ছবি: সুমন চৌধুরী।
চাকরির প্রস্তাবটা ছিল অকিঞ্চিৎকর। মাত্র পঁচিশ দিনের স্টপগ্যাপ ভেকেন্সিতে একটি স্কুলের শিক্ষকতা। তখন তা-ই বা দেয় কে? আমার বন্ধু, ওই স্কুলেই পড়ায়, আমাকে নিয়ে গেল হেডস্যরের কাছে। তখন ওই স্বল্প মেয়াদের চাকরিতে শিক্ষক বহাল করার ক্ষমতা হেড মাস্টারমশাইয়েরই ছিল।
আমার পাশ করার যাবতীয় সার্টিফিকেট ফাইলবন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। জগদীশবাবু অত্যন্ত সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রথমে আমাকে নিরীক্ষণ করলেন, তার পর অত্যন্ত খুঁটিয়ে আমার প্রত্যেকটা মার্কশিট, সার্টিফিকেট ইত্যাদি দেখলেন এবং বারংবার জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি উঁচু ক্লাসে পড়াতে পারব কি না, হাজিরা দিতে দেরি করব কি না, অপ্রয়োজনে কামাই করব কি না। আমি তাঁকে তুষ্ট করার জন্য যা যা বলার দরকার, তা-ই বলে গেলাম। কিন্তু তিনি যে খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছেন, তা তাঁর মুখ দেখে মনে হল না। তবে টিচার্স রুমে গিয়ে বসতে বললেন।
সাধারণত স্টপগ্যাপ ভেকেন্সিতে নিয়োগের তেমন কোনও প্রোটোকল থাকে না। ‘কাল থেকেই লেগে যান’ গোছের ব্যাপার। কিন্তু জগদীশবাবুর কোনও কাজেই ও রকম গা-ছাড়া ভাব নেই। টিচার্স রুমে বসে আমাকে একটা দরখাস্ত লিখে তাঁর কাছে পাঠাতে হল। এবং ঘণ্টাখানেক বাদে আমাকে রীতিমত একটি টাইপ করা নিয়োগপত্র দেওয়া হল। তাতে আমাকে যে মাত্র পঁচিশ দিনের জন্য নিয়োগ করা হচ্ছে, তা আবার আন্ডারলাইন করা। আশার কথা হল, পঁচিশ দিন পর যদি নির্দিষ্ট শিক্ষক কাজে যোগ না দেন, তা হলে আমার মেয়াদ বাড়তে পারে।
পড়াতে গিয়ে আর এক বিপদ। প্রায়ই দেখতাম ক্লাসের বাইরে একটু আড়াল হয়ে জগদীশবাবু দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমার পড়ানো লক্ষ করছেন। আমার বন্ধুকে কথাটা বলতেই সে বলল, ছাড় তো, ওই পাগলা সবার সঙ্গেই ও রকম করে। আমরা আর গ্রাহ্য করি না।
তা কথাটা মিথ্যে নয়। তিনতলা স্কুলবাড়ির একতলা থেকে চারতলা ছাদ পর্যন্ত এক জন লোক সারা দিন সন্দিহান ও সন্ধানী চোখ নিয়ে কী যে দেখে বেড়াতেন, তা কে জানে! তবে দেহে এবং মনে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। এগারোটায় স্কুল বসত, উনি তার আধ ঘণ্টা আগে হাজির হতেন। স্কুল ছাড়তেন সন্ধের পর। আর ওই সময়টুকুর একটি সেকেন্ডও তাঁর কোনও বিশ্রাম ছিল না।
ঝাড়ুদার বা সাফাইকর্মীরা ঠিকমত কাজ করল কি না, কলে জল পড়ছে কি না, বাথরুম পরিষ্কার আছে কি না, অফিসের কাজে কোনও ব্যাকলগ জমে গেল কি না, এ সব নিয়ে তাঁর মাথাব্যথার অন্ত ছিল না। নিরীহ টিচার গোলোকবাবুর ক্লাসে ছেলেরা গণ্ডগোল করত বলে এক সময় তিনি সেই ক্লাসে গিয়ে ব্যাকবেঞ্চে বসেও থাকতেন। এই সব খুঁতখুঁতে ও নিয়মনিষ্ঠ লোকেরা প্রায়ই নিজ পরিবারে খুবই অপ্রিয় এবং বিরক্তিকর বলে পরিগণিত হন। শুনেছিলাম জগদীশবাবুর পরিবারে তাঁকে নিয়ে যথাবিহিত তীব্র অশান্তি আছে। কর্মে সমর্পিতপ্রাণ মানুষেরা সমাজ-সংসারে জনপ্রিয় হন, এমনটা শোনা যায় না। যে সব শিক্ষক ওই স্কুলে দশ-বারো বছর পড়িয়েছেন তাঁরাও কবুল করতেন, জগদীশবাবুকে কেউ কখনও হাসতে দেখেননি। কখনও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে শোনা যায়নি তাঁকে। তাঁর আড্ডা ছিল না, সম্ভবত বন্ধুবান্ধবও নয়। এ থেকে মনে হতে পারে যে, তাঁকে সবাই বোধহয় ভয় পেত। তাও কিন্তু নয়। তাঁকে কেউই খুব একটা সমীহ করত না। বরং তাঁর নিশ্ছিদ্র উপস্থিতি ছিল মৃদু বিরক্তিকর।
এ হেন জগদীশবাবু এক দিন টিচার্স রুমে এসে হাজির। অত্যন্ত উত্তেজিত, অতিশয় নার্ভাস এবং উদ্বিগ্ন। এসেই ঘোষণা করলেন, শুনুন, আমি একটা গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছি। এখন কী ভাবে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই আমি আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি।
আমরা সকলেই সচকিত, কী হয়েছে স্যর?
জগদীশবাবু অত্যন্ত অনুতপ্ত কণ্ঠে বললেন, আজ স্কুলে আসার সময় আমি বাসের ভাড়া দিতে ভুলে গেছি। এ তো অপরাধ। এখন কী করলে এর সমাধান হয়, কেউ কি জানেন?
ব্যাপারটা এমন জলভাত যে এটাকে অপরাধ বলে কারওরই মনে হল না। পিনাকীবাবু বললেন, ও রকম তো ভিড়ের বাসে আমাদের প্রায়ই হয় স্যর। এটা অপরাধ হবে কেন? বিবেকদংশন হলে ফেরার সময় দুটো টিকিট কেটে নেবেন, তা হলেই হবে।
জগদীশবাবু এ কথায় মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, না ওটা কোনও কাজের কথা নয়। স্টেট বাসের ম্যানুয়ালে নিশ্চয়ই এই অপরাধের জন্য কোনও ব্যবস্থা আছে। আপনারা কেউ কি একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন? আমি বড় অপরাধবোধে ভুগছি।
স্টেট বাসের যে কোনও ম্যানুয়াল আছে এবং তাতে যে এ সব সমস্যার সমাধান আছে, তাও কারও জানা ছিল না। সুতরাং সবাই মুখ তাকাতাকি করতে লাগল।
পর দিন অবশ্য দুজন শিক্ষক স্টেট বাসের দুটো ডিপোতে খোঁজখবর নিয়ে এসে জানালেন, স্টেট বাসের ম্যানুয়াল-ট্যানুয়ালের খবর কেউ রাখে না। আইনকানুনও জানা নেই। তবে কেউ কেউ ওই ডবল ভাড়া দেন বটে, যাঁরা বাতিকগ্রস্ত লোক।
জগদীশবাবু বললেন, তা কী করে হয়? দেশে সংবিধান আছে, আইনকানুন আছে। জোড়াতাপ্পি দিলে তো হবে না।
তখন কলকাতায় শুধু স্টেট বাসই চলত। প্রাইভেট বাস নয়। জগদীশবাবু হাল ছাড়লেন না। স্কুলে আসার আগে এবং স্কুলের পরও তিনি বিভিন্ন ডিপোয় হানা দিয়ে তাঁর সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু কেউই তাঁকে নির্দিষ্ট কোনও প্রতিবিধান দিতে পারলেন না।
কিন্তু দিন পনেরোর চেষ্টায় স্টেট বাসের সদর দফতরে গিয়ে বহু ক্ষণ ধরনা দিয়ে বসে, এক জন বড়বাবু গোছের লোককে খানিকটা নরম করতে পারলেন। তিনি জানালেন, ‘হ্যাঁ, ম্যানুয়াল একটা আছে বটে, তবে সেটার পাতা কখনও উলটে দেখা হয়নি।’ জগদীশবাবুর চাপাচাপিতে ম্যানুয়াল খুলে দেখা গেল, স্টেট বাসে ভাড়া না দিলে তার শাস্তি হল, দু’টাকা জরিমানা এবং ভাড়ার পয়সা।
মহা উল্লাসে জগদীশবাবু সে দিনই জরিমানা-সহ বাস ভাড়া জমা করলেন। এবং পর দিন টিচার্স রুমে এসে বিজয়-পতাকার মতো রসিদটি তুলে সবাইকে দেখালেন। দু’টাকা ফাইন ও ভাড়ার রসিদ।
আর আশ্চর্যের বিষয়, সে দিনই পনেরো-ষোলো বছর বাদে তাঁকে প্রথম হাসতে দেখা গেল। যেমন নোবেল প্রাইজ পেলে বা অলিম্পিকে সোনা জিতলে মানুষের মুখে দেখা যায়!
sirshendu_m@rediffmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy