ছবি: শুভময় মিত্র
ব্ল্যাক হোল দেখেছ? ব্ল্যাক হোল?’ চেরা গলায় এটা বলামাত্র নানা রকম গালাগালির হল্লা শুরু হয়ে গেল, তার মধ্যে ছোটদের হাসিও রয়েছে। ‘ব্ল্যাক হোল বোঝো?’— শব্দগুলো চাপা পড়ে গেল মারাত্মক আমুদে অনেকগুলো চিৎকার দিয়ে বোনা কম্বলের তলায়। এর সঙ্গে একটা ফটাফট, ধপাধপ শব্দ। ভাঙা কাঠ, ইটের টুকরো ছুড়ছে কেউ কেউ, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে, একটু কাছে যেতে বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কী ঘটেছে।
একটু রাত হলে বড় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। পাগলের মতো লাল কাপড় ওড়ানো ট্যাক্সি বা দমাদ্দম স্টিরিয়ো চালানো বখাটে ছেলেদের গাড়ি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। শহরের অন্ধকার খোপ থেকে কখনও কুকুররা বেরিয়ে আসে বার বার পিছনে তাকানো সন্দেহজনক লোক হাঁটতে দেখলে। ছোট রাস্তা আরও ভয়াবহ রকমের নির্জন। কোথাও মাথাগরম ল্যাম্পপোস্টও থাকে না। স্রেফ ক’টা নীল বা গোলাপি চৌখুপির মধ্যে থেকে টিভির আওয়াজ শুনে বোঝা যায় মানুষ আছে আশেপাশে। এই রকম একটা রাস্তায় ঢুকেছিলাম, শর্টকাট করব বলে। হাঁটছিলাম। ফুটপাত নেই। রাস্তা যেখানে বাড়ির দেওয়ালকে ধরে ফেলেছে, সেখানে পর পর ঠাকুর-দেবতাদের চৌকো টালি গুনতে গুনতে এগোচ্ছিলাম। সামনের বাঁকে হল্লা শুনে চোখ তুলে তাকালাম।
দুটো পুরনো বাড়ির মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে। জায়গাটা একটু উঁচু। ভাঙাচোরা জিনিস, রাবিশ ভর্তি। আগে বোধহয় বাড়ি ছিল। ভেঙে দিয়েছে। আবার হবে একটা। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক, সে-ই চেঁচাচ্ছে। তার মাথার পিছনে লটকে আছে ভিজে চাঁদ। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই অন্ধকারের মধ্যে এক জন আমাকে বলে দিল— ওই পাগলাটা বদমাশ আছে, রোজ রাতে ওখানে যায়। অপকম্ম করে। পাশের বাড়ির লোকের অসুবিধে হয়। বললে গালাগাল দেয়। আজ ধরা পড়েছে। ছাড়া হবে না। বয়স্ক এক জন একটু নরম গলায় বললেন— বড় ঘরের ছেলে। ফুটবল ফুটবল করে মাথা বিগড়ে গেছে। বাড়িতে দেখে না কেউ, ঘুরে বেড়ায় এ দিক ও দিক। ফুটবলের সঙ্গে এত রাতে এই গোলমালের কী সম্পর্ক জিজ্ঞেস করায় উত্তর এসে গেল— ওর টিম নাকি অনেক গোল খেয়ে হেরেছে। সেই নিয়ে কেউ টিটকিরি দিয়েছিল, সেও পালটা বাজে কথা বলেছে। ব্যস, লেগে গেছে ঝামেলা। জুটে গেছে অনেক লোক। টিটকিরির পটকাগুলো এখন বোমার মতো ছোড়া হচ্ছে ওকে লক্ষ্য করে। একতরফা আক্রমণে দিশেহারা লোকটার পিছোনোর বা পালানোর উপায় নেই। চন্দ্রাহত উন্মাদের নিজস্ব বাক্যবাণ ছাড়া আর কী-ই বা আছে, নিজের কথায় জড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গের অন্য গলিতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। পড়েছে ব্ল্যাক হোল নিয়ে।
গালাগালির একটা দীনহীন ইঞ্জিনকে শিখণ্ডী করে লোকটা বলে উঠল— গোল, গোল, গোল। ওই একটাই ব্যাপার জানো, জালে বল ভরেছ, বিরাট কাজ করেছ। মাথায় কী ভরেছ? বোঝো কিছু পৃথিবীর? জানো, সাড়ে তেইশ ডিগ্রি হেলে আছে সবাই? না হেলে থাকলে সব শ্মশান হয়ে যেত। কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা ইটের টুকরো উড়ে গেল, একটা গোঙানির শব্দ শুনে বুঝলাম সেটা লেগেছে। তাই কথাও থেমে গেছে। ওটা ছুড়েছে একটা ছোট ছেলে, আমার ঠিক পাশ থেকে। তাকে খপ করে ধরে থামাতে যেতেই সে রেগে হাত ছাড়িয়ে নিল এক ঝটকায়। এক জন তাকে বাড়িও যেতে বলল প্রশ্রয়ের সুরে। যখন পাওয়াই গেছে এমন একটা লোক, সকলেই চাইছিল ভায়োলেন্সটা চলুক। ওপরে, এ দিক ও দিক জানলাও খুলে গেছে কয়েকটা। হলুদ। সবুজ। সিরিয়ালের চেয়েও উত্তেজক লাইভ ঘটনায় সবারই আগ্রহ বেশি। কোনও একটা বাড়ি থেকে ময়লা ভরা প্লাস্টিকের প্যাকেট পড়ল এ বার, লোকটার গায়ে লাগল না। সঙ্গে সঙ্গে ওটা তুলে নিয়ে সে ছুড়ে মারল জনতার দিকে। সেটা ফেটে গেল। ছড়িয়ে পড়ল নানা রকম আবর্জনা। এটুকুই যথেষ্ট ছিল। আবার শুরু হয়ে গেল প্রতিআক্রমণ। হেঁড়ে গলায় একটা ভয়ানক চিৎকার শুনলাম— বহুত বেড়েছে, দে তো, একদম মেরে দে। ভয়ানক একটা কিছু ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে আমি ‘ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন না’ বলতে যেতেই এক জন বলল, ‘ও মালকে চেনেন? কী কী করেছে জানেন? ও নাকি টিউশন দিত। বাচ্চা মেয়েদের রাতে আসতে বলত, জানেন? ভাল করে পড়াবে বলে...’, ‘ভাল’ কথাটা বেশ টেনে গোল করেই বলল। ‘মাস্টার বলে তখন কেউ কিছু বলেনি, এখন ছেড়ে দিলে হবে? যান তো আপনি!’
লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছে, দুলছে, কী সব বলেও চলেছে। থামছেও না। বোধহয় বুঝতেও পারছে না কী হচ্ছে। বা তার চেয়েও বড় কথা, কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে যেতে চলেছে। নিজেকে আবার খাড়া করেছে সে, যেন একটা অদৃশ্য লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের দিকে আঙুলটা এক পাক ঘুরিয়ে সে বলল, ‘মোয়াভারত পড়েছ জানোয়ারের দল? পড়েছ? চক্রব্যূহ বোঝো?’
একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনে মুখ ঘুরিয়ে দেখি আরও দুটো লোক আসছে। মোড়ের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তারা একটা বাঁশকে ধরে টেনে আনছে। দেখতে পেয়ে বীভৎস হল্লা উঠল অন্ধকারে। দেখামাত্র বুঝতে পারলাম এ বার কী হবে। এখান দিয়ে না গেলেই হত। মরিয়া হয়ে একে ওকে ডেকে বলবার চেষ্টা করলাম, ‘করবেন না, এটা করবেন না।’ কেউ শুনছেই না। এ দিকে লোকটা হঠাৎ এগিয়ে এল কয়েক পা। এ বারে দেখতে পেলাম তার সঙ্গে একটা ঝোলা ব্যাগও আছে। পকেট থেকে চশমা বের করে পরে ফেলল সে। ব্যাগ থেকে বের করল একটা আধখাওয়া পাউরুটির টুকরো। তার পর হঠাৎ ঘুরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ‘আযাআ’ বলে বিকট চিৎকার ছুড়ে দিল।
সেই চিৎকারে পটাপট বন্ধ হয়ে গেল কয়েকটা জানলা। থমকে গেল লোকজন। ফটাস করে বাঁশটা পড়ল রাস্তার ওপর। গলির অন্য কোণ থেকে শুনতে পাচ্ছি ছুটে আসছে অজস্র নখের আওয়াজ। আসছে কুকুরের দল, তারস্বরে ডাকছে সব। তারা কাছে এসে যেতেই পাবলিক ছত্রখান হয়ে গেল অসভ্য অন্ধকারে। মুহূর্তের মধ্যে কে কোন দরজায় সেঁধিয়ে গেল কে জানে। আমার কোথাও যাওয়ার ছিল না, তাই হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম এক জায়গায়। অল্প আলোতেও কুকুরদের দাঁত আর হ্যা হ্যা জিভটা পরিষ্কার দেখতে পেলাম কয়েক ফিটের মধ্যে।
ওরা আমাকে পাত্তাও দিল না, এক জন আমাকে একটু শুঁকে গেল মাত্র। সবাই মিলে দৌড়ে গেল মার খাওয়া মাস্টারের দিকে। তার পর পা মুড়ে ছাত্রের মতো বসে পড়ল তাকে ঘিরে। উত্তর জানা প্রশ্নের মতো পাউরুটির টুকরো নিয়ে খেলা করতে লাগল সবাই। আর মাঝেমাঝেই মিশকালো বাড়ির ব্যাকড্রপের ওপরে ভেসে থাকা উলঙ্গ নীল চাঁদের দিকে মুখ করে ছুড়ে দিতে লাগল নানা রকম শব্দ। স্পষ্ট দেখলাম, চাঁদ দুলছে, মেঘ খুঁজছে আশেপাশে, একটু আব্রু পাওয়ার আশায়।
suvolama@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy