Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Balendranath Tagore

শরীরের কষ্ট কখনও ক্লান্ত করেনি তাঁকে

তিনি বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পা দু’টি জন্ম থেকেই বাঁকা, স্বাস্থ্যও দুর্বল। হাঁটতে অসুবিধে হত, সইতে হত ভাইদের ব্যঙ্গ। শুধু মনের জোরেই কাজকর্ম, লেখাপড়া, সংস্কৃতিচর্চার বহু মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন ২৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে। আগামী শুক্রবার ‘রবিকা’-র প্রিয় ‘বলু’-র ১৫০ বছর।১২৭ বছর আগে ‘কণারক’ রচনায় বলেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কণারক এখন শুধু স্বপ্নের মত, মায়ার মত; যেন কোন প্রাচীন উপকথার বিস্মৃতিপ্রায় উপসংহার শৈবাল-শয্যায় এখানে নিঃশব্দে অবসিত হইতেছে’... সার্ধশতবর্ষে কর্মযোগী বলেন্দ্রনাথও কি ‘অবসিত’ হয়ে যাবেন!

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির তেতলার একটি ঘরে বন্দি তিনি। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। সকলের ওপর সন্দেহ। সারা দিন ঘরের দেয়াল আর ফুলের টবে কাঠকয়লা দিয়ে সূর্য আঁকেন, মাঝখানে লেখেন ‘সূর্য’। উন্মত্তও হয়ে ওঠেন মাঝে মাঝে, তখন ঘরের চেয়ার, দোলনা-চৌকি ছুড়ে ফেলেন নীচের উঠোনে।

তিনি বীরেন্দ্রনাথ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র। রবীন্দ্রনাথের বীরুদাদা। প্রাক্‌যৌবনেই মানসিক রোগের লক্ষণ ধরা পড়েছিল বীরেন্দ্রনাথের। কিন্তু বাড়ির বড়রা ভেবেছিলেন বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। অতএব তাঁর বিয়ে, ২১ বছর বয়সে, ১৮৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তার বছর আড়াইয়ের মাথায় যখন চরম বৃদ্ধি পেল এ রোগ, তখন স্ত্রী প্রফুল্লময়ী সন্তানসম্ভবা। বীরেন্দ্রনাথকে ভর্তি করে দেওয়া হল আলিপুর লুনাটিক অ্যাসাইলামে। ছ’মাস চিকিৎসার পর সামান্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। কয়েক মাসের মাথায় ১৮৭০-এর ৬ নভেম্বর (২১ কার্তিক ১২৭৭) জন্ম তাঁদের সন্তান বলেন্দ্রনাথের। তত দিনে বীরেন্দ্রনাথ ফের অসুস্থ। তাঁর সদ্যোজাত সন্তানের শরীরও বেশ দুর্বল, পা-দু’টি বাঁকা। অনেক দিন হাঁটতে পারেননি তিনি। চলতে হয়েছে পা ঘষে-ঘষে। বাড়ির অন্য ভাইরা তাই যথেচ্ছ ব্যঙ্গ করত। কিন্তু আশ্চর্য মনের জোর এই বালকের। তাঁর মা-র কথায়, ‘‘বাপের ওইরকম অবস্থা হওয়াতে তার মনে তখন হইতেই একটা বড় হইবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা হইয়াছিল। যখন আট-নয় বছরের, সেই সময় আমাকে প্রায় বলিত যে, সে লেখাপড়া শিখিয়া ইঞ্জিনিয়ার হইবে।’’ ইঞ্জিনিয়ার হননি বটে, কিন্তু বলেন্দ্রনাথের ২৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন এক কর্মপ্রাণ পুরুষের উজ্জ্বল উদাহরণ।

কৈশোরেই সাহিত্য রচনার সূচনা। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি ‘টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। ২০ বছর বয়সেই আদি ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম অধ্যক্ষ তিনি। সুহৃদ সমিতি গঠন, ‘সাধনা’ পত্রিকা প্রকাশ, ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের নির্ভুল জন্মপত্রিকা প্রস্তুত, ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে গভীর অনুধ্যান, ‘স্বদেশী ভাণ্ডার লিমিটেড’-এর জন্য দ্রব্য সংগ্রহ, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহ, পঞ্জাবের আর্য সমাজের সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের যোগসেতু নির্মাণ— ক্লান্তিহীন বলেন্দ্রনাথের সামান্য ক’টি কাজের নমুনা মাত্র।

এত কিছুর মধ্যেও অব্যাহত তাঁর লেখালিখি। রবীন্দ্রনাথ বড় ভালবাসতেন তাঁর বছর নয়েকের ছোট এই ভাইপোকে। জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ যাত্রার অন্যতম সঙ্গী বলেন্দ্রনাথ। ১২৯৯ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে রবীন্দ্রনাথ ওড়িশা যান। তাঁর ইচ্ছে ছিল স্ত্রী মৃণালিনীকে সঙ্গে নেওয়ার। সেই মতো বাবা মহর্ষির অনুমতি প্রার্থনা করেন রবীন্দ্রনাথ। ২৮ অগ্রহায়ণ ১২৯৯ তারিখে মৃণালিনী দেবীকে তিনি লিখেছেন, ‘‘চেষ্টা করব উড়িষ্যায় যদি আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। সে জায়গাটা ভারি স্বাস্থ্যকর। আমি বাবামশায়কে আমার ইচ্ছে কতকটা জানিয়ে রেখেচি, তিনিও কতকটা বুঝেচেন— আর দুই একবার বল্লে কিছু ফল হতেও পারে— কিন্তু আগে থাকতে বেশি আশা করে বসা কিছু না।’’ তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩১ বছর। ন’বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে, এমনকি মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ আর রেণুকা, এই তিন সন্তানের জন্মও হয়ে গেছে। তবু পিতা মহর্ষির অনুমতি মেলেনি। মৃণালিনীকে নিয়ে যেতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গী হয়েছিলেন বলেন্দ্রনাথ। কোনারক বিষয়ে বলেন্দ্রর লেখালিখির প্রেক্ষাপট সম্ভবত এই সফরই তৈরি করে দিয়েছিল।

শারীরিক অসুস্থতার জন্য বলেন্দ্রনাথের স্কুলে ভর্তি হতে দেরি হয়। যদিও বাড়িতে পড়াশোনায় খামতি ছিল না। ১৮৭৭-এ সংস্কৃত কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন, সেখানে কিছু কাল পাঠ নেওয়ার পর বলেন্দ্র ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। ১৮৮৬-তে হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ। তাঁর মা প্রফুল্লময়ী ‘আমাদের কথা’ নামে স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, “আমার নানা রকম মনের অশান্তির মধ্যে ওর জন্ম হইয়াছিল বলিয়া তাহারও শরীরটা তেমন সুস্থ ছিল না, দুটি পা-ও একটু বাঁকা মতন হইয়াছিল।… ছয় বৎসর সময় তাকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করিয়া দিয়াছিলাম। সে তার মামাতো ও জেঠতুতো ভাইদের সঙ্গে আমাদের সরকারী গাড়ীতে করিয়া পড়িতে যাইত, কিন্তু তার পায়ের দোষ থাকায় অন্য ভাইরা ঠাট্টা করিত।”

বলেন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘একরাত্রি’ নামে প্রবন্ধ, বেরোয় ‘বালক’ পত্রিকায়, ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। ওই বছর ফাল্গুন সংখ্যায় বেরোয় ‘সন্ধ্যা’ নামে কবিতা। বলেন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৫ বছর। পরের বছর মাঘোৎসবে বলেন্দ্রনাথের লেখা গান প্রাতঃকালীন সভায় গীত হয়। জীবদ্দশায় তিনটি বই— ‘চিত্র ও কাব্য’ (১৩০১, প্রবন্ধ), ‘মাধবিকা’ (১৩০৩, কাব্য), ‘শ্রাবণী’ (১৩০৪, কাব্য) প্রকাশিত হলেও তাঁর অধিকাংশ লেখা ছড়িয়ে ছিল ‘সাধনা’, ‘ভারতী’-সহ নানা পত্রিকায়। ‘চিত্র ও কাব্য’ বইয়ে কালিদাস, ভবভূতি, জয়দেবের কবিপ্রতিভা বিশ্লেষণের পাশাপাশি ফাইন আর্টস বিষয়ে তাঁর আলোচনা নজর কেড়েছিল বিশিষ্টদের। উল্লেখ্য, এ বই বেরিয়েছে বলেন্দ্রনাথের ২৪ বছর বয়সে, লেখাগুলি তৈরি আরও আগে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ আর বীরেন্দ্রনাথের পুত্র বলেন্দ্রনাথ মিলে তৈরি করেছিলেন ‘সুহৃদ সমিতি’। এই সমিতি থেকেই ‘সাধনা’ পত্রিকার জন্ম। প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন, ‘সাধনা’ পত্রিকার ‘ঘোষিত সম্পাদক ও কার্যাধ্যক্ষ হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ ও নীতীন্দ্রনাথের নাম থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সেই কাজ করতেন রবীন্দ্রনাথ ও বলেন্দ্রনাথ।’ রবীন্দ্রনাথের একাধিক চিঠিতে তার প্রমাণ মেলে। একটি চিঠিতে বলেন্দ্রনাথকে লিখছেন— ‘আমার য়ুরোপের ডায়ারি পাঠালুম। এই লেখাগুলোর হেডিংয়ের নীচে ব্র্যাকেটের মধ্যে (য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি) সাব হেডিং বসিয়ে দিয়ো।’ অন্য একটি চিঠিতে দেখছি রবিকাকা তাঁর বলুকে লিখছেন— ‘ভাদ্র মাসের কাগজটা বোধকরি অক্সফোর্ড অথবা অন্য কোন প্রেসে দেওয়া আবশ্যক হবে, নইলে ১৫ই ভাদ্রের মধ্যে ভাদ্র-আশ্বিনের কাগজ সমাজ থেকে বের করা অসাধ্য হবে।… কিন্তু ভাদ্র-আশ্বিনের কাগজ এক সঙ্গে বের না করলে ভারি মুস্কিলে পড়বে। কারণ পুজোর ছুটির সময় অনেক গ্রাহকেরই ঠিকানা পরিবর্ত্তন হবে পনেরই ভাদ্র-আশ্বিনের কাগজ পাঠালে নিশ্চয়ই তারা নিজ নিজ স্থানেই পাবে।… ভাদ্র-আশ্বিনের সংখ্যায় আমার কোন দুটি গল্প দেবে ? ‘ছুটি’ এবং ‘স্বর্ণমৃগ’ দিয়ো।’ উল্লেখ্য, ‘ছুটি’ গল্পটি এই সংখ্যার বদলে বেরোয় ১২৯৯ এর পৌষ সংখ্যায়, ‘স্বর্ণমৃগ’ ভাদ্র-আশ্বিনেই বেরোয়। শেষ পর্বে রবীন্দ্রনাথ স্বনামে ‘সাধনা’র সম্পাদনা করেন।

১২৯৬-এর ১১ অগ্রহায়ণ রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ যাত্রার সঙ্গী হয়েছেন বলেন্দ্রনাথ। সে যাত্রায় মৃণালিনী দেবী, মেয়ে বেলা, রথীন্দ্রনাথও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু শিলাইদহে সে বারে এক উদ্বেগের ঘটনা ঘটে। বলুর সঙ্গে বিকেলে পদ্মার চর আর বালিহাঁস দেখতে বেরিয়েছিলেন মৃণালিনী, ফেরার পথে বালির সমুদ্রে পথ হারান। মাঝিদের সহায়তায় যখন ফিরলেন, তত ক্ষণে তোলপাড় চারদিক। বলেন্দ্রনাথের ‘অ্যাডভেঞ্চার’ নামে লেখায় এবং রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে তার ছবি আছে।

ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত ‘পারিবারিক স্মৃতি-লিপি-পুস্তক’-এর সূচনা করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ১২৯৫-এর ২১ কার্তিক। ওই দিন বলেন্দ্রনাথ এখানে ‘অক্ষর তত্ত্ব’ নামে একটি রচনায় লেখেন— ‘শুধু যে ভাষার কথা থেকেই জাতির অবস্থা বোঝা যায় এমন নয়, ভাষার অক্ষর দেখেও জাতির ভাব কতকটা বোঝা যায় বোধহয়। বাঙ্গালা ভাষার অক্ষর আর সংস্কৃতর অক্ষর দেখলেই এটা অনেকটা প্রমাণ হয়। সংস্কৃতর অক্ষরগুলি কেমন গোলগাল পেটটী বেশ মোটা সোটা, দেখলেই মনে হয় তারা যেন অনেক দুধ ঘি খেয়ে মানুষ হয়েছে। আর বাঙ্গালা অক্ষর গুলি শুধু যেন অস্থিপঞ্জর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।… এই রকম করে দেখা যায় জাতির মনের ভাব কথায় বর্ণমালায় যেমন তেমনি অক্ষরের আকৃতি দেখেও কতকটা বোঝা যায়।’ ২১ কার্তিক ছিল বলেন্দ্রনাথের ১৯তম জন্মদিন। ২২ কার্তিক রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙ্গলা ভাষা ও বাঙ্গালী চরিত্র’ রচনায় এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় সংস্কৃত শব্দ বাঙ্গলায় রূপান্তরিত হয়ে এক প্রকার বিকৃত ভাব প্রকাশ করে। কেমন এক রকম ইতর বর্ব্বর আকার ধারণ করে। ‘ঘৃণা’ শব্দের মধ্যে একটা মানসিক ভাব আছে।... কিন্তু ‘ঘেন্না’ বল্লেই নাকের কাছে একটা দুর্গন্ধ, চোখের সামনে একটা বীভৎস দৃশ্য, গায়ের কাছাকাছি একটা মলিন অস্পৃশ্য বস্তু কল্পনায় উদিত হয়। সংস্কৃত ‘প্রীতি’ শব্দের মধ্যে একটি বিমল উদার মানসিক ভাব নিহিত আছে। কিন্তু বাঙ্গলা পীরিতি শব্দের মধ্যে সেই বিশুদ্ধ ভাবটুকু নাই।’ স্মৃতি-লিপি-পুস্তকে বলেন্দ্রর ওই লেখা না থাকলে আমাদের কাছে অজ্ঞাত থাকত রবীন্দ্রনাথের এমনতর মতামত। ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই ভারতীয় চিত্রশিল্প বিষয়ে বলেন্দ্রনাথের আগ্রহ আমাদের বিস্মিত করে। শারীরিক অসুস্থতা ভুলে থাকতেই কাজের সমুদ্রে যেন ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তাঁর চেষ্টাতেই পঞ্জাবের আর্য সমাজের সঙ্গে আদি ব্রাহ্মসমাজের যোগসূত্র গড়ে ওঠে।

১৮৯৬-এর ৪ ফেব্রুয়ারি বলেন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ইলাহাবাদের ফকিরচাঁদ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সুশীতলা (সাহানা) দেবীর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ বিয়ে উপলক্ষে তাঁকে ‘নদী’ বইটি উৎসর্গ করেন। লেখেন ‘উৎসব’ নামের কবিতা। ১৮৯৯-এ দ্বিতীয় বার পঞ্জাব যান বলেন্দ্র। সেখান থেকে ফেরার পথে মথুরা, বৃন্দাবন, ইলাহাবাদ দর্শনে যান তিনি। ফিরে এলেন অসুস্থতা নিয়ে। কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই তাঁর। টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির তখন ভরাডুবি। ডুবন্ত ব্যবসা বাঁচাতে দিনরাত প্রবল শ্রম শুরু হল। আরও ভেঙে পড়ল শরীর। দুশ্চিন্তা আগেই ভেঙে দিয়েছিল মন। তখন তিনি মাত্র ২৯। অসুস্থতা আরও জটিল হয়ে উঠলে শিলাইদহ থেকে তাঁকে কলকাতায় আনা হল। অঘোর ডাক্তার, উমাদাস বাঁড়ুজ্জে, এবং ডাক্তার সালজারের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি, কবিরাজি তিন ধরনের চিকিৎসাই। কিন্তু ব্যর্থ হলেন ডাক্তাররা। ১৮৯৯ সালের ১৯ অগস্ট ভোরে (অন্য মতে ২০ অগস্ট, বাংলা ৩ ভাদ্র ১৩০৬) মৃত্যু হল তাঁর। মৃত্যু-মুহূর্তেও পাশে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রফুল্লময়ী স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তাঁরা (ডাক্তার) আমাকে বলিতেন যে, ভয়ের কোনও কারণ নাই, ভাল হইয়া যাইবে। কিন্তু আমি কিছুতেই সে ভরসা পাইলাম না।… বলুর অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাইতে লাগিল। যেদিন সে জন্মের মতো আমাকে তাহার বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া চলিয়া গেল, সেইদিন রবি (রবীন্দ্রনাথ) আসিয়া আমাকে বলিলেন যে, তুমি একবার তার কাছে যাও, সে তোমাকে মা-মা করিয়া ডাকিতেছে। আমি এক এক সময় তাহার যন্ত্রণা দেখিতে না পারিয়া পাশের ঘরে গিয়া থাকিতাম। রবির কথা শুনিয়া যখন তার কাছে গিয়া তার পাশে বসিলাম তখন তার সব শেষ হইয়া আসিয়াছে। মনে হইল আমাকে দেখিয়া চিনিতে পারিল, তাহার পর একবার বমি করিয়া সব শেষ হইয়া গেল।’

উন্মাদ বীরেন্দ্রনাথ তখনও জীবিত। পুত্রশোক কি স্পর্শ করেছিল তাঁকে? সে দিন যে তিনি তাঁর বন্ধ ঘর থেকে বার বার চিৎকার করছিলেন, সে তথ্য ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস ঘাঁটলে মেলে। শোনা যায় তিনি নাকি বার বার জানতে চাইছিলেন— ‘বাড়িতে সব তালাবন্ধ কেন?’

বলেন্দ্রর মৃত্যুর পর প্রফুল্লময়ী-সাহানার জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর শেষ উইলে অপুত্রক ও বিকৃতমস্তিষ্কদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। মাথাপিছু মাসিক ১০০ টাকা মাসোহারা নির্দিষ্ট হয় তাঁদের জন্য। সাহানার বয়স তখন বছর পনেরো। তাঁকে ইলাহাবাদে পাঠানো হয়। মহর্ষির কাছে খবর আসে, সেখানে সাহানার দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন চলছে। প্রফুল্লময়ীও চাইছিলেন বাচ্চা মেয়েটি নিজের মতো বাঁচুক, খুঁজে নিক নতুন ভবিষ্যৎ। মহর্ষির তাতে ঘোর আপত্তি— ঠাকুরবাড়ির মান ডুবে যাবে যে! তাই তড়িঘড়ি তিনি ইলাহাবাদ পাঠালেন রবীন্দ্রনাথকে। পিতৃ-নির্দেশ পালনে যান রবীন্দ্রনাথ। সাহানাদের পরিবারকে বুঝিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু সাহানার অসহায়ত্বের কোনও সুরাহা হয় না।

তবে, বলু-র প্রতি টান অটুট ছিল তাঁর রবিকা-র। মৃত্যুর পর বলেন্দ্রনাথের তিনটি লেখা রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা-সহ বেরোয় ‘প্রদীপ’ পত্রিকায় (আশ্বিন-কার্তিক ১৩০৬)। অসম্পূর্ণ লেখাগুলি তৈরি করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে প্রসঙ্গে সম্পাদককে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— ‘বলেন্দ্র কোন রচনায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে তাহার বিষয় প্রসঙ্গ লইয়া আমার সহিত আলোচনা করিতেন।… তাহা ছাড়া নিজের স্মরণার্থ সঙ্কলিত প্রবন্ধের ভাবসূচনাগুলি তিনি স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সংক্ষেপে টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহার অসমাপ্ত লেখা ও সূচনাগুলির সাহায্য লইয়া যথাসম্ভব তাঁহার নিজের ভাষায় প্রবন্ধটি সংক্ষেপে সম্পূর্ণ করিয়া সেই সত্যসংকল্প মহদাশয়কে ‘প্রদীপ’ সম্পাদকের নিকট ঋণমুক্ত করিলাম।’

১২৭ বছর আগে ‘কণারক’ রচনায় বলেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কণারক এখন শুধু স্বপ্নের মত, মায়ার মত; যেন কোন প্রাচীন উপকথার বিস্মৃতিপ্রায় উপসংহার শৈবাল-শয্যায় এখানে নিঃশব্দে অবসিত হইতেছে’... সার্ধশতবর্ষে কর্মযোগী বলেন্দ্রনাথও কি ‘অবসিত’ হয়ে যাবেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Balendranath Tagore Life story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE