Advertisement
০২ মে ২০২৪

আশ্চর্য নাটকের গ্রাম

গ্রামের সবাই বামন। সবাই নাটক করেন। সকালে চাষ, বিকেলে রিহার্সাল। দেশ জুড়ে হয় তাঁদের শো। প্রবল দাপটে তাঁরা চাঁদ ধরছেন!গ্রামের সবাই বামন। সবাই নাটক করেন। সকালে চাষ, বিকেলে রিহার্সাল। দেশ জুড়ে হয় তাঁদের শো। প্রবল দাপটে তাঁরা চাঁদ ধরছেন!

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

বছর সাতেক আগে গুয়াহাটির এক শীতের রাত। ছেলেগুলো ফুটপাতের কোণে আগুনের আঁচ নিচ্ছে, সঙ্গে মদ্যপান চলছে। ছোটখাটো একটা নাটকের দল রয়েছে তাদের। ‘দাপুন, দ্য মিরর’। অসমিয়ায় দাপুন মানে দর্পণ, আয়না। দলের পান্ডা পবিত্র রাভা। বয়স বত্রিশ হবে। ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’ থেকে পাশ করে খানকতক হিন্দি ছবিতে কাজ পেয়েছিলেন। পয়সাকড়ি ভালই আসছিল। কিন্তু মাথায় অন্য পোকা ঘুরঘুর করছিল। সব ছেড়েছুড়ে চলে এসে নাট্যদল গড়েছেন। ভিতরটা ছটফট করছে, ছকভাঙা কিছু করতে হবে, সব ভাবনাচিন্তা ওলটপালট করে দিতে হবে। কিন্তু শুরুটা করে উঠতে পারছেন না। অস্থির হয়ে উঠছেন, হাতড়াচ্ছেন।

শাগরেদগুলোও জুটেছে তেমন। নতুন কিছু করার উন্মাদনা আছে, আবার কমদামি মদ পেটে পড়ার পরেই যাবতীয় ফ্রাস্ট্রেশন উথলে উঠছে। সে দিন কাঁদতে শুরু করল ওদের ক’জন। কখন এক ফাঁকে তাদের পাশে এসে বসল বামন ছেলেটা। উচ্চতা মেরেকেটে তিন ফুট। কাছেই থাকে, চায়ের দোকানে কাজ করে, মাঝেমধ্যে জুটে যায় নাটক-করা ছেলেদের আড্ডায়। এখানে ওর ভাল লাগে। অন্তত বিদ্রুপটা জোটে না। সবার কান্না দেখে কেঁদে ফেলেছিল সে-ও। ঠান্ডা, কুয়াশা, আগুনের আঁঁচ, নেশা, কান্নার মধ্যে ওকে দেখে কী একটা হয়ে গেল পবিত্রর মাথার মধ্যে। হঠাৎ ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পেয়েছি! তোদের মতো মানুষদের নিয়েই শুরু হবে আমাদের কাজ। অভিনয় করবি, নিজেদের জায়গায় মাথা উঁচু করে থাকবি।’

কথাটা নিছক নেশার প্রলাপ হতে পারত। হয়নি। বরং ওই সংকল্প থেকে জন্ম নিয়েছিল ৩৫ জন বামন অভিনেতার অভিনীত নাটক, আর আস্ত নাটকের গ্রাম, ‘আমার গাঁও’!

কেমন গ্রাম? বামন অভিনেতারাই গ্রামের মূল বাসিন্দা। তাঁরা বেঁচে থাকার রসদের জন্য চাষবাস করেন বটে, কিন্তু বাদবাকি সময় জুড়ে রয়েছে শুধুই নাটক। স্ক্রিপ্ট লেখা, মহড়া, ড্রেস বানানো, ওয়ার্কশপ, সারা ভারত জুড়ে শো করা। গুয়াহাটি থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে ভুটান সীমান্তে অসমের উদালগুড়ি জেলার আধাশহর টংলা। তার লাগোয়া জলা এলাকায় প্রায় ছ’বিঘা সরকারি জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তৈরি সাতটা বাঁশের দোতলা বাড়ি, কিছু সবজি খেত, টিউব কল। বিদ্যুৎ এসেছে মাস কয়েক। এখনও অনেক কাজ বাকি, কিন্তু শুরুটা তো হয়েছে! আপাতত ১২ জন বামন অভিনেতা গ্রামের পাকাপাকি বাসিন্দা। বাকিরা আসা-যাওয়া করেন, টানা দু-তিন মাস থেকেও যান। এঁদের মধ্যে ছ’জন ইতিমধ্যে নিজের পরিচালনায় নাটকও বানিয়ে ফেলেছেন!

২০০৭ সালে গুয়াহাটির সেই শীতের রাতের পরেই যোরহাট, শোনিতপুর, দরং, গোয়ালপাড়া, নকশাবাড়ি, সিরাং, কোকড়াঝাড়ের মতো অনেক জেলায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বামনদের খোঁজ শুরু করেন পবিত্র রাভার নাটক-দলের কর্মীরা। পবিত্র বললেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল এই প্রাথমিক বাছাই পর্ব। চার বছরে ৭০ জনকে পেয়েছিলেন। তার থেকে ৩০ জনকে বাছেন। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করেননি এঁদের নাটক করানোর জন্য ডাকা হচ্ছে। আশঙ্কা করেছিলেন, নিশ্চয়ই সার্কাসে বিক্রি করে দেওয়া হবে বা আরব দেশে ভিক্ষা করানো হবে। ২০১১-র গোড়ায় সবাইকে ডাকা হল টংলা-য়। সেখানেই পবিত্রর আদি বাড়ি এবং তাঁর নাটক-দলের প্রধান অফিস।

সেচ দফতরের একটা পরিত্যক্ত জমি পড়ে ছিল সেখানে। ওয়ার্কশপ আর অভিনেতাদের থাকার জায়গা হল। শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন। ‘দাপুন’-এর সদস্যরা শোনাচ্ছিলেন প্রথম দিনের কথা— একের পর এক ওঁরা ঢুকছেন। বিভ্রান্ত, আত্মবিশ্বাসহীন, শঙ্কিত। কী করতে এসেছেন, কী হতে চলেছে, কিচ্ছু জানেন না, শুধু কতকটা ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছেন। ৫৮ বছরের প্রৌঢ় যেমন ছিলেন, সেই দলে তেমন ছিল আট বছরের বালিকা। অধিকাংশই সামাজিক ভাবে এতটা কুণ্ঠিত হয়ে থাকতেন, এর আগে তেমন বাড়ির বাইরেই বার হননি। ভাল করে কথা পর্যন্ত বলতে পারতেন না, নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারতেন না। পবিত্র এবং বন্ধুদেরও খুব টেনশন। এঁরা নাটক করতে পারবেন তো?

ম্যাজিকটা কিন্তু হল! ৪৫ দিনের ওয়ার্কশপ। তার পর মহড়া শুরু। পবিত্রই নাটকটা লিখলেন: ‘কিনু কঁয়’ অর্থাৎ ‘কী বলব?’ অসমিয়া, বাংলা, বোরো, রাভা, হিন্দি, ইংরেজি মেশানো নাটক, যার মূল বিষয় এই সব বামন মানুষের জীবনের বঞ্চনা, ক্ষোভ, হতাশা। গাড়ি ভাড়া করে সব অভিনেতাদের নিয়ে টংলার রাস্তায় শো-এর প্রচারে বেরনো হত, লিফলেট বিলি করা হত। হাঁ করে দেখতেন সবাই। কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন বুঝতে পারতেন না।

২ এপ্রিল ২০১১, টংলাতেই অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম শো। হাজারখানেক আসন রাখা হল। সে দিনই আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল পড়ল। ভারত-শ্রীলঙ্কা। ধরেই নেওয়া হল, কেউ আসবে না। হিসেব ওলটপালট করে সব আসন ভরিয়ে আশপাশের বাড়ির চাল, গাছের ডালে পর্যন্ত বসে বামনদের নাটক দেখল টংলা। জিতিয়ে দিল ওঁদের। শুরু হল ভারত জুড়ে শো। ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’-র ডাকে তিন বার দিল্লি গিয়েও শো হয়েছে। কলকাতাতেও এসেছেন তাঁরা। অভিনেতাদের মধ্যে বিনোদ কাকোতি, ধনদাস, রঞ্জিত, রঞ্জু, জিতুনি রাভা নিজস্ব নাটক পরিচালনা করছেন। ‘রং নাম্বার’, ‘জীবনের যাত্রা’, ‘মই কিও’ এবং ‘মিছা কথার ঠ্যাং ছুটি’ নামে চারটি নাটক ইতিমধ্যে মঞ্চস্থ।

এই হল স্বপ্নের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ নাটকের গ্রাম তৈরির। বামন অভিনেতাদের জন্য ‘কনসেপচুয়াল ভিলেজ’। কেন আলাদা গ্রামের পরিকল্পনা? অন্যদের সঙ্গে থেকে কি নাটক হবে না? যে সমাজে বামন মানুষেরা এমনিতেই প্রান্তবাসী সেখানে আলাদা গ্রাম হয়ে গেলে তাঁরা পুরোপুরি সমাজ-বিচ্যুত হয়ে যাবেন না তো?

উত্তর দিলেন ওঁরা নিজেরাই— একেবারে নিজেদের একটা জায়গা দরকার ছিল আমাদের, যেখানে অন্যদের কটূক্তি, ব্যঙ্গ, পরিহাস শুনতে হবে না, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারব, সব কাজ নিজেরা করব, আর নাটকে ডুব দিতে পারব। সেই জন্যই ‘আমার গাঁও’। ভাগ্যিস সরকার জায়গাটা দিল। বহু দিন এখানে একটা শ্মশান ছিল। তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কারণ, ভূতকে নয়, আমরা সবচেয়ে বেশি ভয় পাই মানুষকে, তাদের বাঁকা কথাকে। নাটকের গ্রামে অন্তত সেটা থাকবে না। তা ছাড়া, এই গ্রামে সাধারণ মানুষের আসতে কোনও বাধা নেই। ইতিমধ্যে আমরা এখানে বাচ্চাদের নাটক শেখানোর ক্লাসও শুরু করেছি।

দিনের বেলা জমিতে তাঁরা ধান, ডাল, শাক-সবজি চাষ করেন। হাল চালাতে অসুবিধা হয় বলে শুধু সেটুকুর জন্য লোক ভাড়া করতে হয়। যা ফসল হয়, কিছুটা নিজেদের পেট ভরাতে লাগে, বাকিটা বিক্রি করেন। নাটক করে মাসে এক-দেড় হাজার টাকা আয় হয়। সেটা হাতখরচা। পালা করে রান্না করেন। বিকেলের পর থেকে শুরু হয় নাটকের কাজ, রিহার্সাল। যখন বিদ্যুৎ ছিল না, সব কিছু করা হত লণ্ঠনের আলোয়। তাতেও কোনও অসুবিধে হত না। ওঁদের কথায়— এটাই জীবন খুঁজে পাওয়া। গরিবি বা আধপেটা খাওয়া, সব ভ্যানিশ হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার এই নতুন অনুভূতির দাপটে।

পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর নাটকের গ্রাম কী রকম দেখতে হবে তার একটা মডেল নিজেদের হাতেই বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি করেছেন তাঁরা। প্রায় ৫০টা বাঁশের বাড়ি, পাকা শৌচাগার, স্কুল, হাসপাতাল, লাইব্রেরি, কম্পিউটার সেন্টার, খেলার মাঠ, আর গ্রামের ঠিক মাঝখানে বড় একটা নাট্য অ্যাকাডেমি, তার ওয়ার্কশপ সেন্টার আর ইয়া বড় একটা স্টেজ। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা লাগবে। একটু-একটু করে চাঁদা উঠছে। এতটা যখন হয়েছে, বাকিটা হবেই। চাঁদ ছুঁয়ে ফেলতে আর দেরি নেই।

parijat_ban@yahoo.co.in

যিশুর নাটকের গ্রাম

১৬৩২ খ্রিস্টাব্দের জার্মানি। কাঠুরেদের গ্রাম ওবেরামারগাউ’তে প্লেগের মড়ক লাগল। গ্রামবাসীরা হত্যে দিয়ে পড়ল ভগবানের কাছে। প্রাণ বাঁচিয়ে দিলে, যদ্দিন এই গ্রাম থাকবে তদ্দিন ভগবান যিশুর জন্যে নাটক করে যাব আমরা। পরের বছর থেকেই রোগের প্রকোপ অনেক কমে গেল। প্রতিশ্রুতি রাখতে, ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে গ্রামে শুরু হল ‘প্যাশন প্লে’। যিশুর শেষ জীবন, তাঁর জেরুজালেম আসা থেকে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে নাটক। সারা গ্রাম কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত সেই নাটকে। সেই রীতি আজও চলে আসছে। তবে এখন নাটক হয় প্রতি দশকে এক বার। অর্থাৎ ১৬৪০-এর পর ১৬৫০, ’৬০— এ ভাবে দশ বছর অন্তর আসর বসে। টানা পাঁচ মাস চলতে থাকে শো। মঞ্চে ট্যাবলো সাজিয়ে পরদার আড়াল থেকে গল্প বলে, কোরাসে নাচ-গান-অভিনয় করে, সারা বিশ্বে খুব হাততালি কুড়িয়েছিল এই নাটকের গ্রাম। বাদ সাধল গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক। ১৯৩৪ সালে নাটকের ৩০০ বছর উদ্যাপনে স্পেশাল শো হল। জার্মানিতে তখন নাৎসিদের দাপট। হিটলারের ইচ্ছায় নাটকের চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়ল ইহুদি-বিদ্বেষ। যিশুকে ইহুদিরা খুন করেছিল বলে আঙুল তুলল নাটক। বিতর্কের ঝড় উঠল। ক্যাথলিক গির্জা পর্যন্ত প্রতিবাদ জানাল। হিটলারি জমানা অস্ত গেলে, আপত্তিকর অংশগুলি ছেঁটে দেওয়া হল। তার পর এখনও পর্যন্ত সব তোফা চলছে। সারা পৃথিবী থেকে লোক দেখতে আসেন এই নাটক। শেষ শো বসেছিল ২০১০ সালের মে থেকে অক্টোবরে। সঙ্গে তারই ড্রেস রিহার্সালের ছবি। পরের শো হবে ২০২০-তে। গ্রামের অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম সেজে উঠছে। ৪৭০০ মানুষ বসতে পারবেন সেখানে। টিকিট কাটলে তার মধ্যেই গ্রামে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার দাম ধরা থাকবে।

এই প্রচ্ছদকাহিনি কেমন লাগল? মন্তব্য করতে, এই ফেসবুক পেজ-এ যান: www.facebook.com/anandabazar.abp

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bandyopadhyay anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE