Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঘুষ

নবকান্ত দারোগার বহু দিনের ইচ্ছে, ঘুষ খাবেন। এক বার অন্তত খাবেন। অপেক্ষা করতে করতে চাকরি শেষ হয়ে এল, অথচ আজও ঘুষ খাওয়া হল না। সেই যে দিন পুলিশের চাকরি পেলেন, সে দিন থেকে শুনে আসছেন কথাটা। ঘুষ। নিয়োগপত্র নিয়ে বড় জ্যাঠামশাইকে প্রণাম করতে গেলেন; মাথায় হাত রেখে জ্যাঠামশাই বললেন, মঙ্গল হোক, এ বার একটা বিয়েশাদি করো, আর ঘুষটুস বুঝেশুনে খেয়ো, দিনকাল ভাল নয় মোটেই। বন্ধু পশুপতি বলল, তোর আর চিন্তা কী বল, চাকরি পেলি, ঘুষ যা পাবি, তাতেই তিনতলা বাড়ি উঠে যাবে। অবশ্য তুই যা ভ্যাবাগঙ্গারাম...।

ছবি: দেবাশীষ দেব

ছবি: দেবাশীষ দেব

উল্লাস মল্লিক
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০৬
Share: Save:

নবকান্ত দারোগার বহু দিনের ইচ্ছে, ঘুষ খাবেন। এক বার অন্তত খাবেন। অপেক্ষা করতে করতে চাকরি শেষ হয়ে এল, অথচ আজও ঘুষ খাওয়া হল না।

সেই যে দিন পুলিশের চাকরি পেলেন, সে দিন থেকে শুনে আসছেন কথাটা। ঘুষ।

নিয়োগপত্র নিয়ে বড় জ্যাঠামশাইকে প্রণাম করতে গেলেন; মাথায় হাত রেখে জ্যাঠামশাই বললেন, মঙ্গল হোক, এ বার একটা বিয়েশাদি করো, আর ঘুষটুস বুঝেশুনে খেয়ো, দিনকাল ভাল নয় মোটেই।

বন্ধু পশুপতি বলল, তোর আর চিন্তা কী বল, চাকরি পেলি, ঘুষ যা পাবি, তাতেই তিনতলা বাড়ি উঠে যাবে। অবশ্য তুই যা ভ্যাবাগঙ্গারাম...।

হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে এমন কথা বহুবার শুনেছে নবকান্ত। সে নাকি বড় ভ্যাবা, মস্ত ক্যাবলা, আস্ত আকাট। ইতিহাস প্রশ্ন কঠিন এসেছে, বন্ধু বাসুদেব হোমিওপ্যাথির পুরিয়া মতো কী একটা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই নে, শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। হাতের মুঠোয় ও-ভাবে ময়ূর সিংহাসন পেয়ে ভয়ানক ঘাবড়ে গেল নবকান্ত। তার পর যখন একটা একটা করে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরেছে কাগজটা অমনি বিশ্বেশ্বর স্যর এসে হাত চেপে ধরলেন ছিঃ ছিঃ, নবকান্ত, শেষকালে তুমিও...! চাটুজ্জেদের বাগানে আম চুরি করে সবাই পালাল, ধরা পড়ল কেবল নবকান্ত। বন্ধুরা তাই নবকান্ত না বলে ভ্যাবলাকান্ত বলে ডাকত তাকে।

তাতে অবশ্য দুঃখবেদনা বিশেষ ছিল না তার। লম্বা-চওড়া চেহারা ছিল, উদোম খাটাখাটনি দিতে পারত, আর খেতে পারত অঢেল।

প্রথমে গঙ্গাধরপুর থানায় মেজবাবু হয়ে ঢুকলেন। বেশ কয়েক দিন ঘুষটুস নিয়ে কেউ কিছু উচ্চবাচ্য করছে না দেখে নিজেই এক দিন বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যর, এখানে ঘুষের ব্যবস্থা কেমন? বড়বাবু প্রচণ্ড কড়া চোখে তাকালেন তাঁর দিকে। তার পর বললেন, শুনুন নবকান্তবাবু, এই অঞ্চলের চোর-ছ্যাঁচররা পর্যন্ত আমার সঙ্গে মশকরা করতে সাহস পায় না, আপনি কি না...!

ঘাবড়ে গিয়ে নবকান্ত চুপ করে গেলেন। কয়েক দিন পর কনস্টেবল রবিকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা রবি, ঘুষটুস কেমন চলে এখানে? রবি ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে কাঁদকাঁদ গলায় বলল, বিশ্বাস করুন স্যর, কাটু তোলাবাজকে নিজের ইচ্ছায় পালাতে দিইনি আমি; যা করেছি সব বড়বাবুর নির্দেশে।

ঘুষ ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হল না বটে; কিন্তু নবকান্ত বেশ মজা পেলেন। বুঝলেন, এটা এমন একটা ব্যাপার, ঠিকঠাক খেতে পারলে তিনতলা বাড়ি উঠে যায়, কেউ শুনলে রেগে ওঠে, কেউ আবার ঘাবড়ে যায়।

কিছু দিন পরেই ঘটল সেই ঘটনা। অনেকটা দৌড়ে দাগি ছিনতাইবাজ জিগ্গুকে ধরলেন নবকান্ত। জিগ্গু শেষ মুহূর্তে রিভলভার বের করেছিল। কিন্তু নবকান্তর বারবেল তোলা কঠিন হাতের প্রচণ্ড থাপ্পড় খেয়ে ঘুরে পড়ল। জিগ্গুকে লক-আপে পুরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে এলেন নবকান্ত। দেখলেন, দরজার কাছে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা একটা লোক খুব বিগলিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা মস্ত ইলিশ মাছ। লোকটা ‘হেঁ হেঁ’ করে হেসে বলল, একটু আগে যে জিগ্গুকে ধরেছেন, সেই জিগ্গুকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়; জিগ্গু আসলে বড় ভাল ছেলে।

শুনে খুব রাগ হল নবকান্তর। যে ছেলে পকেটে অস্ত্র নিয়ে ঘোরে সে কিনা ভাল ছেলে! নবকান্ত হুঙ্কার দিলেন, গেট আউট!

তাতে এতটুকু বিচলিত না হয়ে লোকটা বলল, স্যর ইলিশটা কিন্তু একদম টাটকা, কোলাঘাটের মাল স্যর।

নবকান্ত দেখলেন, লোকটা যেন পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে। বুঝলেন, এও এ বার জিগ্গুর মতো রিভলভার বের করবে। তাই সময় নষ্ট না করে প্রচণ্ড এক থাপ্পড়। ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা। ইলিশটা ছিটকে পড়ল পাশে। দু’তিনটে বেড়াল কোথা থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাছটার ওপর।

পরে কনস্টেবল রবি বলল, লোকটা পটা ওস্তাদ। এলাকার তাবৎ চোর-বাটপার-পকেটমারের মাথা। ইলিশটা হচ্ছে ঘুষ। টাকাও ছিল; রিভলভার নয়, টাকা বের করতেই পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল পটা।

নবকান্তর আপশোস হল খুব। ইস্, তার ঘুষটা এ ভাবে বেড়ালে খেল! একটু যদি বুঝতে পারতেন! এমন ভুল আর করবেন না কোনও দিন।

কিন্তু ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিল। চড় খেয়ে বদ্ধ কালা হয়ে গেল পটা ওস্তাদ। তার দল ভেঙে গেল। এলাকায় শান্তি ফিরে এল। সাহসিকতা আর সততার জন্যে পদক দেওয়া হল নবকান্তকে। কিছুদিনের মধ্যে পদোন্নতিও হল তার। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল, নবকান্ত দারোগা ঘুষের যম; তাঁকে ঘুষ দিতে গেলে কান খোয়াতে হবে। ব্যাপারটা বাড়তে বাড়তে এমনও রটল যে, এলাকার যত কালা, তারা কোনও না কোনও সময়ে নাকি নব দারোগাকে ঘুষ দিতে গিয়েছিল।

ব্যস, এর পর নবকান্তর কাছে ঘুষের প্রস্তাব নিয়ে আর কেউ আসেনি। যদিও ঘুষ ব্যাপারটা এখন তাঁর কাছে পরিষ্কার। তিনি অপেক্ষা করে থেকেছেন কেউ দিলেই খেয়ে নেবেন। কিন্তু কান হারাবার ভয়েই বোধ হয় আর কেউ খাওয়াতে আসেনি। আজ চাকরি জীবনের শেষ দিন। মনে একটা আক্ষেপ নিয়েই অবসর নিতে হবে তাঁকে।

স্যর, কী ভাবছেন?

চমকে উঠলেন নবকান্ত। সন্ধে হয়েছে একটু আগে। ঘরে একা বসে আছেন তিনি। আলো জ্বালা হয়নি।

নবকান্ত বললেন, কে?

আমি ভজু, স্যর, চোর ভজু। ক’দিন আগেই চুরি করে পালাবার সময় আপনি তাড়া করেছিলেন; আমার সঙ্গে হাজুও ছিল।

মনে পড়ল নবকান্তর। দুটো চোরকে তাড়া করেছিলেন বটে, কিন্তু ধরতে পারেননি। আসলে বয়েস হয়েছে; আগের মতো দৌড়তে পারেন না আর।

নবকান্ত লাফিয়ে উঠলেন, ব্যাটা চুরি করে আবার ফাজলামি হচ্ছে! আয় তোদের লক-আপে পুরি।

খুক খুক করে একটা হাসির আওয়াজ পেলেন নবকান্ত। তার পর শুনলেন, স্যর, লক-আপে পুরতেই পারেন; কিন্তু তার আগে আপনাকে একটা বিচার করে দিতে হবে।

কী বিচার? বেশ রাগত গলায় বললেন নবকান্ত।

সে দিন আপনি তো স্যর তাড়া করলেন; আমরা ছুটলুম, এই বয়েসেও আপনি কিন্তু দারুণ ছোটেন; ছুটতে ছুটতে আমরাই হাঁপিয়ে পড়ছিলুম, আর আপনি ভুল করে ঢুকলেন ডান দিকের জঙ্গলে।

ইস্, বড় আপশোস হচ্ছে নবকান্তর। বাঁ দিকে ঢুকলেই ধরতে পারতেন ব্যাটাদের। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তাঁর।

হতাশ হচ্ছেন কেন স্যর? ধরতে পারেননি তো কী হয়েছে; আমরা নিজেরাই তো চলে এসেছি আপনার কাছে। কিন্তু বিচারটা আগে করে দিতে হবে।

নবকান্ত বললেন, বল কী সমস্যা।

স্যর পোড়ো বাড়িটায় তো ঢুকলুম; ঢুকেই হাজু পড়ল মাথা ঘুরে। বহু দিনের অনাহারের শরীর তো স্যর, দৌড়ঝাঁপের ধকলটা ঠিক নিতে পারেনি। চিঁ চিঁ করে দু’বার জল চাইল, তার পরেই অক্কা।

অ্যাঁ; বলিস কী!

হ্যাঁ স্যর; তার পর হল কী, আমি দেখলুম চুরির সব টাকা আমার একার, বখরা চাওয়ার কেউ নেই, তখন খুব আনন্দ হল স্যর, আনন্দের চোটে সে দিন রাতেই হোটেলে গিয়ে পোলাও, কোপ্তা, কালিয়া, রাজভোগ, রসগোল্লা সাঁটিয়ে খেলুম, কিন্তু আমারও তো অনাহারের শরীর স্যর, এমন গুরুভোজ সহ্য হল না, ভোর রাতে পায়খানা বমি করে টেঁসে গেলুম।

অ্যাঁ; ব-বলিস কী।

হ্যাঁ স্যর, আপনি ভয় পাচ্ছেন নাকি? আপনার তো দোষ কিছু নেই; আপনার ডিউটি আপনি করেছেন। আর ভূতেরা স্যর চট করে কারও ক্ষয়ক্ষতি করে না; তারা নিজেদের ঝামেলা নিয়েই জেরবার! এই দেখুন, আমাদের দায়ে পড়ে আপনার কাছে আসতে হল। ভয়ের কিছু নেই স্যর; আপনি শুধু বিচারটা করে দেবেন।

একটু সামলে নিয়ে নবকান্ত বললেন, বল তা হলে ব্যাপারটা কী?

স্যর, ভূত হয়ে ওই লোকে গিয়ে দেখলুম, হাজুও আছে। বলল, টাকার ভাগ চাই; দু’জনে করেছি তাই বখরাও আধাআধি! নিয়ম সব জায়গাতেই সমান। তা স্যর দিলুম ওকে; পাঁচ হাজারের অর্ধেক আড়াই দিলুম। কিন্তু ও বলছে পাঁচ নয়, দশ ছিল; আমি ওকে বঞ্চিত করেছি; আপনি স্যর বলে দিন কত ছিল।

তাই তো, কত ছিল! ভাবতে লাগলেন নবকান্ত। যার টাকা সে অভিযোগ লিখিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন মনে পড়ছে না।

হঠাৎ ফিসফিস করে কানের কাছে ভজু বলল, পাঁচ বলুন স্যর, আপনাকে শতখানেক দেব’খন।

তখনই অন্য কানে আর একটা ফিসফিসানি, দশ বলুন স্যর, আমি দেড়শো দেব।

পাঁচ বলুন স্যর; দুই করে দিচ্ছি আমি।

দশ স্যর, দশ। তিন দেব।

বাহ্, এ তো বেশ ব্যাপার। আনন্দে মাথা নাড়লেন নবকান্ত।

আমি স্যর, সাড়ে তিন।

স্যর, আমি চার।

স্যর, আমি পাঁচ। মাইরি বলছি স্যর।

কিছু বলছেন না নবকান্ত। শুধু মিটিমিটি হাসছেন আর মাথা নাড়ছেন। নাহ্, আপশোস আর থাকল না কিছু। এখন দেখতে হবে কত দূর ওঠে বেট্টা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE