় দেখিলেন, প্রায় সকল লোক অহোরাত্র অবিশ্রান্ত গাঁজা খাইতেছে। এ ব্যাপার দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এ গ্রামে কত লোক গাঁজা খায়? গাঁজাখোরের মধ্যে একজন উত্তর করিল, আমরা সকলেই গাঁজা খাইয়া থাকি, গ্রামের শালাগ্রাম ঠাকুর ও আমাদিগের টেপিপিসি যাহার ৯৯ বৎসর কেবল তাঁহারাই খারিজ আছেন। কলিকাতা এক্ষণে প্রায় তদ্রুপ।’

তখন শ্রীপক্ষীদের ওড়ার বিরাট আকাশ। গেঁজেলরা গাইতেন পাখির ভাষায়। উড়তেনও, (দুর্ঘটনা কি আর ঘটেনি, তবে নেশার কসম জান!) কয়েক ছিলিমের পর। শিবনাথ শাস্ত্রী হদিস দিয়েছিলেন তিনটি স্বনামধন্য গাঁজাঠেকের— বাগবাজার বটতলা আর বৌবাজার। এক বার মহারাজ গোপীমোহন দেব পক্ষী-দলের রগড় দেখতে চাইলেন। অনেক অনুরোধের পর পাখির দল বললেন, যাব, তবে খাঁচা পাঠাতে হবে। পালকি নামের খাঁচা এল। পাখিরা নিজেদের নাম অনুযায়ী সেজেগুজে বসলেন। রাজার বাড়ি পেট পুরে খেলেন। গাঁজা ক্ষুধাবর্ধক। কিন্তু খাওয়ার পর অনুষ্ঠান দেখানোর আবেদন উড়িয়ে বিচিত্র কলকাকলিতে কর্ণ বিদীর্ণ করে সেই খাঁচায় গিয়ে বসলেন ফের। মানে, এমন খ্যাঁটনের পর শরীর বিশ্রাম চায়!

তবে পাখি উপাধি পাওয়া বড় সহজ ছিল না। ফুসফুসের দম লাগত বইকী! পাখি হতে কেউ আটচালায় এলে প্রথমে তাঁকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হত। পরীক্ষা নিতেন স্বয়ং পক্ষীরাজ। ছিলিমের পর ছিলিম গাঁজা পান করতে হত, এক বারও না কেশে। পক্ষী অনেক থাকলেও পক্ষীরাজ ছিলেন মাত্র দেড়জন। কথিত, যে সব মহাপুরুষ একাসনে বসে একশো আট ছিলিম গাঁজা খেতে পারতেন, তারা একটা ইট পেতেন। এই ইট জমিয়ে যিনি গোটা বাড়ি তুলতে পারতেন, তিনিই পক্ষীরাজ। কলকাতায় দেড়জন পক্ষীরাজের এক জন ছিলেন পটলডাঙার রূপচাঁদ পক্ষী আর বাগবাজারের নিতাই হাফ-পক্ষী। বেচারা বাড়ির চার দেওয়াল বানানোর পরেই মারা যান। ফুল-পক্ষী হয়ে ওঠা তাঁর হয়নি!

রূপচাঁদ পক্ষী ছিলেন পক্ষীকুলের সেরা। এক দিকে ভক্তিরস আর অন্য দিকে হাসির গানেও তাঁর জুড়ি ছিল না। নিধুবাবু নিজে রূপচাঁদের গুণগ্রাহী ছিলেন। আর এক পক্ষীর গপ্পো অবশ্য বলেছিলেন টেকচাঁদ, যাঁর নাম ছিল আগড়ভম সেন। উৎকৃষ্ট গাঁজাখোরের কেমন চেহারা হওয়া উচিত তার অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন টেকচাঁদ— ‘চোখদুটি মৃদঙ্গের তালা— হাঁটি বোড়াসাপের মত—দন্তগুলি মিসি ও পানের ছিবের তবকে চিকচিক করিতেছে— গোঁপ জোড়াটী খাঁদরার মুড়া ও চুলগুলি ঝোটন করে কালো ফিতে দিয়া বান্ধা।’ তিনি আড্ডায় পা দেওয়া মাত্র কলকের ধুনি জ্বলে উঠত। ‘একজন পড়িতে পড়িতে উঠিয়া বলিত— আমাকে ধর— আমাকে ধর— আমি স্বর্গে যাই! এমনি আর একজন জাপুটিয়া ধরিয়া বলিত,— না বাবা কর কি, একটু থাম এই ঝুলনটা বাদে যেও।… গৃহ ধুমময়, এক একবার টানের চোটে বাড়ী আলোকময় হইতেছে, খক খক কাশির শব্দ উঠিতেছে।’

সব পাখি ঘরে ফেরে না! এঁরাও ক্রমশ হারিয়ে গেলেন কলকাতা থেকে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই শুরু অবলুপ্তি। হুতোম তাঁর নকশায় যেমন লিখছেন, ‘এখন আর পক্ষীর দল নাই… পাখিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু একটা আদমরা বুড়ো গোছের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙা, টাকার খাঁকতিতে মন মরা হয়ে পরেচে। আড্ডাটি মিউনিসিপাল কমিসনরেরা উঠিয়ে দেছেন অ্যাখন কেবল তার রুইনমাত্র পড়ে আছে।’

পক্ষীরা নেই, তবু গাঁজার মৌতাত ব্যাপ্ত করেছে চরাচর। যার ইতিহাস পুরাণসিদ্ধ, তার কি অবলুপ্তি আছে? ‘ক্যানাবিস স্যাটিভা’ নামের এই ঐন্দ্রজালিক পাহাড়ি গাছটির বাণিজ্য নিয়ে যুদ্ধ শতাব্দীবাহিত। রোগ নিরাময়ে গাঁজার ভূমিকা সর্বজনবিদিত। গাঁজাকে নিষিদ্ধ মাদকের আওতা থেকে বার করে আনার জন্য পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে চলা আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছে ভারতেও। অবশেষে ৫৯ বছর পর সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জ সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাঁজা ও চরসকে বিপজ্জনক মাদকের আওতা থেকে মুক্তি দেওয়ার। চিন, পাকিস্তান, রাশিয়া এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও ১৯৬১ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘সিঙ্গল কনভেনশন’ভুক্ত বিপজ্জনক মাদক তালিকায় চার নম্বরে থাকা গাঁজাকে সরাতে সায় দিয়েছে ভারতও। ‘নার্কোটিক্স ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্স অ্যাক্ট’ অনুসারে ভারতে গাঁজা উৎপাদন ও পরিবহণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। তবু সমান্তরাল কালোবাজারে প্রশাসনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে রমরমিয়ে চলেছে এর বাণিজ্য। হিমাচল প্রদেশে তৈরি মানালা ক্রিম (গাঁজার ফুলের বাছাই করা কুঁড়িযুক্ত অংশের আঠা থেকে তৈরি হাশিশ) গোপন পথে যত পাহাড় থেকে সমতলে নামে, তত তার দাম বাড়ে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সিদ্ধান্ত ভারতে কবে বাস্তবায়িত হবে, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু আইনসিদ্ধ হয়ে গেলে দার্জিলিংয়ের চায়ের মতোই হিমাচলের ‘কালো সোনা’ বা কেরলের ‘সবুজ পান্না’র জন্য যে কর্পোরেটরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। হয়তো গরিব দেশবাসীর চোখের সামনে দিয়ে হিমালয়ের প্রসাদ হাইপ্রোফাইল প্যাকেজে উড়ে যাবে ব্রাসেলস বা বার্মিংহাম! কিন্তু এটাও ঠিক, তখন আর কলেজ ক্যান্টিনের পিছনে লুকিয়ে বানাতে হবে না জয়েন্ট (গাঁজাভরা সিগারেট)। মুক্তাঞ্চলে নিশ্চিন্তে ছিলিমে টান দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না কুম্ভমেলার। খোলা বাজারে বিক্রি হবে বাহারি রতনকাটারি (গাঁজা কাটার ছুরি), টিকলি (কলকের সরু দিকটিতে একটি তিনকোনা পাথর) সাফি বা জামিয়ার (কলকেতে জড়ানোর ভিজে কাপড়), প্রেমতক্তি (যে কাঠের টুকরোর উপরে রেখে গাঁজা কুচোনো হয়)। তৈরি হবে মারিজুয়ানা কাফে। নেদারল্যান্ড, স্পেন, ইজ়রায়েল বা পর্তুগালের মতো, খোলা বাজারে সুসজ্জিত দোকানে কাচের বয়ামে সাজানো থাকবে বিভিন্ন মান ও মাপের গাঁজা ও চরস।

গাঁজা নিয়ে প্রথম লেখেন চিনা সম্রাট শেন নুং। ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তিনি গাঁজার ভেষজ গুণ নিয়েই লিখেছিলেন। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আশপাশে লেখা অথর্ব বেদ, গাঁজাকে স্বীকৃতি দিয়েছে পবিত্র ঘাস হিসেবে। সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত থেকে গাঁজা গাছের উৎপত্তির উল্লেখ রয়েছে। আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য এশীয় স্কাইথিয়ান গোষ্ঠী শণের পোশাক ও দড়ি ব্যবহার করত। এর পর এদের হাতে পৌঁছয় এই ক্যানাবিস প্রজাতির শণ। গাঁজা যে হেতু আদতে পাহাড়ি, অনুমান করা হয়, হিমালয়ের রাস্তা দিয়েই সে চলতে শুরু করে পশ্চিমের দিকে। পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দে, গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস তাঁর লেখায় স্কাইথিয়ানদের গাঁজা টানার কথা উল্লেখ করেছেন, আর তার দুশো বছরের মধ্যেই গ্রিকরাও গাঁজা সেবন, আর সেই শণের পোশাক পরায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার এই আশ্চর্য উদ্ভিদ, দেশভেদে যার নাম ভিন্ন। পশ্চিমে যা উইড বা মারিজুয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাই ড্যাগো, উত্তর আফ্রিকায় হেম্প বা গ্রাস। তর্কযোগ্য ভাবে বাংলায় গাঁজার আনুষ্ঠানিক বা সরকারি কৃষিকর্ম শুরু হয় ১৯০৬ সালে বাংলাদেশের ‘নওগাঁ গাঁজা সোসাইটি’-র মাধ্যমে। আর এই গাঁজার টানকে পাগলামির লক্ষণ বলে দেগে দিতেও কম চেষ্টা করেননি ঔপনিবেশিক কর্তারা। ‘ভুঁইফোড়ের মনোবিদ্যাচর্চা’ গ্রন্থটিতে অমিতরঞ্জন বসু লিখছেন, ‘গাঁজা নিয়ে ঔপনিবেশিক কর্তাদের চিন্তাভাবনার সূত্রপাত লুনাটিক অ্যাসাইলাম বা পাগলাগারদ (এই নামেই বাংলায় অ্যাসাইলামগুলি পরিচিত হয়ে উঠেছিল) সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।... যেসব মানসিক রোগাবস্থার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যেত না, তখন যদি গাঁজা ব্যবহারের তথ্য রোগীর থেকে পাওয়া যেত তখনই ধরে নেওয়া হত এ অবস্থা গাঁজার জন্যই হয়েছে।’ তবে এই ব্রিটিশরাই নওগাঁতে শুধুমাত্র গাঁজা সোসাইটির জন্য আলাদা এক জন রেজিস্টার নিয়োগ করেছিলেন। আসলে ওই সোসাইটি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দিত ব্রিটিশ বাহাদুরকে।

বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে আমেরিকায় তৈরি হল প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক কাউন্টার কালচার। ইউরোপের কিছু দেশেও যার জোয়ার লাগল। যা যুদ্ধবিরোধী, সমকামিতা সমর্থক, নারীবাদী আন্দোলনের পালে বাতাস লাগানো, উদার মুক্ত যৌনতাপন্থী, ভিন্নতর এক যাপন ও বিপ্লব। ছিলিমের ধোঁয়া নিছকই নেশাদ্রব্য থাকল না আর। আন্তর্জাতিক এই মেগা থিয়েটারে সে জড়িয়ে যেতে লাগল আভাঁগার্দ শিল্প, যাপন, বিপ্লব ও শান্তির প্রতীক হয়ে। বিটল্‌স-এর চার মক্কেল, জিম মরিসন, বব ডিলান, জোন বেজ-রা গান বাঁধলেন, জিন্‌স উঠে এল ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে, তৈরি হল এক পরিবর্ত যাপন, হিপি সাবকালচার। গাঁজার নেশা যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে উঠল। ডিলান তাঁর ‘রেনি ডে উওম্যান’ গানে বললেন, ‘এভরিবডি মাস্ট গেট স্টোনড’। দুনিয়া কাঁপানো পিং ফ্লয়েড তাদের ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’ অ্যালবামের একটি গানে লিখল ‘দ্য লুনাটিক ইজ় অন দ্য গ্রাস’। বলা হল, ‘দেয়ার ইজ় সামওয়ান ইন মাই হেড বাট ইটস নট মি!’ জামাইকান শিল্পী বব মার্লের নামেই রোলিং পেপারে গাঁজা ভরা পেল্লায় জয়েন্ট-এর নামকরণ হল ‘মার্লে জয়েন্ট’।

ষাটের দশকের সেই কলকাতায় এই কাউন্টার কালচারের ঢেউ এসে লাগছিল নানা ভাবে। বাউলদের সহজিয়া গাঁজাদর্শনের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল পশ্চিমি ঢেউ। গাঁজা টানার সঙ্গে ধর্ম-কর্ম মিলেমিশে একাকার হল। শহুরে গিটারের নীল বিষাদকে আরও গভীর করে তুলল জয়েন্ট-এর ধোঁয়া। কফি হাউসে ছাত্রদের মধ্যে সিগারেটে গাঁজার মশলা ভরে টানার রেওয়াজ বাড়ল। আমেরিকার কবি অ্যালেন গিনসবার্গ দীর্ঘ দিন কলকাতায় থেকে লিখলেন ‘নাইট ইন দ্য বার্নিং ঘাট’— যা আজও নিমতলা ঘাটের সাধুসন্তদের গঞ্জিকা সেবনের এক অনন্য জার্নাল।

আজ দেশের বিভিন্ন রাজ্য বিভিন্ন প্রকারের গাঁজা ও চরস রসিকসেবায় নিয়োজিত। কর্নাটকের মাইসোর ম্যাঙ্গো, কেরলের ইদ্দুকি গোল্ড, তামিলনাড়ুর ম্যাজিক মাশরুম, মণিপুরি, মহারাষ্ট্রের বম্বে ব্ল্যাক, বাংলার গৌড়ভাঙা, হিমাচলের মানালা ক্রিম, বিবিধের মাঝে নেশার মিলন ঘটাচ্ছে।

জলপথ ও স্থলপথে ভ্রমণ অর্থাৎ মদ এবং গাঁজার নেশার বাইনারি দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সমাজ, শ্রেণি, মেজাজ, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন মাপকাঠি রয়েছে এই দুইয়ের। আবার উভচরের সংখ্যাও কম নয়! ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘নয়নচাঁদের ব্যবসা’ শীর্ষক গল্পের অংশবিশেষ শুনিয়ে কলকে গুটিয়ে ফেলা যাক!

‘...নয়ন বলিলেন,— আর বিশ্বাস করিও না এই পেশাদার মাতালদের। মন তাদের সাদা বটে, কিন্তু কখন্ কি ভাবে থাকে তার ঠিক নাই। সাত ঘাটের জল এক করিয়া তুমি চারিটি পয়সা যোগাড় করিলে, আড্ডায় আসিয়া চারি পয়সার ছিটে টানিলে, নেশাটি করিয়া তুমি আড্ডা হইতে বাহির হইলে, আর হয় তো কোথা হইতে একটা মাতাল আসিয়া তোমার গায়ের উপর ঢলিয়া পড়িল। তোমার নেশাটি চটিয়া গেল। শীতকাল, মেঘ করিয়াছে, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছে, ফুর ফুর করিয়া বাতাস হইতেছে, সহজেই নেশাটি বজায় রাখা ভার, তার উপর কোথা হইতে হয়তো একটা মাতাল আসিয়া তোমার গায়ে হড়-হড়

বমি করিয়া দিল! তোমার নেশাটির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল। পেশাদার মাতালেরা এইরূপ লোকের মর্মান্তিক করে।...’

এই কারণেই তো শৌখিন গেঁজেলরা চিরকাল পেঁচি মাতালদের এড়িয়ে চলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE