Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ বার ফিরিয়ে আনা হোক নেতাজির চিতাভস্ম, আর্জি কন্যা অনিতার

সুভাষচন্দ্রের কন্যা অনিতা সেটাই চান। তবু, সেই ভস্মাধার আজও টোকিয়োর রেনকোজি মন্দিরে। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লালকেল্লায় ভাষণ দিলেই চলবে না। এই কাজের কাজটি অবিলম্বে করতে হবে।সুভাষচন্দ্রের কন্যা অনিতা সেটাই চান। তবু, সেই ভস্মাধার আজও টোকিয়োর রেনকোজি মন্দিরে। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লালকেল্লায় ভাষণ দিলেই চলবে না। এই কাজের কাজটি অবিলম্বে করতে হবে।

রণসাজ: সামরিক পোশাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

রণসাজ: সামরিক পোশাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু

দেবব্রত ঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২৭
Share: Save:

দৃশ্য ১: ২টো ৩৫ মিনিট নাগাদ বিমানটি উড়ল। এয়ারফিল্ডের মধ্যেই তখনও রয়েছে। সেই সময়েই বিকট আওয়াজ, মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল বিমান। সামনে, পিছনে তখন আগুন। পাইলটের পিছনে এক জাপানি অফিসার। তাঁর ঠিক পিছনেই, বাঁ দিকে বসেছিলেন তিনি। ঠিক ডান দিকে প্লেনের জ্বালানি ট্যাঙ্ক। আমি বসেছিলাম ঠিক তাঁর পিছনে। প্লেন মাটিতে আছড়ে পড়ার পর আগুনের মধ্যে দিয়ে তিনি বাইরে বেরোলেন। পিছনে আমি। দেখলাম, তাঁর সারা শরীরে আগুন। দ্রুত এগিয়ে গেলাম তাঁর পোশাক খুলতে। কিন্তু যতক্ষণে পোশাক খোলা হল, ততক্ষণে শরীর আগুনে ঝলসে গিয়েছে। মাথাতেও আঘাত। ট্যাঙ্ক ফেটে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল পোশাকে। আমারও মুখ, শরীর ঝলসে গিয়েছে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হল।

এই বিমান দুর্ঘটনার বিবরণ যাঁর, তাঁর নাম কর্নেল হবিবুর রহমান। তারিখ ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট। স্থান তাইহোকু (অধুনা তাইপেই)। ঘটনার ছ’দিন পর জাপানি মিলিটারি হাসপাতালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছায়াসঙ্গী কর্নেল হবিবুর রহমান সে দিনের ঘটনা এ ভাবেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

দুর্ঘটনার ন’দিন পর ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড আর্চিবল্ড ওয়াভেল তাঁর মন্ত্রিসভাকে জানান, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্রশক্তির কম্যান্ডার অ্যাডমিরাল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনকে তিনি এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মাউন্টব্যাটেন ‘ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক’-এর ভারপ্রাপ্ত আমেরিকান জেনারেল, ডগলাস ম্যাকআর্থারকে বিষয়টি নিয়ে জাপান সরকারের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেন। ৩০ অগস্ট ম্যাকআর্থার জাপান সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট চান। উল্লেখ্য, মার্কিন বাহিনীর কাছেই ১৫ অগস্ট আত্মসমর্পণ করে জাপান।

১৫ সেপ্টেম্বর ম্যাকআর্থারকে পাঠানো অন্তর্বর্তী রিপোর্টে জাপান সরকার লিখছে, জ্বালানি ভরার পর ৯৭-২ জাপানি বম্বার বিমানটি ওড়ে। কিন্তু বিশ-ত্রিশ মিটার মতো উচ্চতায় ওঠার পরেই ভেঙে পড়ে বাঁ দিকের প্রপেলার, ইঞ্জিনটিও। ভারসাম্য হারিয়ে ডান ও বাঁ দিকে ঝাঁকুনি খেতে খেতে বিমানটি এয়ারফিল্ডের প্রান্তে একটি মাটির ঢিবির উপর ভেঙে পড়ে। বিমানে আগুন ধরে যায়। গ্যাসোলিনে পুরো ভিজে বোস বেরিয়ে আসেন বিমানের বাঁ দিক দিয়ে। তিনি তখন আগুনের গ্রাসে। পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসেন তাঁর সঙ্গী এইচ আর। তিনি বোসের আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকেন। যদিও বোস তখনই সাংঘাতিকভাবে অগ্নিদগ্ধ। ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যেই তাঁকে তাইহোকুর সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বিমানের তিন ইঞ্জিনিয়ার, ওয়্যারলেস অপারেটর, বিমানের ক্যাপ্টেন মেজর তাকিজাওয়া ও কো-পাইলটের আসনে বসা জাপানি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল শিদেইয়ের। সে দিনের বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কার্যত এই একই জবানবন্দি বিমানের বেঁচে যাওয়া সাত যাত্রীর। এঁরা প্রত্যেকেই জাপানি সেনাবাহিনীর অফিসার— লে: কর্নেল তাদেও সাকাই, লে: কর্ণেল শিরো নোনোগাকি, ক্যাপ্টেন কেইকিচি আরাই, কোনো, তাকাহাসি, ওকিস্তা এবং নেতাজির ছায়াসঙ্গী হবিবুর রহমান। ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন নাকামুরা এয়ারফিল্ডে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

দৃশ্য ২: তাইহোকুর সেই মিলিটারি হাসপাতাল। দুর্ঘটনার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে ‘চন্দ্র বোস’কে এই হাসপাতালেই নিয়ে আসা হয়। তাইহোকু সাউথ গেট মিলিটারি হাসপাতালের মেডিক্যাল ওয়ার্ডে তখন ডিউটিতে ছিলেন নার্স শান পি শা। ফ্রি প্রেস জার্নাল-এর সাংবাদিক হারিন শাহ ঘটনার এক বছরের মধ্যেই নেতাজি মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে তাইহোকুতে হাজির হন। তিনি সিস্টার শানের সঙ্গে দেখা করেন। ঘটনার দিন ডিউটিতে থাকা আর এক জন নার্স চু চৌ সু’ও সেখানে হাজির ছিলেন। হারিন শাহের বক্তব্য অনুযায়ী প্রায় দু’ঘণ্টা তাঁদের মধ্যে কথা হয়। সিস্টার শান হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে ‘চন্দ্র বোসের মৃত্যু হয়’ সেখানে তাঁকে নিয়ে যান। দেখান এক কোণের সেই ‘বেড’-ও।

সিস্টার শান-এর সে দিনের বর্ণনা এই রকম: ‘‘তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ডাক্তারের নির্দেশে চন্দ্র বোসের সারা গায়ে অলিভ অয়েল আমিই মাখিয়েছিলাম। রাত ন’টা নাগাদ তাঁর মৃত্যু হয়। তার আগে তাঁর চিকিৎসায় আমি সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলাম। তিনি মাঝে মাঝেই জল খেতে চেয়েছিলেন। আমিই তাঁকে অল্প অল্প করে জল খাইয়ে গিয়েছিলাম।’’

সেই সময় হাসপাতালের চিফ মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন (ডা.) তানেওশি য়োশিমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর য়োশিমিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বন্দি করে। হংকংয়ের স্ট্যানলি জেলে তাঁকে জেরা করেন ক্যাপ্টেন আলফ্রেড টার্নার। ১৯৪৬ সালের ১৯ অক্টোবরের ওই জবানবন্দিতে য়োশিমি বলেন: বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসার পর এক জাপানি সেনা অফিসার তাঁকে বলেন, উনি চন্দ্র বোস। চিকিৎসায় যেন কোনও গাফিলতি না হয়। তাঁকে যখন বেডে শোয়ানো হল, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর শরীরের ক্ষত তেল দিয়ে পরিষ্কার করি। ড্রেসিং করি। তাঁর সারা শরীর সাংঘাতিক ভাবে পুড়ে গিয়েছিল। তবে খুব খারাপ অবস্থা ছিল তাঁর বুক, মাথা ও দুই ঊরুর। প্রথম চার ঘণ্টা তিনি আধো জ্ঞানে ছিলেন। প্রায় স্বাভাবিক ভাবে অনেক কথাও বলছিলেন।

ডা. য়োশিমির বয়ান অনুযায়ী: প্রথম শব্দটি তিনি জাপানিতেই বলেছিলেন। জল চেয়েছিলেন। চামচে করে তাঁকে জল খাওয়ানো হয়। বেশির ভাগ কথাই তিনি ইংরেজিতে বলছিলেন। সে কারণে আমি দোভাষী চাই। তাইহোকু সিভিল গভর্নমেন্ট অফিস থেকে পাঠানো হয় জুইচি নাকামুরাকে। তিনি আমায় বলেন, বহু বার তিনি চন্দ্র বোসের হয়ে জাপানি সেনা অফিসারদের সঙ্গে দোভাষীর কাজ করেছেন। তিনি যে চন্দ্র বোসের সঙ্গেই কথা বলছেন এ ব্যাপারে তাঁর কোনও সন্দেহই ছিল না। তাঁর কোনও যন্ত্রণা হচ্ছে কি না জানতে চাই। দু’বারই তিনি চুপ করে ছিলেন। চিকিৎসা চলাকালীনই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি কোনও বার্তা বা বিবৃতি দিতে চান কি না। তিনি ‘না’ই বলেন। ঘণ্টা চারেক পর থেকে তাঁর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ক্রমশ কোমায় চলে যান। জ্ঞান আর ফেরেনি। রাত এগারোটা নাগাদ তিনি মারা যান।

সিস্টার শান-এর কথায়, তিনি মারা যাওয়ার পর মৃতদেহ হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে ‘ডিভাইন শ্রাইন’-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় চন্দ্র বোসকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ডা. য়োশিমি অধস্তন সেনা অফিসারদের নির্দেশ দেন।
১৯৫৬ সাল। ভারত তখন স্বাধীন। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। সে বছর জানুয়ারিতে ‘স্বাধীন’ জাপান সরকার ভারত সরকারের হাতে তাদের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট তুলে দেয়। ডা. য়োশিমি, তাঁর সহকারি চিকিৎসক ডা. সুরুতা ছাড়াও জাপানি সেনাবাহিনীর ১১ জন অফিসারের প্রত্যক্ষ জবানবন্দির ভিত্তিতে তৈরি এই রিপোর্ট যখন ভারত সরকারের হাতে আসে, তখনও মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তৈরি হয়নি। জাপান সরকারের সেই রিপোর্টেও কার্যত এই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করা হয়।
দৃশ্য ৩: ঘটনার দিন ছয়েক পরে কর্নেল হবিবুর রহমানের সেই লেখায় তিনি লিখছেন: তাঁর দেহ টোকিয়ো বা সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য জাপানি সেনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম। প্রথম পছন্দ ছিল সিঙ্গাপুর। তাঁরা সব ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় কফিন ও প্লেনের জন্য তাঁরা সায়গন ও টোকিয়োকে অনুরোধ করেন। কিন্তু ২১ অগস্ট এক সিনিয়র অফিসার হাসপাতালে এসে আমায় জানান, ব্যবস্থা দু’টোরই হয়েছে। কিন্তু কফিনটি ছোট প্লেনে ঢোকানো যাচ্ছে না। তাইহোকুতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। উপায়ান্তর না দেখে আমি রাজি হই।
কফিনে চন্দ্র বোসের দেহ রেখে পাশে রহমানকে বসিয়ে ছবিও তোলা হয়। হবিবুর রহমানের দাবি, সেই ছবি বিভিন্ন তদন্ত কমিটির সামনে বিভিন্ন সময়ে পেশও করা হয়েছে। পর দিন ২২ অগস্ট শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শেষকৃত্যে উপস্থিত জাপানি দোভাষী জুইচি নাকামুরার বর্ণনায়, সামনে ছিলেন কর্নেল রহমান। ঠিক পিছনেই ছিলাম আমি। আমরা ফার্নেসের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে সামরিক শ্রদ্ধা জানালাম।
১৯৫৬। ভারতে তখন নেতাজির মৃত্যু রহস্যে আলোকপাতের দাবিতে নেহরু সরকারের উপর চাপ প্রবল। নয়া তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে ভারতের তখনও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে কথা বলে এ সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু। তাঁর সেই অনুরোধের জেরেই তাইওয়ানের ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল অ্যালবার্ট ফ্র্যাঙ্কলিন তাইওয়ান প্রাদেশিক সরকারকে বোসের মৃত্যু নিয়ে তদন্তের অনুরোধ করেন। ২৭ জুন ১৯৫৬ প্রাদেশিক সরকারের চেয়ারম্যান সি কে ইয়েন ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলকে একটি পুলিশ রিপোর্ট পাঠান। স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায়, সেই রিপোর্টের কপি আসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আর ১৯৫৬-র অগস্টে তিনি তৈরি করেন শাহনওয়াজ কমিটি।
কী আছে তাইওয়ান সরকারের রিপোর্টে? ব্রিটিশ বিদেশ দফতর এ সংক্রান্ত ফাইলটি ‘ডিক্লাসিফাই’ করার পর ফাইল নম্বর ‘এফসি১৮৫২/৬ অফ ১৯৫৬’-এ নথিভুক্ত ইয়েনের রিপোর্টে বলা হচ্ছে: তাইপেইয়ের যাবতীয় সৎকারের ছাড়পত্র বা পারমিট দিতেন তান তি-তি। রিপোর্টে তান তাঁর সাক্ষাৎকারে জানান, দেহ নিয়ে যে জাপানি সেনা অফিসার তাঁর কাছে যান তিনি তানকে বলেন, এটি ‘ইন্ডিয়ান কম্যান্ডার’ বোসের মৃতদেহ। টোকিয়ো যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তান জানান, ওই অফিসারই জাপানি সেনার তরফে জনৈক ‘ইচিরো ওকুরা’-র নামে একটি ডেথ সার্টিফিকেট তানকে দেন। কেন চন্দ্র বোসের মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রে জাপানি সেনা ডেথ সার্টিফিকেট দিল? কেনই বা ইচিরো ওকুরার নামে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হল? প্রাদেশিক সরকারের চেয়ারম্যান ইয়েন ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল ফ্র্যাঙ্কলিনকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনও সেনা কর্তার পরিবারের মানুষজন উপস্থিত না থাকলে তাঁর মৃত্যুতে ডেথ সার্টিফিকেট সেনাবাহিনীই ইস্যু করত। সেই সার্টিফিকেটের জোরেই সৎকারের নির্দেশ দেওয়া হয়। আর নাম গোপন? চন্দ্র বোস ছিলেন আইএনএ-র সুপ্রিম কম্যান্ডার। ১৯৫৬ সালে তাইপেই মিউনিসিপ্যাল হেলথ সেন্টারের ডিরেক্টর কো কেং উয়ান তদন্ত কমিটিকে জানান, বোসের মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ খবর গোপন রাখতেই অন্য নামে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এগারো বছর পর তাইওয়ান পুলিশ শহরের মিউনিসিপ্যাল হেলথ সেন্টারের রেজিস্টারে ইচিরো ওকুরা-র নামও পরীক্ষা করেন।
ফিরে আসা যাক তান তি-তির কথায়। ২২ অগস্ট শেষকৃত্যের প্রসঙ্গে তান তি-তি বলেন, ‘‘সেই জাপানি সেনা অফিসার একটি গাড়িতে ক্রিমেটোরিয়ামে আসেন। সঙ্গে ছিলেন এক ভারতীয়।’’ তাঁর কথায়, জাপানি সেনারা হাসপাতালে ভর্তি থাকলে যেমন সাদা পোশাক পরেন, তেমনই পোশাক পরিহিত সেই ভারতীয়ের পায়ে হাসপাতালের চটি। মুখের একাংশে ছিল ব্যান্ডেজ। লম্বা, স্বাস্থ্যবান সেই শোকার্ত ভারতীয় অবিরত কেঁদেই যাচ্ছিলেন। অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা থেকে স্পষ্ট, এই ভারতীয়ই কর্নেল হবিবুর রহমান। তান তি-তি জানান, তিনি ও লিন সুই মু নামে এক ব্যক্তি কফিনের ডালা খোলেন। তান জানতে পারেন, মৃতদেহটি টোকিয়ো নিয়ে যাওয়ার জন্যই কফিনবন্দি করা হয়েছিল। কিন্তু বিমানে তা ঢোকানো যায়নি বলেই তাইহোকুতে সৎকার করা হচ্ছে।
ঘোর যুদ্ধের মাঝে তাই তাঁর সৎকার হল তাইহোকুতে। তার পর ২৩ অগস্ট সংগ্রহ করা হল চিতাভস্ম। তান তি-তির কথায়, জাপানি সেনা অফিসার ও সেই ভারতীয় চিতাভস্ম সংগ্রহ করতে আসেন। উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালে ফ্রি প্রেস জার্নাল-এর ভারতীয় সাংবাদিক হারিন শাহ দেখা করেছিলেন এই তান তি-তির সঙ্গেও। দশ বছর আগে তাঁকেও এই কথাগুলিই বলেছিলেন তান তি-তি। হবিবুর রহমানের বক্তব্যের সঙ্গেও তাঁর বক্তব্যের সঙ্গতি রয়েছে।
জাপানি সেনাবাহিনীর কর্তাদের কাছে হবিবুর রহমানের আর্জি ছিল, এই চিতাভস্ম টোকিয়োতে নিরাপদে রাখা হোক। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা ভারতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তাঁকে আশ্বস্ত করে জাপানি সেনা। কর্নেল হবিবুর রহমানের কথায়, তাইহোকুতে বেশ কয়েক দিন তাঁকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল। তিনি ছাড়াও এই পর্বে আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট অব ফ্রি ইন্ডিয়া-র সদস্য সুব্বিয়ার আপ্পাদুরাই আইয়ার এবং জাপানের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ-এর রামমূর্তি। দু’টি সংগঠনেরই মাথায় ছিলেন নেতাজি।
১৯৫১-তে লেখা আইয়ারের ‘আনটু হিম আ উইটনেস: দ্য স্টোরি অব নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ইন ইস্ট এশিয়া’ বইয়ে তিনি লিখেছেন: সায়গন থেকে তাঁকে টোকিয়োতে নিয়ে আসে জাপানি সেনা। রামমূর্তি টোকিয়োতেই থাকতেন। তাঁদের টোকিয়োর সেনা সদর ইম্পিরিয়াল জেনারেল হেডকোর্য়ার্টার্সে ডেকে আনা হয় ৮ সেপ্টেম্বর। সেখানেই ‘কর্নেল সি’ (ওই নামেই জাপানি অফিসারকে উল্লেখ করা হয়েছে) তাঁদের জানান, তাইহোকু থেকে চন্দ্র বোসের সহযোগী কর্নেল হবিবুর রহমান টোকিয়ো পৌঁছেছেন, নেতাজির চিতাভস্ম নিয়েই। সেই চিতাভস্ম আয়ার ও রামমূর্তির হাতেই আপাতত তুলে দেওয়া হবে। এর পরে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের সদরে অপেক্ষারত একটি গাড়ির সামনে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। ‘‘কর্নেল সি আরও ক’জনের সঙ্গে ভস্মাধারটি নিয়ে গাড়ির কাছে এলেন। আমার গলায় প্রথমে একটি সাদা কাপড় ফাঁস দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। সেই কাপড়ের মধ্যেই রাখা হল ভস্মাধারটি। আমি দু’হাত দিয়ে সেটি ধরে গাড়িতে উঠে বসলাম। এসে পৌঁছলাম রামমূর্তির বাড়িতে। শ্রীমতী রামমূর্তি খুব দ্রত ঘরটি সাজিয়ে ফেললেন। উঁচু টেবিলের উপরে ভস্মাধার রাখা হল। দু’পাশে জ্বলছে ধূপকাঠি। সামনে রাখা হল ফুলের গুচ্ছ। ভস্মাধারটির উপরে আমরা নেতাজির একটি ছোট ছবি রাখলাম। ঘরে উপস্থিত শ্রীমতী রামমূর্তির বোনেরা, রামমূর্তির ভাই জয় এবং আমি, সবাই সামনে নতজানু হয়ে বসে প্রার্থনা করলাম।’’
আইয়ার লিখছেন, ‘‘সেখান থেকে সহকর্মী মন্ত্রী আনন্দ সহায়ের বাড়িতে গেলাম। এখানেই আমি থাকছিলাম। আনন্দ সহায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোথাও কাজে ছিলেন। শ্রীমতী সহায় ও আয়ার সেখানেই কর্নেল হবিবুর রহমানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। গভীর রাতে হবিবুর এলেন। হবিবুর বললেন, অবশেষে অপেক্ষার শেষ হল। হঠাৎই আমাকে জানানো হল, একটি অ্যাম্বুল্যান্স প্লেন টোকিয়ো যাচ্ছে। তাতে আমার জন্য একটি সিট রাখা হয়েছে। নেতাজির ভস্মাধার নিয়ে আমি সেই প্লেনে উঠলাম। ৬ সেপ্টেম্বর টোকিয়ো পৌঁছনোর পর গোপনীয়তার কারণে আমাকে শহরতলির একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’দিন আগে জাপানি সেনা প্রথমে ভস্মাধার, পরে আমাকে টোকিয়ো নিয়ে আসে।’’ আইয়ার লিখছেন: ‘‘১৪ সেপ্টেম্বর আমরা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ভস্মাধারটি রামমূর্তির বাড়ি থেকে নিয়ে সুগিনামির রেনকোজি বুদ্ধমন্দিরে পৌঁছলাম। আমরা ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সস্ত্রীক রামমূর্তি, তাঁর ভাই জয়, আইএনএ-র ৪০ জন প্রশিক্ষিত ক্যাডার, শ্রীমতী সহায় ও তাঁর সন্তানরা। জাপানি বিদেশ দফতর ও ওয়ার অফিসের কয়েক জন প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। ভস্মাধার প্রতিস্থাপনের অনুষ্ঠানটি ঘণ্টাখানেক চলল।’’
আইয়ারের বই প্রকাশের পাঁচ বছর পর, ১৯৫৬ সালে শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করলেন পণ্ডিত নেহরু। সেই কমিটি রিপোর্টেও বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, নানা দলিল-দস্তাবেজের পর্যালোচনা করে একই ছবি উঠে এল। কমিটির রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা পড়লেও রাজনৈতিক চাপের মুখে তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। দশকের পর দশক বিতর্ক জিইয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।
এই বিতর্কে ইতি টানতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মনোজ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়লেন আরও একটি কমিশন। কমিশন প্রচুর নথি ঘাঁটলেন, সাক্ষ্যও নিলেন। কিন্তু তত দিনে প্রত্যক্ষদর্শীরা আর কেউ বেঁচে নেই। কমিশনের হাতে ছিল বিজ্ঞানের এক অমোঘ অস্ত্র— ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগ। কিন্তু বিভিন্ন মহলের চাপে সেই সিদ্ধান্ত কমিশন নিতে পারেনি। সংশয়, বিতর্ক জিইয়ে রয়েছে।
দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন দেশের নথিপত্র ঘেঁটে, ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে যুক্ত বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেই লেখা আশিস রায়ের সাম্প্রতিক বই ‘লেড টু রেস্ট: দ্য কন্ট্রোভার্সি ওভার সুভাষ চন্দ্র বোসেস ডেথ’। বইটির ভূমিকা লিখেছেন নেতাজি-কন্যা অনিতা পাফ। গবেষণাগ্রন্থটি নেতাজির ‘মৃত্যু’ রহস্যে ইতি টানার একটা যুক্তিবদ্ধ প্রয়াস। বইটিতে ঘটনা-পরম্পরায় বিভিন্ন তথ্য সাজানো হয়েছে।
এই উদ্যোগে সায় রয়েছে অনিতারও। পিতার মৃত্যু নিয়ে এই টানাপড়েন তাঁর যে পছন্দ নয় (কোন পরিজনেরই বা ভাল লাগে!), তথ্য হিসেবে তা খুব নতুন নয়। অনিতা ডিএনএ পরীক্ষার দাবিও তুলেছেন। নেতাজিকে সম্মান জানাতে শুধু তাঁর মতো টুপি মাথায় দিয়ে লালকেল্লায় বক্তৃতা দিলেই হবে না, অনিতার দাবিমতো নেতাজির ভস্মাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্তও করা উচিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE