ম্যাডলি জিনিয়াস। যে কোনও মানে করা যেতে পারে। এক জন পাগল যে কিনা জিনিয়াস। কিংবা এত জিনিয়াস এক জন পাগল ছাড়া কেউ হতে পারে না। আর এই ম্যাডলি জিনিয়াস এর সমার্থক আমার কাছে এক জনই কিশোরকুমার। বন্ধু ছিলেন, কাজও করেছি এক সঙ্গে অনেক। ওঁর সঙ্গে সময় কাটানোকে অনেক রকম ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কঠিন সময় আবার হুল্লোড়ের সময়, অবাক হওয়ার সময় আবার কাজ শেখার সময়, মানুষ চেনার সময় আবার মানুষকে ভুল বোঝার সময়। একটা লোক একই সঙ্গে বিরক্তির কারণ হচ্ছে, আবার শ্রদ্ধাও আদায় করছে। কিশোরদা মাল্টি-ডাইমেনশনাল।
কেউ বাস্তব জীবনে সেন্স অব হিউমারকে এ ভাবে প্রয়োগ করতে পারে, কিশোরদাকে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। ওঁর সম্পর্কে বহু উদ্ভট গল্প চালু আছে, যেগুলো আসলে সত্যি। কারণ ও রকম অ্যাবসার্ড সত্যি এক জন এই রকম মানুষই শুধু তৈরি বা যাপন করতে পারে। এক বার এক প্রোডিউসার ওঁর বাড়ি গিয়েছিলেন। কিশোরদার তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওঁর একটা আশ্চর্য আলমারি ছিল, তার মধ্যে লুকনো সিঁড়ি! কিশোরদা সোজা আলমারি খুলে, সেই সিঁড়ি দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন! প্রোডিউসার খোলা আলমারির সামনে অপেক্ষা করেই চলেছেন। অ্যাবসার্ড ভাবে বাঁচতে গেলে তার পেছনে কতটা পরিশ্রম আর পরিকল্পনা প্রয়োজন, এটা থেকে বোঝা যায়।
‘দো দুনি চার’ সিনেমার শুটিং করছি। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। একটা দৃশ্য ছিল, স্টেশন থেকে কিশোরকুমার বেরোচ্ছেন। ঠিক হল, যে দিন কিশোরদা খান্ডালা আসবেন, সে দিনই ওটা শুট করব। তা হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। নতুন করে শুটিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা ক্যামেরা-ট্যামেরা সাজিয়ে হা-পিত্যেশ করে বসে আছি। সে দিন কিশোরদা এলেনই না। এক দিনের শুটিং স্রেফ বাতিল হয়ে গেল। সময়ের কোনও জ্ঞান ছিল না। সেটে যখন খুশি আসবেন, যখন ইচ্ছে চলে যাবেন। আমরা তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু কিশোরদা আশেপাশে থাকার সময়টা আবার এক্সট্রা ঝলমলে।
শুনলে অনেকেই অবাক হবেন, ‘আনন্দ’ সিনেমার নায়কের রোলটা কিশোরদার করার কথা ছিল প্রথমে। সব কিছু ফাইনাল। শুটিং-এর কয়েক দিন আগে, কিশোরদার এক দিন আসার কথা, সিনেমায় ওঁর লুক কী হবে, ড্রেস কী হবে, এ সব নিয়ে আলোচনা করতে। কিশোরদা এলেন মাথা পুরো ন্যাড়া! আমরা সবাই লিটারেলি স্পিকটি নট। উপরন্তু কিশোরদা সারা অফিসে ঘুরে ঘুরে গান গাইছেন, ‘এ বারে কী করবে ঋষি?’ (ওটা হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালিত ছবি)। অগত্যা, অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে রাজেশ খন্নাকে রোলটার জন্য ফাইনাল করা হল। হয়তো কিশোরদার ওটা অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এ ভাবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে আমি কাউকে দেখিনি। আবার কিশোরদা মানুষটা এমনই ছিলেন, কিছুতেই রাগ করে থাকা যেত না। থাকলে আমারই ক্ষতি। আমি পৃথিবীর একটা রস থেকে বঞ্চিত হতাম কিশোর-রস। যার মাহাত্ম্য, মাদকতা, অনুভূতি, সবই অনন্য।
প্রোডিউসারদের ঝামেলায় ফেলা কিশোরদার একটা ফেভারিট শখ ছিল। সেটা সত্যি সত্যি প্রোডিউসারের ক্ষতি করিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। খানিকটা মজা, খানিকটা ‘জাস্টিস’ আদায়। ‘ভরোসা’ নামে একটা সিনেমার গান রেকডির্ং হবে। রিহার্সাল চলছে অনেক ক্ষণ ধরে। সবাই রেডি। ফাইনাল রেকর্ডিং-এর আগে, কিশোরদা বললেন, ‘একটু চা খেয়ে নিই।’ চা আনতে দেওয়া হল আব্দুল, মানে ওঁর ড্রাইভারকে। এ বার অনন্ত অপেক্ষা। আব্দুল আর চা নিয়ে আসে না। যত বারই বলা হয়, ‘দাদা চলুন, রেকর্ডিং শুরু করি, আব্দুল চলে আসবে’, তত বারই উনি বলেন, ‘আব্দুল এলে, চা খেয়ে, তার পরই যাব।’ অধৈর্য সবাই। আরও বার কয়েক তাড়া পড়ে। কিন্তু কিশোরদা চা না খেয়ে যাবেন না। অবশেষে আব্দুল এল। আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরদা বললেন, ‘চলো, রেকর্ডিং করি।’ আমরা বললাম, ‘চা খেলেন না?’ দাদা কান দিলেন না। গান গাইতে চলে গেলেন। আসলে কিশোরদার কাছে চা খাওয়াটা বড় ছিল না, উনি চাইছিলেন, প্রোডিউসার যেন পয়সা খরচা করে সবার জন্য চা আনান। সেটার জন্যই গোটা নাটক।
প্রদীপকুমার-এর বড় দাদা একটা সিনেমার ডিরেক্টর ছিলেন। বিমলদা প্রোডিউসার। শুটিং-এর ফাঁকে এক দিন কিশোরদা বললেন, ‘বিমলদা, কাল এক জন প্রোডিউসার এসেছিলেন আমার কাছে। আমি তাঁকে বললাম, ছবি সাইন করব, কিন্তু শর্ত আছে। তাঁকে আমার বাড়ি আসতে হবে একটা হাফ-প্যান্টের ওপর একটা কুর্তা পরে। মুখে পান থাকবে, সেই পানের পিক যেন গাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমার বাড়ি এলে, দুটো টেবিল জোড়া করে, একটা টেবিলে আমি দাঁড়াব আর একটা টেবিলে উনি দাঁড়াবেন। তার পর আমরা হ্যান্ডশেক করে, ছবি সাইন করব।’ বিমলদা বললেন, ‘কেন এ সব পাগলামি করো কিশোর?’ কিশোরদা হাঁইহাঁই করে বলে উঠলেন, ‘আরে বিমলদা, আজ সেই প্রোডিউসার এগজ্যাক্টলি ওই রকমই সেজে আমার বাড়ি এসেছিলেন। এ বার বলুন কে পাগল, আমি না ও!’ আমাদের কাছে এ যুক্তির কোনও উত্তর ছিল না।
এই যে এত দূর পাগলামি কিংবা বাচ্চাদের মতো দুষ্টুমি এটা কিন্তু বানানো নয়। এটা ওঁর ভেতরেই ছিল। আমরা যারা প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে উঠি ও বুড়ো হই, তাদের এই হইহই মেজাজ, স্বতঃস্ফূর্ততায় খটকা লাগে। বাঁধা গতের বাইরে ভাবার ক্ষমতা যাদের নেই, তারা কিশোরকুমারকে যে অপার বিস্ময় আর কিছুটা ঈর্ষা নিয়ে দেখবে, আশ্চর্য কী? নিজের মতো করে, নিজের শর্তে জীবন চালানোর জন্য জরুরি যে ধক আর প্রতিভা দুটোই অসম্ভব বেশি ছিল কিশোরদার মধ্যে। এই তীব্রতাকে গ্রহণ করার মতো আধার আমাদের সবার নেই। তবু, কিশোরদার মতো জিনিয়াসকে দূরে সরিয়ে রাখা? সাধ্যি কার?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy