বৃদ্ধ সোফোক্লিস প্রেমে তখন হাবুডুবু। বিবাহ-বহির্ভূত সেই সম্পর্কে ছেলেও হয়েছে এক। সেই ঘটনার জেরে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ নিয়ে চিন্তায় পড়লেন তাঁর বৈধ পুত্র। বাবার মানসিক স্থিতি নেই, সমাজে এমনই ঘোষণা করে দিলেন তিনি। অভিযোগ গড়াল আদালতে। বৃদ্ধ নাট্যকার সওয়াল-জবাবে যেতে নারাজ। কোনও বিরক্তি প্রকাশ না করেই, বিচারপতির দরবারে গড়গড় করে আওড়ালেন নিজের লেখা সাম্প্রতিক নাটকটি। সত্যাসত্য প্রমাণের আর অবকাশ থাকে কি?
প্রাচীন গ্রিক সমাজে নাটকই ছিল শেষ কথা। তার সামনে মহামান্য আদালতই বা কী!
নাটক শুধু শিল্প নয়। প্রাচীন গ্রিসের থিয়েটার প্রতিযোগিতা ঘিরে তা হয়ে উঠেছিল রীতিমতো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মান-সম্মানের ধারক ও বাহক। কে কত বার জিতলেন সেই লড়াইয়ে, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করত নাট্যকার হিসেবে তাঁর সামাজিক পরিচিতি। শোনা যায়, সোফোক্লিস একাই ১৮ বার জয়ী হয়েছেন এই লড়াইয়ে। এ দিকে, সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাবুক ছেলে ইউরিপিডিস ছিলেন সব বিদ্যাতেই পারদর্শী। সে কালের গুণিজনেরা রীতিমতো মানতেন তাঁকে। কিন্তু তা বললে কী হবে, যত দিন না জয় আসে অলিম্পাস পর্বত বেয়ে, তত দিন যে সব কিছুই বৃথা। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১১ সালে প্রথম জয় এল ইউরিপিডিসের।
তিনমূর্তি: ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস ও ইউরিপিডিস
নাটকের ইতিহাসে ওই সালটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঠিক তার আগের বছরই মৃত্যু হয়েছে আর এক ট্র্যাজেডি-বীর ইস্কাইলাসের। এর পরে আরও চার বার জিতেছিলেন ইউরিপিডিস। কিন্তু প্রথম জয়ের আগে পর্যন্ত পারিবারিক হেনস্থাও কম হয়নি এই স্বনামধন্য নাট্যকারের।
মাউন্ট অলিম্পাস। গ্রিসের সর্বোচ্চ পর্বত। সেই পাহাড়ের উপরেই জমত আসর। বছরের পর বছর। সংস্কৃতি, সুরা ও প্রজননের দেবতা ডায়োনিসাসের আরাধনা ঘিরে উৎসব, ‘ডায়োনিসিয়া’। শুনে মনে হতেই পারে, হই-হুল্লোড় আর সমবেত সুরাপানেই সীমিত থাকত আসর। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক সমাজ ছিল তার চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। হাজার পনেরো দর্শকের উপস্থিতিতে জমে উঠত নাটকের আসর। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক। সেই উৎসবই আধুনিক সমাজের রকমারি বিনোদন চর্চার উৎস।
কী থাকত সেই লাইভ বিনোদনে? যুদ্ধপ্রিয় আথেনীয় সমাজে বিনোদনের রসদও ছিল লড়াই। প্রতি বছর গ্রিসের রাজধানী শহর আথেন্সে এই নাট্য-যুদ্ধ ঘিরে কত যে হইচই চলত! আর হবে না-ই বা কেন? কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রতিযোগিতা বিনোদনের গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিল সামাজিক উত্থান-পতনের অন্যতম নিরীক্ষক। কে কত বড় নাট্যকার, তার বিচার হত ডায়োনিসিয়ায় হারজিতের উপরেই। এক-এক বছর সেই প্রতিযোগিতার মুখ চেয়েই রচিত হত অন্তত ১২০০-১৫০০ ট্র্যাজেডি। সঙ্গে তৈরি হত আরও শ’পাঁচেক কমেডি এবং স্যাটায়ার-ধর্মী নাটক।
তবে ডায়োনিসিয়াকে শুধু নাটকের প্রতিযোগিতা বললে তার মান খানিকটা কমে যায় বটে। প্রতিযোগিতা ছিল ট্র্যাজেডির। কে কত বড় ট্র্যাজেডি লেখক, তা-ই দেখতেন বিচারকেরা। কারণ নাটকেরও ছিল গুণমানগত নানা রকম ভাগাভাগি। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্য সমালোচক হিসেবে পরিচিত অ্যারিস্টটলের হিসেবে, সবচেয়ে উন্নত ও উৎকৃষ্ট নাটক হল ট্র্যাজেডি। সমাজের ‘অতি উন্নত’ স্তরের কিছু চরিত্রের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচরণের পরিণামও কত কঠিন হতে পারে, তা নিয়েই নাটক। তবে শুধু ট্র্যাজেডি লিখেই জয়ী হওয়া যেত না সেই প্রতিযোগিতায়। দুঃখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নম্বর কাড়ত হাসি! তিন দিন ধরে চলা সেই নাট্য-যুদ্ধে এক-এক জন নাট্যকার পেশ করতেন তিনটি ট্র্যাজেডির সঙ্গে একটি স্যাটায়ার। জনা দশেক বিচারক তিন দিনের শেষে, বারোটি নাটক দেখে এবং দর্শকের মন বুঝে ঘোষণা করতেন সে বছরের সেরার নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৪ সালে প্রথম বারের প্রতিযোগিতায় যেমন শ্রেষ্ঠ সম্মান পেয়েছিলেন থেসপিস। তাঁরই গানে গানে জন্ম ট্র্যাজেডি নামক এই নাট্যধারার। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকেই উঠে এসেছে ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিডিসের মতো বিশিষ্ট সব নাম।
এ তো গেল ফাইনাল রাউন্ডের কথা। তার ছ’মাস আগেই সারা হত বাছাই পর্ব। নাম লেখাতে আসতেন অন্তত কয়েকশো নাট্যকার। তাঁদের মধ্যে থেকে কয়েক দফায় বাছা হত, সে বছরের ‘জগৎ-সভায়’ কার কার প্রতিভা প্রদর্শনের সৌভাগ্য হবে। কারণ, জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রাচীন গ্রিসের ‘অ্যাথলেটিক্স’ প্রতিযোগিতার পরেই ছিল এই ট্র্যাজেডি-যুদ্ধের স্থান। তত দিনে অবশ্য শতাব্দী পেরিয়েছে এই নাটক প্রতিযোগিতা। কমেডিও বেশ খানিকটা সম্মান অর্জন করেছে নাট্যধারা হিসেবে। শুরু হয়ে গিয়েছে কমেডির জন্য আলাদা একটি প্রতিযোগিতাও।
অ্যারিস্টটলের মতে, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি হিসেবে পরিচিত ‘রাজা ইদিপাস’ নাটকটি মোটেই প্রথম স্থান পায়নি ট্র্যাজেডির এই মহাযুদ্ধে। বরং সে বছর দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন সোফোক্লিস।
যুদ্ধ-জর্জরিত প্রাচীন গ্রিসে সংস্কৃতি চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা-ও বোঝা যায় এই নাটকের প্রতিযোগিতা ঘিরে তাদের ভাবনার টুকরো টুকরো নিদর্শন থেকে। যে বছর গ্রিকরা যুদ্ধে হেরে গেল পারসিকদের কাছে, ধ্বংস হয়ে গেল তাদের সাধের শহর আথেন্সের নানা চত্বর, ঠিক সেই বছর থেকেই আরও যেন নতুন করে ফুলেফেঁপে ওঠে এই নাটকের লড়াই। সালটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০। ধ্বংসের পরে নতুন করে গড়া হল আথেন্স। ঘর-বাড়ি থেকে নাটকের মঞ্চ, অ্যাম্ফিথিয়েটার— এ সময়ে নতুন রূপ পায়।
গ্রিক নাটকের ক্ষেত্রেও এটি স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত। যদিও তত দিনে শতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে ট্র্যাজেডি। কমেডি বা স্যাটায়ারধর্মী নাটকও রীতিমতো প্রচলিত। তখনই তিন গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিস, ইউরিপিডিস এবং ইস্কাইলাসের জন্ম। অবশ্য তাঁদের পরিচিতির কারণ শুধুই নাট্যগুণ নয়। গ্রিক সমাজে লেখার অনীহাও এর এক বড় কারণ। সাচ্চা গ্রিক মানুষের কাছে মুখের কথাই ছিল সব। সেটিই আসল। এক বার অভিনীত হয়ে গেলে সেই ট্র্যাজেডি বা কমেডি ফের কোথাও মঞ্চস্থ করার নিয়ম ছিল না আথেন্সে। অর্থাৎ, নাটক সংরক্ষণে আদৌ জোর দেওয়ার চল ছিল না তখন।
ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কয়েক শত বছর ধরে ডায়োনিসিয়া উৎসবে কয়েক হাজার নাট্যকারের লেখার কোনও পাণ্ডুলিপিই নেই। হাতে গোনা গুটিকয়েক যে নাটক রয়ে গিয়েছে, তা পাওয়া যায় মূলত আথেনীয় সমাজের চরম শত্রু স্পার্টার বাড়বাড়ন্তের ফলেই। পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধে হারের পরে যখন আথেনীয় রীতি-রেওয়াজ ভগ্নপ্রায়, তখন অভিনয় শুরু হয় পুরনো কিছু নাটকের। স্পার্টার প্রভাবাচ্ছন্ন গ্রিসের ‘হেলেনিস্টিক’ সমাজই সাহিত্য সংরক্ষণের কাজ শুরু করে।
তাই বেঁচে গিয়েছে গ্রিক নাটকের স্বর্ণযুগের খানকয়েক কালজয়ী সৃষ্টি। এক-এক শতকের বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকারের নাম পাওয়া গেলেও, খুব কম সংখ্যক ট্র্যাজেডিই গোটাটা পাওয়া যায় এখন। তবু যা পাওয়া যায়, তার সুবাদে নাটকের আসরে এখনও ফিরে আসেন ইস্কাইলাস, সোফোক্লিস, ইউরিপিডিসেরা। সেই সঙ্গেই ফিরে আসে তাঁদের সময়ের নাটক-নাটক যুদ্ধ ও তার নানা গল্প!