Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
খু দ কুঁ ড়ো

এক অসহনীয় সৎ মানুষ

তিনি ছিলেন জার্ডিন মেনজিস-এর ওভারসিয়ার। তাঁর কাজের প্রকৃত ধরন আমার জানা নেই। তবে সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত। যত দূর জানি, সিভিল কনস্ট্রাকশন। সকালে কালীঘাটের বাসা থেকে ফুলপ্যান্ট, শার্ট, কোট আর মাথায় হ্যাট চাপিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে পড়তেন। শুনতাম চাকরির সুবাদে তাঁকে সারা কলকাতা, টালা থেকে টালিগঞ্জ ঘুরে বেড়াতে হয়। রোগা, গৌরবর্ণ, ছোটখাটো মানুষ।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

তিনি ছিলেন জার্ডিন মেনজিস-এর ওভারসিয়ার। তাঁর কাজের প্রকৃত ধরন আমার জানা নেই। তবে সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত। যত দূর জানি, সিভিল কনস্ট্রাকশন। সকালে কালীঘাটের বাসা থেকে ফুলপ্যান্ট, শার্ট, কোট আর মাথায় হ্যাট চাপিয়ে সাইকেলে বেরিয়ে পড়তেন। শুনতাম চাকরির সুবাদে তাঁকে সারা কলকাতা, টালা থেকে টালিগঞ্জ ঘুরে বেড়াতে হয়। রোগা, গৌরবর্ণ, ছোটখাটো মানুষ। ভুঁড়ো গোঁফ ছিল, চোখ দুটি ছিল ঈষৎ কটা। সারা জীবনে আমি তাঁর মতো মিতবাক, নম্রস্বভাব এবং আদ্যন্ত সৎ মানুষ আর দেখেছি বলে মনে হয় না। যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন, তার মালিকরা লালমুখো সাহেব। সাহেবদের অনেক গুণের মধ্যে একটা গুণ ছিল— অসাধারণ, সৎ বা কাজের মানুষকে তারা ঠিক চিনতে পারত। সুতরাং সেখানে আমার পিসেমশাই সুধন্যমোহনের চাকরি ছিল পাকা। শুধু পাকাই নয়, খুব আবছা শুনেছি, অফিসে তাঁর বিশেষ সমাদরও ছিল।

সুধন্যমোহন লেক মার্কেটে বাজার করতে যেতেন প্রতি দিন খুব সকালে। আমি তাঁর কাছেই প্রথম শিখি, বাজার কী করে করতে হয়। যা কিছু কিনতেন সবই বাজারের সেরা জিনিস। মর্তমান কলাটি যে আনতেন, তারও রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ছোটই সংসার ছিল তাঁর, স্ত্রী আর দুই ছেলে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন আদ্যন্ত আত্মীয় ও অতিথিবৎসল। কোনও দিন তাঁদের সংসারে বাইরের লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেনি, এমনটা বড় হত না। বিক্রমপুর বা ময়মনসিংহ থেকে যারা কাজে কলকাতা আসত, তারা সটান এসে সুধন্যমোহন আর সুমতির কাঁধে ভর দিত। সোজা কথায়, তাঁদের দাম্পত্যজীবন ছিল জনাকীর্ণ এবং হট্টমেলা। বৈঠকখানার বালাই নেই, একটার বেশি চেয়ারের জোগাড় নেই, তবু লোকে জলচৌকি, মোড়া, জানলার তাক— কোথাও না কোথাও ঠিকই জায়গা খুঁজে নিত। শুধু তো আশ্রয়স্থলই নয়, অনেক সময় চিকিৎসার জন্যও সুধন্যমোহনের বাড়িতে এসে উঠত তাঁর ‘দ্যাশের’ মানুষ। হোস্টেলে থাকাকালীন আমিও এক বার প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পিসিমার কাছে চলে এসেছিলাম। কী যত্নে যে সেবা করেছিলেন তা বলার নয়।

কিন্তু সুধন্যমোহনকে আমি কোনও দিন এক জন গড়পড়তা মানুষ হিসেবে দেখিনি। সব সময়েই মনে হয়েছে, এই বিশুদ্ধ মানুষটি সাধারণ মানুষের এক লেভেল উঁচুতে। একটু শুচিবায়ু ছিল তাঁর, বড্ড পরিচ্ছন্ন থাকতেন। কারও কাছ থেকে কখনও একটিও অনর্জিত পয়সা নিতেন না। কখনও মিথ্যে কথা বলেননি। কাউকে ঠকাননি কখনও। সোজা কথায়, এক জন অসহনীয় সৎ মানুষ।

অসহনীয় কথাটা বললাম এই কারণে যে, তাঁর ভালমানুষি দেখে আত্মীয়স্বজনরা বিরক্ত হতেন, বিশেষ করে আমার পিসিমা।

পিসেমশাই যখন রিটায়ার করেছেন তখনও কোম্পানি তাঁকে সহজে ছাড়তে চায়নি। কিছু দিন আটকে রেখেছিল, যদিও কোম্পানির সাহেবরা তখন ছিল না, দিশি অবাঙালি মালিক। এর পর পিসেমশাইকে বেশ বেশি টাকার বেতনে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির নির্মাণকার্যে কোনও কোম্পানি থেকে নিয়েছিল। গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটি তখন সবে তৈরি হচ্ছে। নিরালা, নির্জন জায়গা। সেই বিশাল চত্বরে পিসেমশাই একখানা ঘরে একা থাকেন, নিজে রেঁধে খান।

গুয়াহাটির কাছে পাণ্ডু-র মালিগাঁওয়ে তখন আমার দিদি-জামাইবাবু থাকেন। ছুটিতে কয়েক দিনের জন্য দিদির কাছে গেছি। এক দিন পিসেমশাই এলেন। আমাকে দেখে কী একটা আনন্দের হাসি যে হাসলেন! বললেন, আমার বাসায় এক দিন আয়। দিন দুই বাদে বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে খুঁজতে খুঁজতে পিসেমশাইয়ের ডেরায় হাজির হয়েছি। চিন্তিত হয়ে বললাম, এত ফাঁকা, এত নির্জনে থাকেন কী কইরা? পিসেমশাই এক গাল হেসে বললেন, অসুবিধা হয় না।

শুনলাম, বাজার অনেকটা দূর। কাজের লোক না থাকায় বাসন-টাসন ওঁকেই মাজতে হয়। ওঁর এই নির্জনবাস দেখে আমি বেশ দুশ্চিন্তা করছিলাম। তবে পিসেমশাই তাঁর মতো বেশ গুছিয়েই আছেন দেখলাম। প্রাইমাস স্টোভ, কয়েকটা বাসন, ক্যাম্পখাটে সামান্য বিছানা, ব্যস। প্রসন্ন থাকতে তাঁর সামান্য বস্তুরই প্রয়োজন হত।

সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হল, তিনি পুরুষমানুষ হয়েও খবর রাখতেন যে আমি ক্ষীর খেতে ভালবাসি। ওখানে দুধ জোগাড় করা খুব মুশকিল। তাও পিসেমশাই দুধ জোগাড় করে এক বাটি ক্ষীর তৈরি করে রেখেছেন। সঙ্গে বোধহয় চিঁড়েভাজা-টাজা জাতীয় কিছু, এবং সম্ভবত কমলালেবুও। এত দিন বাদে খাবারগুলোর কথা বেশি মনে নেই। কিন্তু ওই অসামান্য মানুষটির অমলিন বাৎসল্যটি খুব মনে আছে।

সর্বদাই দেখতে পেতাম, কাছের মানুষ বা আত্মীয়রা তাঁকে তেমন গুরুত্ব দিত না বটে, কিন্তু বাইরের মানুষজনের কাছে তিনি সাধু-গুরুর সম্মান পেতেন। কাজের জায়গায় মিস্তিরিরা দেখেছি, তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। কারও সঙ্গে তাঁকে বিশেষ উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি কখনও। দুনিয়ায় তাই তাঁর শত্রু ছিল না।

পিসেমশাই এক বার আমাকে বলেছিলেন যে, দীর্ঘ কলকাতা বাসকালে তাঁর এক বার মাত্র পকেটমার হয়েছিল। পকেটমারকে তিনি চিনেওছিলেন, কিন্তু কিছু বলেননি, পাছে পাবলিক মেরে ওর হাড়গোড় ভেঙে দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shirshendu mukhopadhyay anandabazar rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE