Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আজ কপাল পুড়ল: দত্তা-র

তখন স্কুলছাত্র। অসম্ভব, উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরটা। আমার দাদা তখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, সকালে ক্লাস করতে বেরিয়ে দিনশেষে ঠিকঠাক ঘরে ফিরতে পারবে কি না, সে চিন্তাতেই কাটত বাড়ির সবার সময়। চারদিকে শুধু উত্‌কণ্ঠা আর দুশ্চিন্তা, ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বেরোতে বছরকে বছর লেগে যাচ্ছে, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ভাল ভাল ছেলেরা পুলিশের গুলিতে বা বোমায় মরে যাচ্ছে। নিষ্ঠুর এই সময়ে মধ্যে মধ্যে এক ঝলক বসন্তের হাওয়া নিয়ে আসত এক একটা সিনেমা। ‘ববি’ যেমন।

বিশ্বজিত্‌ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

তখন স্কুলছাত্র। অসম্ভব, উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরটা। আমার দাদা তখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, সকালে ক্লাস করতে বেরিয়ে দিনশেষে ঠিকঠাক ঘরে ফিরতে পারবে কি না, সে চিন্তাতেই কাটত বাড়ির সবার সময়। চারদিকে শুধু উত্‌কণ্ঠা আর দুশ্চিন্তা, ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বেরোতে বছরকে বছর লেগে যাচ্ছে, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ভাল ভাল ছেলেরা পুলিশের গুলিতে বা বোমায় মরে যাচ্ছে। নিষ্ঠুর এই সময়ে মধ্যে মধ্যে এক ঝলক বসন্তের হাওয়া নিয়ে আসত এক একটা সিনেমা। ‘ববি’ যেমন।

সেটা ১৯৭৩। দু’বছর আগেই রিলিজ হয়েছে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’, ওই অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছবি। যৌবনের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার একটা ছবি ফুটে ওঠেছিল সেই সিনেমায়, শেষে হিন্দি ছবির বাঁধা গতেই একটা ইতিবাচক অন্তে পৌঁছয়। ‘ববি’ও সেই টিন-এজ, সদ্য-ইয়ুথ নিয়ে বানানো ছবি, কিন্তু একেবারে অন্য রকম। বলা যেতে পারে, একটা অব দি ইয়ুথ, বাই দি ইয়ুথ ফিল্ম।

আমাদের বেড়ে ওঠাটা তো অন্য রকম ছিল। শাসনে, নিষেধে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। মেয়েদের ধারেকাছে ঘেঁষা যেত না। সরস্বতীপুজো, দুর্গাপুজোর অষ্টমীর মতো হাতেগোনা ক’টা দিনে হয়তো পাড়ার চেনা মেয়েটির সঙ্গে একটু চোখাচোখি, কিঞ্চিত্‌ হাতের স্পর্শ সম্ভব হত। ওই রকম একটা বয়সে রিলিজ হল ববি। একটা গোলাপফুল চোখের সামনে আস্তে আস্তে ফুটে উঠলে মনের স্বতঃস্ফূর্ত এক্সপ্রেশনটা কী হবে? ‘বাঃ!’ আমাদের জীবনে ‘ববি’ ছিল ওই রকমই একটা ‘বাঃ!’ স্রেফ একটা সিনেমা না, একটা অনুভূতি, একটা অভিব্যক্তির নাম ববি। আর ববি নামধারী ডিম্পল কাপাডিয়া আমাদের বয়সি সব ছেলের কাছে তখন একটা স্বপ্ন। ওই যে দৃশ্যটা ছিল না, ডিম্পল দরজা খুলল, হাতের বেসনগোলাটা আনমনা মাথার চুলে মাখল! ওই এক একটা শটের জন্যই আমার বন্ধুদের অনেকে ছবিটা দশ-এগারো বার দেখেছে। আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখানে ছবি নিয়ে ও রকম পাগলামো করার সুযোগ ছিল না। তা বলে কি সিনেমা দেখতাম না? স্বপ্নে, ফ্যান্টাসিতে দেখতাম। ডিম্পল তো সঙ্গেই থাকত সব সময়! স্বপ্নে কি জাগরণে, শয্যায় কি সজ্জায়।

তত দিনে তো বিকিনি-বিভঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর, জিনাত আমনকে দেখে ফেলেছি। কিন্তু ববি আমাদের চোখে আর মনে পুরো আলাদা একটা অনুভূতি নিয়ে এল। ববি খুব সুন্দরী, নিষ্পাপ। আবার দুর্দান্ত অ্যাপিলিংও। ছোট্ট, শরীর-আঁকড়ানো পোশাক পরে নায়িকা আমার সামনে পরদায় দাঁড়িয়ে, অথচ মুখটা, মুখের হাসিটা, চোখের মণির চলাফেরাটা কী মিষ্টি! নিষ্পাপ ইনোসেন্স-এর সঙ্গে যৌনতাকে যে কী দারুণ অনায়াসে মিলিয়ে, মিশিয়ে দেওয়া যায়, তা বুঝতে গেলে এই ছবি দেখতেই হবে। কৈশোর-পেরনো সদ্য-যৌবনে ববি দেখে নিজেদেরই অজান্তে আমরা সুন্দরতা আর যৌনতার হাত ধরতে শিখেছিলাম, একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ আর উত্তেজিত হয়েছিলাম। ‘হম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো’ গানে যখন ‘শের আ যায়ে’, ববিকে দেখেই তো বাঘ একেবারে কুপোকাত! আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, ডিম্পল গাইছেন বটে ‘শেরসে ম্যায় কহুঁ তুমকো ছোড় দে, মুঝে খা যায়ে’, তা বাঘ তো ববিকে দেখে হাঁ, হাঁ-মুখে হালুম করবে কী!

সে দিক থেকে ভাবলে, ববি আসলে শরীর-ভাবনার মুক্তি, একটা লিবারেশন মুভমেন্ট। কিন্তু এ-ও ঠিক, কিশোরী ডিম্পলকে আমরা কেউ স্রেফ ‘সেক্স সিম্বল’ হিসেবে দেখিনি। আমাদেরই বয়সি খুব সুন্দর একটা মেয়ে, যাকে বান্ধবী, প্রেমিকা হিসেবে পেতে দারুণ লাগবে, এমন মনে হত। সে জন্যেই মনে হয় টিন-এজ লাভ স্টোরি হিসেবে একটা আইকনিক জায়গা করে নিয়েছিল ছবিটা। এই থিমের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল ধনী বনাম গরিব পরিবারের ঝগড়া-কাজিয়াও। ববি’র আগেই যদিও বাংলা ছবিতেই আমরা পয়সাওলা ছেলে আর দীনদরিদ্র মেয়ের (বা উলটোটা) প্রেম দেখেছি। তবু, সত্তরের দশকের পারিবারিকতার বজ্র-আঁটুনি ভাঙার দুঃসাহস দেখিয়ে দুটো ছেলেমেয়ের বেরিয়ে যাওয়া, পালিয়ে গিয়ে ধরা পড়া, শেষে হিরো-হিরোইনের পাশাপাশি দুটো পরিবারেরও কাছে আসা এই ব্যাপারগুলো আমাদের খুব টেনেছিল। প্রেমের জয় তো এমনিতেই দেখতে খুব ভাল লাগে! আর আমাদের সময় সেই প্রাপ্তিটা অত সহজসাধ্য ছিল না বলেই পরদায় ববি আর রাজ-এর সঙ্গে আমরাও দুর্বার দুদ্দাড় ভেসে গিয়েছিলাম।

আর কী কাস্টিং! ঋষি কপূরের মতো সুন্দর একটা হিরো, আর ডিম্পল কাপাডিয়ার ডেবিউ! পোশাক, চুলের ফ্যাশন, মিউজিক, সব ক্ষেত্রেই ববি ‘কাল্ট’। আমার মতে, এ রকম একটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঠিক অমুক লোকটা পোশাক পরিকল্পনা করে দিলেন, গীতিকার ক’টা গান লিখে দিলেন বা সুরকার সুর করে দিলেন, এ রকম হলে হয় না। ডিরেক্টরের একটা ভিশন না থাকলে এ জিনিস অসম্ভব। ‘ববি’ তাই স্রেফ একটা প্যাকেজ নয়, একটা ফিনিশ্‌ড প্রোডাক্ট।

আমাদের বাবা-কাকাদের মনেও দোলা দিয়েছিল ছবিটা। লেখার শুরুতে তাই ইচ্ছে করেই ‘ফর দি ইয়ুথ’টা বলিনি। ববি সব বয়সের, সব জেনারেশনের প্রিয়। আর লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল’এর সুরে অপূর্ব সব গান! সেই প্রথম একদম অন্য রকম একটা কণ্ঠ পেলাম, শৈলেন্দ্র সিংহ। ‘হম তুম এক কামরে মে’ গানটা তো ইতিহাস, ওঁর গলায় ‘ম্যায় শায়র তো নহি’, লতাজির সঙ্গে ডুয়েট ‘ঝুট বোলে কৌয়া কাটে’, ‘মুঝে কুছ কহনা হ্যায়’ আমাদের মুখে মুখে ফিরত। সেরা মেল প্লেব্যাক-এর ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডটা যদিও পেয়েছিলেন নরেন্দ্র চঞ্চল, ‘বেশক মন্দির মসজিদ’ গানটার জন্য, আমাদের কাছে শৈলেন্দ্রই সুপারহিট ছিলেন। রাজ কপূরের আবিষ্কার বলে কথা!

কত স্মৃতি। মেনকা হল-এ দেখেছিলাম। দৃশ্যগুলো এখনও জীবন্ত, সতেজ। আর শুধুই আবেগে ভেসে না, এক জন অভিনেতা হিসেবেও বলি, ববি খুব যত্ন করে বানানো একটা ছবি। হিরোনির্ভর ইন্ডাস্ট্রির বাঁধা ছক না মেনে পরিচালক হিরোইনের চরিত্রের নামে ছবির নাম দিচ্ছেন, যে হিরোইন কিনা জীবনে প্রথম অভিনয়ে নামছে। কম রিস্ক? একই ছবিতে নিজের ছেলেকে প্রথম হিরোর রোল দিয়েও, ইউএসপি করা হচ্ছে সর্বাঙ্গসুন্দরী নায়িকাকে। আজ বুঝি, এক জন রাজ কপূর ছিলেন বলেই একটা ‘ববি’ সম্ভব হয়েছিল।

c.biswajit@yahoo.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hello 70 bobby dimple kapadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE