উনিশ শতকের কলকাত্তাইয়া বাঙালি বাবু হুতোমের ভূত ও ভবিষ্যতের নাড়িজ্ঞানটি ছিল টনটনে। রাজটা ইংরেজের, শতাব্দীর ভবিষ্যৎ তাদের মুঠিতে, নিউ-ইয়ারের আমোদ তাদেরই সাজে। তারাই ‘আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরন করে ন্যান।’ অতীত তো বাঙালিকে ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে যায়, বর্তমান যেন বাঙালির কাছে ‘মড়ুঞ্চে পোয়াতীর বুড় বয়েসের’ ছেলে, তাই বছরের শেষ দিন ধুমধাড়াক্কার চৈত্র-সংক্রান্তির ল্যাজেই হাজির হত। সে দিনের বাঙালির নববর্ষ, ‘কেবল কল্সি উচ্ছুগ্গু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।’ ‘খৃষ্টমতে’ নববর্ষের দিনে ইংরেজটোলার জৌলুস কৈলাসধাম ও অমরাবতীকেও টেক্কা দিত। ময়দানের কুচ, গড়ের বাদ্যি ও লাটবাড়ির রোশনাই, ঘোড়দৌড় ও হোটেলের ভোজ, সে সব খানাপিনার কত আওয়াজই ঈশ্বরগুপ্তের প্রাকৃত কানে ধরা পড়েছে, ‘চুপু চুপু চুপ, চুপ, চপ, চপ, চপ। সুপু সুপু সুপ, সুপ, সপ, সপ, সপ।’ মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলে ওই দিনেই দেশি খেতাবের তালিকা বেরোত, রায়বাহাদুর ও খানবাহাদুররা আহ্লাদে আটখানা হতেন।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের নিউ ইয়ারের কাছে বৈশাখী নববর্ষ ছিল তুশ্চু, ছুটিও মিলত না, স্বাধীন ভারতে পঞ্জিকা সংস্কারের গোড়ার আমলেও হাল-হকিকতের তেমন উন্নতি হয়নি। নকশাকার রূপদর্শী সাফসুতরো লিখেছিলেন, ‘আউটরামের বদলে গান্ধিজীর স্ট্যাচুর মত আমরা পয়লা বৈশাখকে টেনে এনেছি... পয়লা বৈশাখ আট হাতি ধুতি পরে আর কোঁচানো চাদর ঝুলিয়ে বেতো ঘোড়ার মতো নেংচে নেংচে চলছে।’
উৎসব তো সামাজিক, সেখানে নানা বিনিয়োগ চাই; অতিকথার মাহাত্ম্য, বাজারের চাহিদা ও টাকার জোর, লৌকিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা, তবেই উৎসবের কদর ও পরিসর বাড়ে। পয়লা বৈশাখের শিকড় খুঁজতে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ও চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর মতো পণ্ডিতরা কম চেষ্টা করেননি, কিন্তু মধ্যযুগের স্মৃতিশাস্ত্রে বা সাহিত্যে সন পহেলি বৈশাখের কোনও স্মৃতিচিহ্ন পাননি। লোকমতে বর্ষবরণ নানা সময়ে হয়। উত্তর ভারতে সাধারণত চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদে বর্ষারম্ভ হয়, সিন্ধিদের চৌথি চাঁদও এই মাসেই হয়, চৈত্র মাসের শেষ দিনে গুজরাতিরা ‘সাভান্ত্’ পালন করে, সব হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে ঘর পরিষ্কার করে ধোপদুরস্ত নতুন জামা পরে। উনিশ শতকে বাংলার পল্লিগ্রামে পালাপার্বণের রিপোর্টার দীনেন্দ্রকুমার রায় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনকে ভগবতী যাত্রা বলেছেন, গৃহস্থের গোয়ালঘরে ভগবতী দুর্গার পূজা হত। গ্রহবিপ্ররা আসতেন, গ্রামের অবস্থাপন্ন লোকের বাড়িতে সম্বৎসরের শুভাশুভের আগাম বার্তা শুনিয়ে দক্ষিণা নিতেন। তখনই তো চৈত্রের গাজনের পরে ফুরসত পেয়ে কৈলাসে পার্বতী শিবের কাছে বর্ষফল শোনেন, ‘কৈলাস ধামেতে বসি হর ও পার্বতী/ সুশীতল সমীরণ বহে মন্দগতি।/ পার্বতী কহেন, ‘প্রভু কহো ভগবান/ নববর্ষের ফল করহ ব্যাখ্যান/ কত পোয়া ফল হবে কত পোয়া জল/ সে কথা জানিতে বড় চিত্ত চঞ্চল।’ খবরে পড়েছি যে ছাপা পাঁজি সুলভ হলে পর দৈবজ্ঞের আনাগোনায় টান পড়েছিল।
বাংলার গ্রাম, গঞ্জ ও শহরে ব্যবসায়ীদের দোকানেই পয়লা বৈশাখের জাঁকজমক ছিল। এই দিনে তাঁরা গণেশ পূজার মাধ্যমে নতুন হিসাবের খাতার পত্তন করেন, কলকাতায় কালীমাতার প্রসাদি সিঁদুরে মাখা রূপার টাকার চিহ্ন খাতার প্রথমে দেওয়া হত, অভাবে স্বস্তিক চিহ্নও আঁকা হত। সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা আমন্ত্রণপত্র ছাপতেন, বিকেলে নিয়মিত গ্রাহক বা খরিদ্দাররা সাজানো দোকানে এসে জলযোগ করতেন, কেউ কেউ বাকি পাওনা মেটাতে, আবার কেউ কেউ থালাতে টাকা ফেলতেন। গৃহস্থ বাড়ির আদেখলে ছেলেরা ওই সব চিঠি নিয়ে পাড়ার দোকানে দোকানে টুকটাক খেয়ে বেড়াত, মায়েরা টুকে দিতেন যে ধার করিস না, তা হলে সারা বছর ঋণী হয়ে থাকতে হবে। তারাপদ রায় পুব বাংলার অজ পাড়াগায়ের ছেলে, ১৯৪০-এর দশকে টাঙ্গাইলে নববর্ষের কোনও দাপট দেখেননি। শহরে হালখাতার জবরদস্ত উৎসব নজরে পড়েছিল। খোদ কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে পড়ত, নতুন সব বাংলা বই ওই বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে বেরোত। তখনও বইমেলা শুরু হয়নি। ১৯৪১ সনে ‘হালখাতা’ বলে পত্রিকাও বেরোচ্ছে, সুনির্মল বসু নানা রকম মন্ডামিঠাই-এর ছড়া কাটছেন, ওই মিষ্টিমুখের আসরে সবার নিমন্ত্রণ, ‘গরীব ধনী সবাই সমান/ ছোটর হেথা নাই অপমান/ পাচ্ছি প্রমাণ সর্বদাই/ নাইক বিধান মান্ধাতার,/ নিমন্ত্রণ আজ হালখাতার।’
লৌকিক ব্যবসায়ের টান এক কথা আর মহাকালচক্রের আবর্তে বর্ষবরণ উৎসবকে মানবজীবনে তথা জাতীয় সময়পঞ্জিতে লগ্ন করা আর এক কথা। অন্য অনেক কিছুর মতো এই সমস্যারও মুশকিল আসান রবীন্দ্রনাথ। চৈত্র সংক্রান্তি ও পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনের আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত বর্ষশেষ ও নববর্ষের ভাষণ দিতেন, সময়ের ক্রান্তিক্ষণের উদ্বোধন হত, দেবতা ঔপনিষদিক রুদ্র ভৈরব, সেই ভাষণে প্রাকৃত ব্যোম ভোলানাথের কোনও জায়গা নেই। বোলপুরে দারুণ গরম, ১৯৩৭ সাল থেকে পয়লা বৈশাখেই পঁচিশে বৈশাখ পালন করা শুরু হল, সে দিন থেকেই ভাল প্রাতরাশের পরে আশ্রমে ছুটির ঘণ্টা পড়ত। ভবিষ্যৎ তো কেউ জানত না, কিন্তু বৈশাখের প্রথম দিনে বাঙালির রবীন্দ্র-উৎসবের শুরু কবির জীবদ্দশাতে, খোদ শান্তিনিকেতনেই।
সে দিনের মিডিয়া এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি। গত শতকের বিশের দশক থেকে দৈনিক বাংলা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাতায় চলে যাওয়া বৎসরের সাংবাদিক হিসেব-নিকেশ করা হত, ত্রিশের দশক থেকে নিয়মিত বর্ষবরণের ক্রোড়পত্র বার হত। শুরুতেই থাকত রবীন্দ্রনাথের ভাষণের বাছা অংশ বা কবিতায় জুতসই ছত্র, যেমন, ‘দামামা ঐ বাজে, দিনবদলের পালা এল ঐ ঝড়ো যুগের মাঝে।’ রেডিয়ো পিছিয়ে থাকার পাত্র নয়। শুভ মহালয়ার প্রভাতি অনুষ্ঠানের সাফল্যের কথা মনে রেখেই ১৯৪১ সালের ১৪ এপ্রিল ভোর পাঁচটায় বাণীকুমারের লেখা সঙ্গীত-আলেখ্য ‘প্রথম প্রভাত’ সম্প্রচারিত হয়, বিষয় সূর্যের সঙ্গে ঊষার মিলন, বেদমন্ত্রের উদ্গাতা স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অনুষ্ঠানটা খুব একটা জমেনি, কোনও পুনরাবৃত্তি নেই। বাকি বছরগুলিতে বৈশাখের অনুষ্ঠান টুকটাক গীতি নকশা, কথিকা বা রবীন্দ্র-ভাষণের পাঠেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৫০ সাল থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ও জাতীয় ক্রীড়া সংঘ কলকাতা শহরে ও মফস্সলে নানা জায়গায় ‘নিখিল বঙ্গ নববর্ষ উৎসব’ পালন করতে থাকে, দোহার হয় আজাদী সংঘ, মণিমেলা, ব্রতচারী সংঘ। পাড়ায় পাড়ায় প্রভাতফেরি ও কুচকাওয়াজ হত, শহিদ বেদিতে মাল্যদান চলত ও সংকল্পবাণী পাঠ করা হত, কথাগুলি বাঙালি দেশাত্মবোধে ভরপুর, যেমন, ‘আজ নববর্ষের শুভদিনে আমি প্রথমেই আমার দেশজননীকে প্রণাম করি।... নিজেকে বাঙালি বলে সব জায়গায় পরিচয় দিতে গৌরববোধ করব,’ ‘প্রতিদিনের কথায়, কাজে, ব্যবহারে আমি বাঙালি হব।’ বিকেলে পাড়ায় পাড়ায় নানা সমিতি ও সংঘে প্রীতিসম্মেলন করা রেওয়াজ ছিল। দোকানদারের হালখাতার উৎসব পাড়ার বাঙালি ক্লাবের সেকুলার মিলনমেলায় পরিণত হল। শুভদিনে খবরের কাগজে সনাতনি কমলাকান্তের বকলমে প্রমথনাথ বিশী মাইকেলি ঢঙে রাজনৈতিক প্যারডি লিখতে দ্বিধা করতেন না, ‘শুভ নব বর্ষারম্ভে বীররসে ভাসি গাইব মা মহাগীত... ঊর দেবী ঊর দয়াময়ী ঊর জহরলালের চিত্তে পার্লামেন্ট সৃজে, কিম্বা যবে মন্ত্রীদল বিপক্ষ আঘাতে একেবারে নাজেহাল, তখন যেমন জাগায় মস্তক, জলেতে শুশুক যথা নীহারেন্দু বীর...’ বলে কত অর্থহীন ভাবে ভরা কথা। ১৩৬২ সালে বেছে বেছে পয়লা বৈশাখের পুণ্য দিনে বিধানচন্দ্র রায় জমিদারি প্রথা বিলোপের বিল বিধানসভায় এনে বঙ্গদেশে ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লব’-এর কথা ঘোষণা করেছিলেন, সংবাদপত্রগুলিতে বিশেষ ভূমিসংস্কার ক্রোড়পত্র বার হয়। লৌকিক ব্রত ও শাস্ত্রীয় বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পয়লা বৈশাখ নামে সামাজিক উৎসব উদ্যাপনের অবয়বে প্রগতিবাদী ভদ্র শহুরে বাঙালির সব চরিত্রলক্ষণই ফুটে ওঠে।
তবুও জল গড়িয়ে চলে, ওপার বাংলার কথা ভুললে চলবে না। পূর্ব পাকিস্তানে মোনায়েম খান ফরমান জারি করেছিলেন, বৈশাখি নববর্ষ পালন বিদাতি গুনাহ্, তারই প্রতিবাদে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে পুব বাংলায় বাঙালি বর্ষবরণ জাঁকিয়ে বসল, ঢাকার রমনার বটতলায় ছায়ানট সকালে রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান করত। বাঙালি আত্মসত্তার বৈশাখি দাবি। ১৯৭২ সালে ‘সোনার বাংলা’য় পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ২০০১ সালে ওই অনুষ্ঠানেই বিস্ফোরণ হয়, দশ জন মারা যান, শতাধিক দর্শক আহত হন। রক্তাক্ত বাঙালি নববর্ষ শহিদের মর্যাদা পায়।
বাঙালির আপন নববর্ষ তো বেশ পরিপক্ব হল, তবে কার্যক্রমটা কী? শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো এক সময়কার নিম্নবিত্ত বাঙালির কাছে বছরের ওই দিন ছিল খাই-খাই’এর। তাঁর বড়দাদা চাকরি পেলে পর ওই দিনই তাঁরা নানা সাধের পদ বাজার করে রান্না করতেন। বাঙালির হেঁশেলে হালখাতার বৈকালিক জলযোগ রূপান্তরিত হত ও এখন আরও বেশি করে হয়ে থাকে বাংলার ‘এথনিক’ পারিবারিক মধ্যাহ্নভোজে, একেবারে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। পয়সাওয়ালাদের কেনাকাটা তো আছেই, বর্ষবরণের মুখ ঢেকে যায় রকমারি পণ্যের বিজ্ঞাপনে।
এ বার নাকি বিষম বিপদ। ২৮ মার্চ ভারতীয় সংসদ এই প্রথম বার হিন্দু সম্রাট কোনও এক বিক্রমাদিত্যের প্রবর্তিত বিক্রমাব্দ পালন করেছে, দিল্লিতে সরকারি নববর্ষের বেশ খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতি বড়ই সহিষ্ণু, নিউ ইয়ার ও বাঙালি নববর্ষের পাশাপাশি একটি সরকারি নববর্ষও থাকতেই পারে, আমাদের ছুটি পেলেই হল। এখনকার ক্যালেন্ডারে গ্লোবাল ন্যাশনাল ও লোকাল— সব বর্ষবরণ উৎসবের জন্যই লাল খুপরির দিন থাকা দরকার, আমাদের মানাতে অসুবিধে হবে না।
ছবি: সুব্রত চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy