Advertisement
E-Paper

স্টিয়ারিং হাতে দরদর ঘামছি

হোয়ার’জ মাইস্টুডি?’ বাদামি চুল আর কটা চোখের ইংরেজ সাহেবের কথা বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারায়, বিরাট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর— জন ইংল্যান্ড সটওয়েল (আশি শতাংশ অবাঙালি শ্রমিক কর্মচারী এই নামই বলতেন)-এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।

দুলাল কুমার চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

হোয়ার’জ মাইস্টুডি?’ বাদামি চুল আর কটা চোখের ইংরেজ সাহেবের কথা বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারায়, বিরাট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর— জন ইংল্যান্ড সটওয়েল (আশি শতাংশ অবাঙালি শ্রমিক কর্মচারী এই নামই বলতেন)-এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। সাহেব আমার চোখের ‘বেগ ইয়োর পার্ডন’ বুঝতে পেরে আবার কেটে কেটে বললেন, ‘হোয়ার’জ মাই স্টুডিবেকার?’ আমার বাঙালি ইংরেজিতে জানালাম, গাড়ি এখনও গ্যারেজে, সার্ভিসিং-এর পর পালিশ হচ্ছে। বললেন, ‘সেন্ড ড্রাইভার সামসুদ্দিন উইথ দ্য ভিআইপি কার।’ ড্রাইভার দূর থেকে দেখে অস্টিন এ হেরিফোর্ড নিয়ে হাজির। বেয়ারা গাড়ির দরজা খুলে অ্যাটাচি কেস রাখার পর সাহেব বসলেন। দারোয়ান শশব্যস্ত হয়ে গেট খুলেছে। গাড়ি নিঃশব্দে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ‘থ্যাঙ্কু’ কানে এল। পুরো ব্যাপারটার নিষ্পত্তি আশি সেকেন্ডে।

’৬০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের ভারী শিল্পে ব্রেথওয়েট-এর নাম প্রথম সারিতে। কোম্পানির এম ডি নিজেও জানতেন, সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ওঁর স্কটিশ উচ্চারণের ইংরেজি মাত্র দশ-বারো জন এক বারে বুঝে উত্তর দিতেন। ওঁদের মাধ্যমেই উনি মৌখিক নির্দেশ দিতেন। এই সাহেবের আমলেই হঠাৎ সরকারি বরাত বন্ধ হওয়ায় কোম্পানি দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিশেষ ধরনের চারশো ওয়াগনের অর্ডার সংগ্রহ করে, আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। ১৯৬৭-’৬৮-তে কোম্পানি ভারত সরকারের ‘এক্সপোর্ট পারফরম্যান্স’ পুরস্কারও পায়। সটওয়েল তখনও ভাবেননি, ’৬৫-তে এম ডি হয়ে ’৭৩ সালে, মাত্র একান্ন বছর বয়সে কোম্পানি ছেড়ে সপরিবার নিজের দেশে ফিরে যাবেন। নানা কারণে কলকাতা থেকে বিভিন্ন কোম্পানির বিদেশি উচ্চপদাধিকারীরা ১৯৭১-’৭৪-এর মধ্যে তাঁদের দেশে ফিরে যান। ’৭৫-এ কেন্দ্রীয় সরকার এই কোম্পানিকে অধিগ্রহণ করে।

সেক্রেটারি মাথুর সাহেব বলে দিয়েছিলেন, ট্রান্সপোর্ট সেকশনে ঝামেলা অনেক, যেন সাবধানে কাজ করি। আমার কিন্তু ভালই লাগত। কোম্পানির দুটো কারখানা— একটা হাইড রোডে, আর একটা ভদ্রেশ্বরে। দুটো জায়গা মিলিয়ে প্রায় ষাটটা গাড়ি। তা ছাড়া মালবাহী লরি, অ্যাম্বুলেন্স, কোম্পানির নিজস্ব পেট্রল পাম্প, রিপেয়ারিং গ্যারেজ। জনা পঁয়তাল্লিশ ড্রাইভার— দশ জন বাঙালি, বাকিরা অন্য প্রদেশের। যত দূর মনে পড়ে, তখন পেট্রল প্রতি লিটার ৮০/৮২ পয়সা। অ্যাম্বাসাডর গাড়ির দাম সতেরো হাজারের আশেপাশে।

এক দিন এগারোটা নাগাদ এসপ্ল্যানেড থেকে আসছি, যাব ভবানীপুর। ড্রাইভার ছিতন ঠাকুর বলল, সাব আপনি গাড়ি চালান, দেখুন স্টিয়ারিং বাঁ দিকে টানছে। চলতি গাড়িতেই জায়গা বদল হল। আমার একটু কিন্তু-কিন্তু ছিল, কারণ বেলতলার লাইসেন্স থাকলেও ভিড় রাস্তায় আমি তখনও তেমন সড়গড় নই। গ্র্যান্ড হোটেল পেরোতেই রিয়ার-ভিউ মিররে দেখি, দুটো প্রাইভেট বাস পেছনে ধেয়ে আসছে, তীব্র গতিতে একে অন্যকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছে। আর ওদের সামনে পড়ে গেছি আমি, অনভ্যস্ত হাতের এক ড্রাইভার, যার গাড়ির স্টিয়ারিং আবার এক দিকে টানছে। বাসের ইঞ্জিনের গর্জন, হর্নের হুংকারে তো আমার থরহরিকম্প। ছিতনের ‘সাব, সাম্‌হালকে’ কানেই ঢুকেছে শুধু, মগজে নয়। স্টিয়ারিং বাগে রেখেছি কোনও মতে, গাড়ি চলছে সোজা। দুটো বাসই পেছনে ধাক্কা মারার আগে, গতি না কমিয়ে, আমার গাড়ির দু’পাশ দিয়ে উল্কার মতো চলে গেল। গাড়ি পার্ক করলাম বাঁ দিকে। সমস্ত শরীর ঘামে জবজবে। ছিতনকে বললাম, পানি দিজিয়ে। জল খেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

নন্দন সাউ নামে এক ভদ্রলোক এক দিন দেখা করতে এলেন। সঙ্গে তাঁর ছেলে, বয়স একুশ-বাইশ হবে। কেন এসেছেন, জিজ্ঞেস করতে ভদ্রলোক বললেন, কোম্পানির একটা গাড়ি ইচ্ছে করে তাঁর ছেলের গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে এসেছে। গাড়ির নম্বর দেখে বুঝলাম, ড্রাইভার বীরেনের গাড়ি। ডেকে জিজ্ঞেস করতে বীরেন জানাল, ‘স্যর, গাড়ি খিদিরপুর ব্রিজের কাছে জ্যামে পড়েছিল। ঠিক পেছনেই ছিল এই ছেলেটার গাড়ি। ছেলেটার গাড়ি কোম্পানির গাড়িকে দু-তিন বার ঠুক ঠুক করে ধাক্কা দেয়। পেছনে তাকাতে ছেলেটা বলে, ‘আপ গাড়ি ভাগানা নেহি জানতা? চুপচাপ খাড়া হ্যায় কাহে?’ সামনে জ্যাম, বলার পরেও ছেলেটা আরও ক’বার ধাক্কা মারে। তার পর সিগনাল পেতেই গাড়ি ব্যাক গিয়ারে করে পেছনে জোরে ধাক্কা দিই। ওর তো স্যাকরার ঠুকঠুক, আমি কামারের এক ঘা মেরে দেখিয়ে দিয়েছি, গাড়ি ভাগানো কাকে বলে।’ সব শুনে কী বলব ভাবছি, নন্দনবাবু রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন। রাগ বীরেনের ওপর নয়, নিজের ছেলের ওপর। ‘আহাম্মক ছেলে, বাপের বয়সি ড্রাইভারের সাথে ফাজলামি করছ তুমি?’ মন ভরে যায়।

অন্য এক সংস্থা থেকে এক অফিসারকে সাময়িক ভাবে ওএসডি করে আনা হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী উনি একটা গাড়ি পাবেন, তাই দেখভাল করে একটা গাড়ি ওঁর জন্য রাখলাম। উনি দেখতে এসে পালিশ করা গাড়ির এখানে-ওখানে বুটের ঠোক্কর লাগালেন। মুখে বিরক্তির ছাপ, নানান প্রশ্ন। ড্রাইভাররা মুখ টিপে হাসছিল। অতিথি অফিসার, আমি তাই সবিনয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে এড়িয়ে যাই। কাজ হয়ে যাওয়ায় মাস চারেক বাদে তাঁকে তাঁর কোম্পানিতে ফেরত পাঠানো হয়। এক দিন ডেকার্স লেন থেকে বেরিয়েছি, দেখি ভদ্রলোক কার্জন পার্কের সামনের রাস্তা ধরে দৌড়চ্ছেন, তারাতলাগামী বাস ধরতে!

রবীন ঘোষ পাড়ার ছেলে। প্রাইভেট গাড়ি চালায়। দেখা হলেই বলত, কোম্পানির একটা কাজ জুটিয়ে দিন না! আমি তো নিমিত্ত মাত্র, ওরই কপাল, একটা কাজ জুটেও গেল। কিছু দিন বাদে ড্রাইভারদের বসার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, শুনলাম, রবীন অন্য ড্রাইভারদের কাছে আমার কুৎসা করছে। ওদের ঘরে ঢুকতেই সে তোতলাতে শুরু করল। কিছু না বলে মিটিমিটি হাসছি, রবীন ছাড়া অন্যরাও হাসছে।

শুধু আপশোস থেকে গেছে, এর পর পরিচিত কারও জন্য কিছু করার ভরসা পাইনি বলে। ন্যাড়া এক বারই বেলতলায় যায়।

chakravortykdulal@gmail.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের
পরিবেশ পিএনপিসি হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

officefis office gossip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy