Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতার বারুদ

কোনও দেশলাইবাক্সের ওপরে রবীন্দ্রনাথ, কোথাও গাঁধীজি আর হরিণছানা। কোথাও একই সঙ্গে পিস্তল আর চরকা!চল্লিশ বছর ধরে, ১১২টি দেশের প্রায় তিরিশ হাজারেরও বেশি দেশলাইবাক্স আর দেশলাইয়ের ওপরের ‘মার্কা’ জমিয়েছি। দেশলাইয়ের ছবিতে ইতিহাস ও সমাজ দিব্যি বোঝা যায়। আন্দাজ করা যায়, তখনকার ভাবনা, প্রবণতাগুলো। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন, আর স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়ার পর উল্লাস— ভারতের বিভিন্ন দেশলাইয়ের ছবিতে ফুটে ওঠে। কারা তখন গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক-নায়িকা, তাও পরিষ্কার হয়ে যায়।

উৎপল সান্যাল
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

চল্লিশ বছর ধরে, ১১২টি দেশের প্রায় তিরিশ হাজারেরও বেশি দেশলাইবাক্স আর দেশলাইয়ের ওপরের ‘মার্কা’ জমিয়েছি। দেশলাইয়ের ছবিতে ইতিহাস ও সমাজ দিব্যি বোঝা যায়। আন্দাজ করা যায়, তখনকার ভাবনা, প্রবণতাগুলো। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তার সংগ্রামের প্রতি সমর্থন, আর স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়ার পর উল্লাস— ভারতের বিভিন্ন দেশলাইয়ের ছবিতে ফুটে ওঠে। কারা তখন গোটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক-নায়িকা, তাও পরিষ্কার হয়ে যায়।
আমার সংগ্রহের বেশ কয়েকটি দেশলাইবাক্সে রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি আছে। নিবেদিতার নাম ও ছবি দেওয়া একটি বাক্স পেয়েছি। ভগৎ সিংহের চারটে ছবি পেয়েছি দেশলাইবাক্সের ওপর। দেশলাইবাক্সের ওপরের ছবির মাধ্যমে স্বদেশি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। ইংরেজ শাসকের ভয়ে কিছু দেশলাইবাক্সে প্রস্তুতকারক কোম্পানির নামও থাকত না। কয়েকটা বাক্সের গায়ে লেখা: ‘স্বাধীনতা সম সুখ নাই’, ‘নিরুৎসাহ হয়োনা বাঙ্গালী’, ‘বিদেশী পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য গ্রহণ’। শুনেছি তখন কলকাতা থেকে ট্রেনে বা স্টিমারে করে দেশলাইয়ের পেটি পূর্ববঙ্গে যেত। স্টেশনে, বন্দরে ইংরেজ পুলিশ সতর্ক থাকত। আপত্তিকর লেখা মনে হলেই দেশলাইবাক্স বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করে ফেলত।
আমার বন্ধু, নয়াদিল্লির গৌতম হেমাডি-র সংগ্রহে আছে ‘বঙ্গীয় দিয়াশলাই কার্যালয়’-এর ছাপ দেওয়া, ‘মুক্তিসংগ্রাম’ লেখা দেশলাই, যার ওপর চরকা আর পিস্তলের ছবি পাশাপাশি। তাঁর কাছে দেখেছি মাদাম ভিখাজি কামা-র ছবিওয়ালা দেশলাই। মাদাম কামা জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ১৯০৭ সালের ২২ অগস্ট তাঁর পরিকল্পনায় তৈরি ভারতের পতাকা (বেসরকারি) উত্তোলন করেন।
কয়েকটি দেশলাই-বাক্সে ‘বন্দেমাতরম’ লেখা আছে, থাকবেই, এটি ছিল স্বাধীনতার সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্র। একটা ছবিতে, একটা হাতি ‘বন্দেমাতরম’ লেখা পতাকা নিয়ে যাচ্ছে। কলকাতার সংগ্রাহক গোপাল বিশ্বাসের কাছে দুটো দেশলাইবাক্স দেখেছি বন্দেমাতরম লেখা, সেগুলো ছাপা হয়েছিল সুইডেনে! তাঁর সংগ্রহে আছে খোদ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ)-র ব্যবহার করা দুষ্প্রাপ্য একটা আস্ত দেশলাইবাক্স— যার এক পিঠে নেতাজির ছবি, অন্য পিঠে চরকা-আঁকা পতাকা। কলকাতারই শেখর চক্রবর্তীর কাছে আছে বালগঙ্গাধর তিলকের বিখ্যাত উক্তি ‘স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার’ লেখা মার্কা।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর ছবি দেওয়া বহু পুরনো তিনটি স্বদেশি দেশলাই পেয়েছি, একটিতে দেশবন্ধুর পাশে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীও আছেন। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর ছবি-দেওয়া মার্কাও পেয়েছি। নানা জনের কাছে দেখেছি দেশলাইবাক্সের ওপর লোকমান্য তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সরোজিনী নাইডু, নেহরু, সর্দার বল্লভভাই পটেলের ছবি। আমি সেই দেশলাইও জোগাড় করেছি, যার ওপর জ্বলজ্বল করছে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ছবি।

দেশকে ‘মা’ হিসেবে কল্পনা করে ছবি আঁকা ও ‘ভারতমাতা’, ‘হিন্দ মাতা’, ‘স্বরাজলক্ষ্মী’, ‘জয়ন্তী’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি লেখা দেশলাই বেরিয়েছিল সে সময়। দেশলাইবাক্সে হাতি, হরিণ, বাঘের ছবির ব্যবহার সে-কালে খুব হত। আমার কাছে একটা দেশলাইবাক্স আছে কলকাতার ‘ক্রাউন ম্যাচ ফ্যাক্টরি’র বানানো, সেখানে মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে একটা হরিণের ছবি! হয়তো গাঁধীকে পৌরাণিক ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে তাঁর মহত্ত্ব বোঝানের চেষ্টা হয়েছে, বা বলা হচ্ছে, তিনি আমাদের দেশে এমনই রূপকথার রাজ্য আনবেন! একটি মার্কায় অবশ্য গাঁধী তাঁর সবচেয়ে পরিচিত পোজ-এ, চরকায় সুতো কাটছেন।

স্বাধীনতার সময় বা পর-পর তো বটেই, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত নেতাজির ছবিওয়ালা দেশলাই পাওয়া গিয়েছে। সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জাতীয় নেতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছবি পেয়েছি তাঁরই, এক ডজন। নানা ভাবে ‘জয় হিন্দ’ লেখা দেশলাইবাক্সও পেয়েছি অনেক।

স্বাধীনতার দিনটিকে স্মরণ করে অনেক দেশলাইবাক্সে ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা নানা আঙ্গিকে ছাপা হয়। কোনওটিতে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া’ লেখা। কয়েকটি বাক্স পেয়েছি, যাতে ১৫.৮.১৯৪৭ তারিখটি ছাপা আছে। একটি চমৎকার ছবিতে স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয়কে স্মরণ করা হয়েছে। পরের বছর, স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে ছাপা দেশলাইও পেয়েছি, সেখানে তারিখ ১৫.৮.১৯৪৮। এখন দেশলাই না হোক, লাইটার বেরতে পারে না, স্বাধীনতার ৬৮ বছর পূর্তি স্মরণ করে?

utpalsanyal@yahoo.co.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE