Advertisement
E-Paper

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

তাঁকে দেখলে ছোট ছোট ছেলেপুলে তো পালাতই, এমনকী জোয়ান ছেলেমেয়েরাও পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারলেই বাঁচত। উনি ভারী খরখরে। ঝগড়া পেলে মেজ বউ, সেজ বউ, ছেলেছোকরা, কুয়োর বালতি, কিছুই বাদ যেত না। হাওয়া-বাতাসে উড়ে যাওয়া ডাইনি-পেতনি ধরে ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারতেন।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫

তাঁকে দেখলে ছোট ছোট ছেলেপুলে তো পালাতই, এমনকী জোয়ান ছেলেমেয়েরাও পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারলেই বাঁচত। উনি ভারী খরখরে। ঝগড়া পেলে মেজ বউ, সেজ বউ, ছেলেছোকরা, কুয়োর বালতি, কিছুই বাদ যেত না। হাওয়া-বাতাসে উড়ে যাওয়া ডাইনি-পেতনি ধরে ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারতেন।

উনি ছিলেন মায়ের গ্রামতুতো পিসি। রোগা চেহারায় গাছকোমর করে পরা আঁটোসাঁটো মিলের শাড়ি, টান করে বাঁধা উঁচু খোঁপা আর তীক্ষ্ণ নজর চার দিকে। অবিকল কার্টুনে আঁকা দজ্জাল ফিগার। তেনার উপস্থিতিতে পান মোটামুটি চুনের গায়ে লেপটেই থাকত, খসার সাহস হত না। নিরুপিসির একটা শারীরিক ত্রুটি ছিল, তাঁর ঠোঁটের কাছটা ব্যাঁকা ছিল। ছোট বেলায় কারা আমায় বুঝিয়েছিল যে নিরুপিসি মিথ্যে কথা বলেছিল বলেই মুখটা এমন হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে মিছে কথা বলাকে আমি ভারী ভয় পেতাম।

এক বার গরমের ছুটিতে মামার বাড়ির ছাদ জুড়ে হুলুস্থুলু। দিদিমার পুরনো সব তোরঙ্গ রোদে দেওয়া হল। সে কী বলব কবেকার সোনার নিবের কলম, রুপোর রেকাবি, পাতলা মসলিন, মায়েদের ছোট বেলার উলের বিদেশি মোজা, বিদেশি বিস্কুট সিগারেট আর চকোলেটের বাক্স, সত্যিকারের সোনার জরির কাজ করা বেনারসি, কমলা রঙের ছেলেদের শাল, পাকানো পাগড়ি। উল্কার মতো ছিটকে পড়ছে সব গুপ্তধন। আমরা ছোটরা অসম্ভব বেয়াদপি আরম্ভ করে, ‘এটা কী, ওটা কী, এটা আমি নেব’, চেঁচামেচি জুড়েছি, ও মা! কোথা থেকে নিরুপিসি উপস্থিত। অ্যায়সা বকুনি লাগালেন যে চোখের জল আর বাধ মানে না। আদেশ হল, ‘এখুনি নেমে যা সব। না হলে এমন পিঠে পড়বে না!’ এ বার মা ত্রাতার ভূমিকায়, ‘থাক থাক, ওরা তো এ সব কিছুই দেখেনি। দেখতে দাও।’ একটা অদ্ভুত সুন্দর কাজ করা রেশম পাড়ের শাড়ি বেরোল তোরঙ্গ থেকে। দিদিমা বলল, ‘নিরু ঠাকুরঝি, তোমার মনে পড়ে? তোমার দাদা এক রকম এনে দিয়েছিল তোমার, আমার আর শিবানীর জন্য?’

হঠাৎ যেন ঝপাং করে ছাদের ওপর একটা কী নেমে এল, বা হয়তো সূর্যের ফোকাসটা নড়ে গিয়েছিল। খুব মৃদু একটা গলা, নিরুপিসির, ‘আমার আর রেশমপাড় পরা হল কই, রাঙা বউ?’

অনেক বড় হয়ে, এক দিন পুরনো গল্প করতে করতে যখন মাকে খোঁচাই, মা বলে, নিরুপিসির নাকি ছোট বেলায় খুব একটা অসুখ করেছিল, সেই থেকেই মুখ ব্যাঁকা। টোন-টিটকিরি আর খোঁটায় খোঁটায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল একরত্তি মেয়ে। পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার। বিয়ে হচ্ছিল না। পণ দিয়েও না। বাধ্য হয়ে অন্য মেয়েকে দেখিয়ে নিরুপিসির বিয়ের ঠিক হয়েছিল। বিয়ের দিন এক হাত ঘোমটায় মেয়ের মুখ দেখা যায়নি। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দু’দিন পরেই ওরা ফেরত পাঠিয়েছিল নিরুপিসিকে। সে কষ্ট, অপমান সহ্য করতে না পেরে নিরুপিসির বাবা মারা যান। শুধু তা-ই নয়, দিন কয়েক পর খবর আসে নিরুপিসির স্বামীও মারা গিয়েছেন। সব দোষটাই নিরুপিসি সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। বাপের বাড়িতে ঠাঁই জুটেছিল, সঙ্গে গালাগাল আর অপয়া, আঁটকুড়োর খেতাব। অনেক খোঁচা আর কাঁটা সারা ক্ষণই বিঁধে থাকত। জীবনে না ছিল আমিষের ছোঁয়াচ, প্রেম বা শরীরের ডাক। যৌবনের চনচনে টান নিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়া জীবনে রেশম-পাড়ের মোলায়েম আঁচল?

তফাত যাও।

sanchari mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy