Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

পা ন্তা ভা তে...

গুজরাতি পরিবারের ছেলে। বাড়ি পাক্কা নিরামিষ। ছেলে হার্ডকোর আমিষ। অবশ্য বাইরে। নন-ভেজ ছিল হরির প্রাণ। মানে সঞ্জীবকুমারের। প্রায়ই আমার বাড়ি এসে মাছ-মাংস খেয়ে তো যেতই, মাঝে মাঝে ফোনে ফরমায়েশ আসত, এটা-ওটা আমিষ পদ রান্না করে রাখার জন্য। হরি এসে খাবে। আমি তো সব সময় জো হুকুম!

গুলজার
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

গুজরাতি পরিবারের ছেলে। বাড়ি পাক্কা নিরামিষ। ছেলে হার্ডকোর আমিষ। অবশ্য বাইরে। নন-ভেজ ছিল হরির প্রাণ। মানে সঞ্জীবকুমারের। প্রায়ই আমার বাড়ি এসে মাছ-মাংস খেয়ে তো যেতই, মাঝে মাঝে ফোনে ফরমায়েশ আসত, এটা-ওটা আমিষ পদ রান্না করে রাখার জন্য। হরি এসে খাবে। আমি তো সব সময় জো হুকুম!

হরির সঙ্গে আমার পরিচয় ফিল্মের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার অনেক আগে। ও গুজরাতি নাটক করত, এনটিএ-র সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর আমি আইপিটিএ-র সঙ্গে। তবে এই দুটো দলের বন্ধু ছিল সব কমন। তার পর দুজনেই যখন একটু একটু করে ফিল্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছি, তখন থেকেই একসঙ্গে কাজ করার খুব ইচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই হয়ে ওঠে না। হয় হরি কোনও রোল থেকে বাদ পড়ে যায়, নয় আমি স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে। ১৯৬৮ সালে আমি আর হরি একসঙ্গে কাজ করার প্রথম সুযোগ পেলাম। এর আগে হরি অবশ্য কয়েকটা ছোট রোলে অভিনয় করেছিল। কিন্তু ‘সংঘর্ষ’ হল ওর জীবনের প্রথম বিগ ব্রেক। ওর বিপরীতে অভিনয় করবেন কে? দিলীপকুমার। প্রথম শট, দুজনে বসে দাবা খেলছে। হরি কিন্তু বিরাট নার্ভাস বা আপ্লুত, কোনওটাই ছিল না। রিহার্সাল হল। দিলীপকুমার সব দেখে নিলেন, কোথায় ক্যামেরা, ওঁকে কতটা দেখা যাবে, উনি কতটা টাইম নেবেন। টেক শুরু হল, হরি শট দিচ্ছে। যতটা সময় নেওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি নিল, তাকাল দিলীপকুমারের দিকে, তার পর দাবার বোর্ডের দিকে, এবং মুচকি হেসে চালটা দিল। এর অর্ধেকটাও হরি রিহার্সালে করেনি। আমরা সবাই অবাক। পরিচালক হতভম্ব। কিন্তু এত ভাল শট, ‘কাট’ বললেন না। এমনকী অবাক দিলীপকুমারও। ওই রকম দাপুটে অভিনেতার সঙ্গে প্রথম শটে কেউ যে এত মাস্তানি দেখাতে পারে, এ কথা অন্য কেউ বললে, বলতাম, ‘ইতনা ঝুট তো মত বোল ইয়ার।’

আমার পরিচালনায় হরির সঙ্গে প্রথম কাজ, ‘পরিচয়’ সিনেমায়। সেখানে ও জয়াজির বাবার রোলে অভিনয় করেছিল। খুব দুঃখ হয়েছিল হরির। ‘তুই আমায় প্রথম সিনেমায় বাবা বানিয়ে দিলি?’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘You are born old. ম্যায় কেয়া তুঝে বুড়া বনাউঙ্গা? ইয়াদ হ্যায় তুঝে পৃথ্বীরাজ কপূর ভি পহচান নেহি পায়ে থে?’ হয়েছিল কী, ইবসেন-এর একটা নাটকে হরি বৃদ্ধ বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। বিখ্যাত অভিনেত্রী লীলা চিটনিজ করেছিলেন হরির স্ত্রীর ভূমিকায়। আর লীলা চিটনিজের বড় ছেলে, যে হরির চেয়ে অন্তত কিছু না হলেও পনেরো-কুড়ি বছরের বড়, সে করেছিল হরির বড় ছেলে। নাটকটা পৃথ্বীরাজ কপূর দেখতে এসেছিলেন। নাটক শেষ হওয়ার পর সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে, হরির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় বললেন, ‘তোমরা সবাই খুব ভাল করেছ, কিন্তু বৃদ্ধের ভূমিকায় যে অভিনয় করেছে, সে দারুণ করেছে। ওকে এক বার ডেকে দেবে?’ শুনে হরি আনন্দে আত্মহারা। কোনও মতে বলেছে, ‘আজ্ঞে, আমিই সেই বৃদ্ধ।’ পৃথ্বীরাজ কপূর তো অবাক। উনি সে দিন বলেছিলেন, ‘তুম বহত দূর তক যাওগে।’

‘পরিচয়’ রিলিজ করার সাত দিনের মধ্যে ‘কোশিশ’ রিলিজ করার কথা। ‘পরিচয়’-এ হরি জয়ার বাবা, আর ‘কোশিশ’-এ জয়ার স্বামী। হরি আমায় খুব চিন্তিত হয়ে বলল, ‘দর্শক কী ভাববে? আমি সাত দিন আগে এক জনের বাবা, সাত দিন পর, তারই বর! আমার ইমেজ কী হবে? কোশিশ অন্তত আর দু’সপ্তাহ পিছিয়ে দে।’ তখন আমার প্রোডিউসার খুব ভাল বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যদি অভিনেতা দুর্দান্ত হয়, দর্শক তখন চরিত্রটাকে দেখে, অভিনেতাকে নয়। আর অভিনেতা যদি খারাপ হয়, তখনই দর্শক অভিনেতাকে দেখে, চরিত্রটাকে নয়। আমার মনে হয় হরি খুব ভাল অভিনেতা, ওকে টেনশন করতে বারণ করো।’ সেটা মিলে গেল, যখন হরি ‘কোশিশ’-এর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেল।

কিন্তু মুশকিল হল, হরির সব ভাল, মানুষ ভাল, অভিনেতা ভাল, সেন্স অব হিউমার তুলনাহীন, কিন্তু পাংচুয়াল শব্দের ধারপাশ দিয়ে সে যেত না। ‘নমকিন’ সিনেমার শুটিং করছি, রোজই হরি দেরি করে আসে। সকালে সে কিছুতেই উঠতে পারে না। অথচ তিন জন অসামান্যা অভিনেত্রী, ওয়াহিদা রেহমান, শর্মিলা ঠাকুর আর শাবানা আজমি সকাল থেকে মেকআপ করে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক করে রোজ অপেক্ষা করেন। আমি আবার কেউ দেরি করে এলে বকাবকি করতে পারতাম না। আমার স্টাইল ছিল অন্য। কেউ দেরি করে এলে, আমি রিফ্লেক্টরের পেছনে Impunctuality is Immorality. Be punctual, keep your moral alive লিখে, সেই রিফ্লেক্টরটা ফিট করে দিতাম— যে দেরি করে এসেছে তার সামনে। এক দিন তিন জন ম্যাডাম আমায় এসে বললেন, ‘আমরা দেরি করে এলে তো সামনে রিফ্লেক্টর টাঙিয়ে দাও। আর হরির বেলায় কিছু বলো না কেন?’ আমি বললাম, ‘দেখুন, এত বছর ধরে ওকে বলে বলে আমি ক্লান্ত। হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিচ্ছু করতে পারিনি। আপনারা যদি ওকে শায়েস্তা করতে পারেন, খুব ভাল। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে।’ ওঁরা ঠিক করলেন, হরি সেটে এলে কেউ কথা বলবেন না, রাগ দেখাবেন, আর হাসিঠাট্টা-ইয়ার্কি তো বিলকুল বন্ধ।

হরি সেটে এল। আবহাওয়া যে সুবিধের নয়, আঁচ পেল। একটু থতমত খেয়ে থাকল সেই সময়টা। দেরিতে এলে হরি সব সময়ই সেটে ঢুকেই বলত, ‘তু মাস্টার শট লে লে ইয়ার।’ মাস্টার শট-এ অনেকটা দৃশ্য একসঙ্গে অভিনীত হয়ে যায়। ফলে সময় বেঁচে যায়। সে দিনও একটা মাস্টার শট ছিল। শট শুরু হল। আর এখন বললে সব স্বপ্ন মনে হয়, শট যখন শেষ হল, তখন তিন জন অভিনেত্রী, যাঁরা এত ক্ষণ রাগ করেছিলেন হরির ওপর, গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন হরিকে। সবাই অসম্ভব উচ্ছ্বসিত। এত ভাল শট দিয়েছে, এত ভাল অভিনয় করেছে হরি।

ওর অভিনয় দেখে মনে হয়, ও যেন অভিনয় করছে না। বরং অভিনয় এসে ওর পায়ে পড়েছে: আমায় একটু আপনার আত্মায় স্থান দেবেন স্যর? আমি তা হলে ধন্য হই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar gulzar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE