Advertisement
০৩ মে ২০২৪

হাসপাতালের গল্প

চেনা গল্প। কী ভাবে প্রবল ডামাডোলের মধ্যে সন্তানের সামনে মা মারা গেলেন চিকিৎসা না পেয়ে। হাসির কাহিনিও বলা যায়।ট্রে ন থেকে নেমে সোজা হাসপাতালে পৌঁছলাম। মা অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্যালাইনের বোতল বেডের পাশে। বিষ্ণুপুর থেকে ভাই আগেই এসেছে। সে বলল, ‘ঘুমের ইঞ্জেকশন স্যালাইনের মধ্যে যাচ্ছে। এক জন সিনিয়র ডাক্তার দেখে গেছেন। তিনি সিটি স্ক্যান করাতে বলেছিলেন। হাসপাতালের মেশিন খারাপ, তাই অ্যাম্বুলেন্স করে এই অবস্থায় এক প্রাইভেট সেন্টার থেকে করিয়ে নিয়ে এসেছি।

সুদর্শন নন্দী
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:৩২
Share: Save:

ট্রে ন থেকে নেমে সোজা হাসপাতালে পৌঁছলাম। মা অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্যালাইনের বোতল বেডের পাশে। বিষ্ণুপুর থেকে ভাই আগেই এসেছে। সে বলল, ‘ঘুমের ইঞ্জেকশন স্যালাইনের মধ্যে যাচ্ছে। এক জন সিনিয়র ডাক্তার দেখে গেছেন। তিনি সিটি স্ক্যান করাতে বলেছিলেন। হাসপাতালের মেশিন খারাপ, তাই অ্যাম্বুলেন্স করে এই অবস্থায় এক প্রাইভেট সেন্টার থেকে করিয়ে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ আর ওই সিনিয়র ডাক্তার আসবেন না শুনলাম।’ এমন সময় হঠাৎ দেখি এক আয়া মায়ের ক্যাথিটারের নল খুলে একটা শিশিতে ইউরিনের স্যাম্পল নিল। মনটা খচখচ করতে ওয়ার্ডের নার্সকে জিজ্ঞেস করি, ন’নম্বর পেশেন্টের ইউরিন নিলেন, ডাক্তারবাবু কি বলে গেছেন? নার্স দিদিমণি বিরক্ত হলেন খুব। মেজাজ চড়িয়ে বললেন, এ সব ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না? বললাম, ডাক্তার তো সকাল থেকে আসেননি। দিদিমণি এ বার নিদান দিলেন, তবে সুপারকে গিয়ে কমপ্লেন করুন। খানিক পর একটু নরম হলেন। বললেন, ইউরিন ইনফেকশন থেকেও জ্বর আসতে পারে, সেই জন্যই তো ইউরিন নিয়ে গেছে। আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলি, আমার মায়ের জ্বর কোথায়, দু’দিন তো অজ্ঞান হয়ে বেহুঁশ! হুঁশ ফেরে এ বার দিদিমণির। জানতে চাইলেন, কত নম্বর পেশেন্ট? বললাম, পেয়িং ন’ নম্বর। এ বার দিদিমণি দুটো প্রেসক্রিপশন খুলে দেখে, চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘এই, কত নম্বর পেশেন্টের ইউরিন দিয়ে এলি?’ ‘তুমিই তো বললে ন’নম্বর!’ আয়ার কর্কশ জবাব। ‘নয় বললাম না ছয়? কানের মাথা খেয়েছিস?’ আমার ভুল ধরানোতে সেই স্যাম্প‌ল ফেরত এল। আমি না বললে আমার মায়ের ইউরিনের রিপোর্ট দিয়ে অন্য রোগীর চিকিৎসা চলত।

ভাইকে বললাম, এখনই নার্সিং হোমে নিয়ে যাব। ক’দিন আগে আমার এক বন্ধুর মা প্রায় একই অবস্থা হয়ে মারা যান। বন্ধুটিকে লাগালাম ফোন। সে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গন্ডা চারেক গালাগালি দিল নার্সিং হোমকে। বলল, মরতে হলে হাসপাতালই ভাল। মা’কে নার্সিং হোমে না নিয়ে গেলে, আর কিছু দিন বাঁচত। কী করি? ইতিমধ্যে কয়েক জন চেঁচিয়ে উঠলেন— ওই এসেছেন, ওই এসেছেন। তাকিয়ে দেখি ডাক্তার এসেছেন। সবাই যে যার রোগীর বেডের পাশে চলে গেলাম। মেডিকাল কলেজের হাসপাতালে চিকিৎসার মান নিয়ে ঘাটতি থাকলেও, ডাক্তারের অন্তত ঘাটতি নেই। কারণ, সব পড়ুয়াই ডাক্তার। কেউ আট আনার, কেউ বারো আনার, আবার কেউ ষোলো আনার— মানে পুরো পাশ করা ডাক্তার। হাসপাতালের ভিড়ে এঁদের চেনা মুশকিল হত, যদি না গলায় পৈতের মতো স্টেথো থাকত। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছি, অথচ ওই ডাক্তারবাবু গোটা চার অন্য রোগী দেখে চলে গেলেন। সে বেলা আর ডাক্তারের দেখা পেলাম না।

আলাপ করতে করতে এক রোগীর আত্মীয় বললেন, আগের ওই সিনিয়র ডাক্তার চার দিন আসবেন না। কারণ, কলকাতা থেকে তিন-চার ঘণ্টার ট্রেনের রাস্তা ঠেলে যে ডাক্তাররা দূরের শহরে পোস্টিং-এ আছেন, তাঁরা পয়লা জানুয়ারিই সারা বছরের ছুটির রুটিন বানিয়ে টাঙিয়ে রাখেন ড্রয়িং রুমে। তাতে রবিবারের আগে-পরে ছুটি থাকলে, আগে পালানো আর দেরিতে আসা মিলিয়ে তার সঙ্গে একটি সি-এল যোগে দিন চার ডাক্তারবাবুকে হাসপাতালে দেখা যাবে না। আমি হিসেব করলাম, এ হপ্তায় রবির সঙ্গে জন্মাষ্টমী প্লাস সি-এল নিয়ে হিসেবটা এই ফর্মুলায় দাঁড়ায়। সিনিয়র ডাক্তারের আশা ছাড়লাম।

পরের দিন মা’কে ডাকতে মা চোখ খুলল। নিজেকে ধিক্কার দিলাম। শুধু শুধু হাসপাতালের বদনাম করছিলাম। পেয়িং বেড ওয়ার্ডে গোটা দশেক ফিমেল রোগী। আত্মীয়স্বজন মিলে একটা শেষ বেলার গাজনের চেহারা। ভাবলাম বাইরে একটু দাঁড়াই, ডাক্তার এলেই ঢুকব। দাঁড়িয়েছি, এক যুবক দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, এ দিকে ডাক্তারবাবুকে যেতে দেখলেন?’ আমি বলি, ‘আমিও তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি ভাই। কেন, পেশেন্ট সিরিয়াস বুঝি?’ ‘দাদা, আমার পেশেন্ট তিন দিন ধরে অজ্ঞান। এইমাত্র এক ছোট ডাক্তার ক’টা বড়ি লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু অজ্ঞান রোগীকে বড়ি খাওয়াব কী করে বলুন দিকি?’ ‘তা দিদিমণিকে বলুন!’ দিদিমণি বললেন, ‘আমরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের উপর কিচ্ছু বলব না। আপনি চাইলে বড়িটাকে চেঞ্জ করিয়ে আনুন। এর ইঞ্জেকশন লিখে আনলে সেলাইনের সঙ্গে দিয়ে দেব।’ শুনেই ছেলেটি উদ্‌ভ্রান্তের মতো নিরুদ্দিষ্ট ডাক্তারের সন্ধানে দৌড়ল। ঠিক এমন সময় এক ছোট ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে আমার ওয়ার্ডে ঢুকলেন। আমি মায়ের বেডের কাছে চলে গেলাম। দেখে মনে হল, ষোলো আনার ডাক্তার। মায়ের কাগজপত্র উলটে দেখতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যর, রোগটা কী, জানা গেল? মানে, সিটি স্ক্যানে সে রকম কিছু পাওয়া গেছে?’ তিনি সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে বললেন, ‘ভাল নয়।’ আমি বলি, ‘স্যর, সে রকম কোনও চিকিৎসা নেই? শুধু দু’দিন ধরে স্যালাইন আর ঘুমের ওষুধই তো চলছে, তাই...’ তার পরেই বললাম, ‘স্যর, মায়ের কিন্তু হাই সুগার। দিনে গোটা চারেক ওষুধ খেতেন। এখন তো সে সব বন্ধ হয়ে গেছে, কোনও অসুবিধা...’ ডাক্তারবাবু এ বার একটা গ্লুকোমিটার যন্ত্র এনে রক্তটা টেস্ট করলেন, বললেন, ‘ইনসুলিন লাগবে আট ইউনিট করে তিন বার।’ এ ছাড়া আরও দুটো দামি ইঞ্জেকশন দিয়ে বললেন, ‘এগুলো চলবে। ফিজিয়োথেরাপিস্ট দেখিয়ে নেবেন কাল।’

পরের দিন ফিজিয়োথেরাপিস্টের ফি জমা দিয়ে এলাম। ঘণ্টা দুই পরে তিনি এলেন। মা’কে দেখে বললেন, ‘রোগী তো অজ্ঞান হয়ে আছে, একে আমি কী এক্সারসাইজ দেখাব?’ তার পর কী ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি দেখে নিন, পরে দরকার পড়লে করাবেন।’ বলেই তিনি মায়ের পা দুটো তুলে টিউবওয়েলের জল পাম্প করার মতো উপর-নীচ করলেন। দেখালেন হাতের ব্যায়ামও। মা এক বার চোখ খুললেন। যন্ত্রণায় নাকি কে জানে! ফিজিয়োথেরাপিস্ট বললেন, ‘গুড সাইন, ভয়ের কিছু নেই।’

পরের দিন সকালবেলাতেই ডাক্তার হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। কিন্তু এ যে অন্য ডাক্তার! মায়ের কাগজগুলো দেখলেন। তার পর বললেন, ‘এ অবস্থায় আবার ইনসুলিন কেন?’ এমন ভাবে বললেন, যেন ওটা আমিই প্রেসক্রাইব করেছি। তিনি বললেন, ইনসুলিন দরকার নেই। আমি কিছু বলব, তার আগেই জবাব এল, ‘সব লিখে দিয়েছি, অপেক্ষা করুন।’ ভাবলাম, বাপ রে, এখনও রোগটাই জানতে পারলাম না পাঁচ রকম ডাক্তারের হাতে পড়ে।

মায়ের গায়ে হাত বোলাতে লাগলাম। মা প্রায়ই বলতেন হাঁটুটা একটু মালিশ করে দিতে। ব়ড্ড যন্ত্রণা। হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত মালিশ করতে লাগলাম। কী চেহারা হয়েছে মায়ের! শুধু মনে হচ্ছে, আমি থাকলে সোজা কলকাতা নিয়ে যেতে পারতাম। বউ একা ঝক্কি সামলাতে পারবে না বলেই কাছের হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছিলাম। এখানে ভর্তি করতে বলে ভুল করলাম না তো? মনটা কুরে কুরে উঠল।

সে দিন একশো চার জ্বরে কাটল মায়ের। রাত্রে আর এক ডাক্তার এলেন। এ কী রকম চিকিৎসা, বুঝতে পারলাম না। দিনে দু’বার ডাক্তার আর ওষুধ চেঞ্জ হলে রোগী ভাল হবে কী করে? ভাবলাম, কাল সুপারের কাছে যাব। বলব, কোনও সিনিয়র ডাক্তার যেন দেখেন।

না, পরের দিন আর সুপারের কাছে যেতে হয়নি। সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, মা আমাদের ছেড়ে চলেই গেছেন। কেন মারা গেলেন, কখন মারা গেলেন, কী রোগে মারা গেলেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না। একটু সামলে কঠিন ঝামেলা পেরিয়ে মায়ের ভুল নাম সংশোধন করিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট নিলাম ওয়ার্ড মাস্টারের অফিসে। তার পর গাড়ি ভাড়া করে মা’কে নিয়ে রওনা হলাম জন্মভিটের দিকে।

sudarsan_nandi@yahoo.co.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hospital sudarshan nandi doctor medicine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE