নেহরু, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।
প্রতিবেদক: ক’বছর আগেও আপনিই ছিলেন ভারতের রাজনীতির আকাশে সবচেয়ে গ্ল্যামারাস নেতা। আর আপনারই ১২৫তম জন্মদিনের বছরে কিনা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পটেলকে লড়িয়ে দেওয়া হল?
নেহরু: ভালই তো! এই সুযোগে তবু লোকে ইতিহাসের বইগুলো তাক থেকে নামিয়ে, ধুলোটুলো ঝেড়ে একটু নাড়াচাড়া করছে! বল্লভভাইয়ের শেষকৃত্যে আমি ছিলাম কি ছিলাম না, তা নিয়ে ইংরেজি চ্যানেলে ইয়াল্লম্বা প্যানেল ডিসকাশন হচ্ছে! তা ছাড়া দেশসুদ্ধ সব্বাই তো আর বিপ্লবী শ্যামজি কৃষ্ণবর্মার সঙ্গে আমার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননকে গুলিয়ে ফেলবেন না! কেউ কেউ আর্কাইভ আর তর্কবিতর্কের আড়াল থেকে সত্যিটা খুঁজে পাবেন।
প্রতি: আপনি এখনকার প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাস-জ্ঞান নিয়ে খোঁচা মারতে চাইছেন, বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা তো ঠিক, পটেল-ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে তিনি একটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংশোধন করতে চাইছেন?
নেহরু: কীসের ভুল?
প্রতি: ‘স্বাধীন ভারতের রূপকার’ হিসেবে সর্দার পটেলকে ঠিকঠাক মর্যাদা না দেওয়া! দেশে-বিদেশে প্রচারের সবটা আলো আপনার মুখে! আর পটেল-সুদ্ধ বাদবাকি সব্বাই অন্ধকারে!
নেহরু: তা হলে শুধু পটেলের নামটাই বার বার উঠছে কেন? অন্য ‘বঞ্চিত’দের কথা বলা হচ্ছে না কেন? তোমাদের প্রধানমন্ত্রীজি মওলানা আবুল কালাম আজাদের নাম বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আবদুল কালাম বলে ফেলবেন, তাই? না কি, পুরোটাই গুজরাত-অস্মিতার ব্যাপার? বল্লভভাই গুজরাতের ভূমিপুত্র, নরেন্দ্রভাইও তাই! তবে এমন প্রাদেশিক ‘ভাইচারা’র কথা শুনলে যিনি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাতেন, তাঁর নাম বল্লভভাই পটেল। তিনি প্রাদেশিক পরিচয়ের আগে রাখতেন জাতীয় পরিচয়কে। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে তাঁর মতের বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল ১০০ ভাগ খাঁটি!
প্রতি: বিজেপিও তো এই কথাটাই বলছে। অমন এক জন খাঁটি জাতীয়তাবাদী নেতা যদি আপনার জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর তখ্তে বসতেন, তা হলে পাকিস্তানকে দু’বছরে ঠান্ডা করে দিতেন! কাশ্মীর ইস্যু তুড়ি মেরে সাল্টে দিতেন! দেশের উত্তর-পূর্বে নাগা-মিজো-মণিপুরিরা কেউ ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারত না। ওখানকার জঙ্গিদের মদতদাতা লাল চিনকেও পালটা লাল চোখ দেখাতেন! আপনার মতো ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ করতে গিয়ে ’৬২-র যুদ্ধে ল্যাজেগোবরে হতেন না!
নেহরু: হয়তো ঠিকই। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের প্রথম সতেরোটা বছর আমি প্রধানমন্ত্রী থেকেছি। সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা মানে, সবচেয়ে বেশি ভুলের দায়ও আমার। আমি প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত পেরিয়ে, সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে স্থায়ী শান্তি কিনতে পারিনি। কাশ্মীরের ব্যাপারে আমি সেখানকার মানুষের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলাম। চিন-এর ব্যাপারে পঞ্চশীল-এর নীতিতে ভরসা রেখেছিলাম। ঠান্ডা যুদ্ধে আমি সোভিয়েতের শিবিরে ঢুকিনি, আমেরিকার কাছেও মাথা বিকোইনি— জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল, একটা সদ্য-স্বাধীন দেশ কবজি বা পকেটের জোরে যতই পিছিয়ে থাকুক, অন্তত আদর্শের জোরে গোটা দুনিয়ার সামনে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক!
প্রতি: ওইটাই তো আপনার মুশকিল! আপনি গুচ্ছের নীতি, আদর্শ, বিশ্বাসফিশ্বাসের পুঁটুলি নিয়ে রাজনীতি করতে এসেছেন। যেখানে ঝটপট কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলা দরকার, আপনি কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, তাই নিয়ে সাতপ্যাঁচ ভেবে ফালতু সময় নষ্ট করেছেন। অথচ সর্দার পটেলের ‘মোডাস অপারেন্ডি’ ছিল ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’! সাধে কি মোদী ওঁকে ‘আইডল’ মেনেছেন?
নেহরু: অবশ্যই বল্লভভাই গুরু মানার মতোই মানুষ। ওই মুহূর্তে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যা করা উচিত ছিল, উনি সেটাই করেছেন। সাহসের সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। যদিও আমরা গাঁধীজিকে বাঁচাতে পারিনি, তবু অনেকগুলো কাজই করা গেছে। তার পুরো কৃতিত্বই সর্দারের। ভুলের দায়ভার আমার। কিন্তু ‘রিয়েল পলিটিক’-এ আদর্শবাদ একটা বেফালতু ব্যাপার, এ ভাবনাও ঠিক নয়। তা ছাড়া পটেলের সঙ্গে আমি শুধু ঝগড়া করেছি, তাঁর সব কাজে ব্যাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছি, এ রকম ধারণাও মস্ত একটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দফতরে নিশ্চয়ই সর্বেসর্বা। কিন্তু বল্লভভাইয়ের মতো এক জন একনিষ্ঠ কংগ্রেসকর্মী তাঁর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনও কথা না বলে, পরামর্শ না করেই নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন, এটা খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? না তাতে সর্দারের সম্মান বাড়ে?
প্রতি: কিন্তু এটা তো মানবেন, রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান বা বাস্তববোধ আপনার থেকে পটেলের কিছু বেশিই ছিল?
নেহরু: সেটা তো আমরা দুজনে কেউ মেপে দেখিনি। একটা কঠিন সময়ে আমরা পাশাপাশি একসঙ্গে যে যার নিজের কাজ করেছি। কিছু ব্যাপারে হয়তো মতে মেলেনি, কিন্তু কাজও আটকে থাকেনি! আমার মনে হয়েছিল, ভারতের মতো দেশে হিন্দু মেজরিটিজ্ম-কে মাথায় চড়তে দিলে সেটা যে কোনও সময় ফ্যাসিবাদের চেহারা নিতে পারে। পটেল হয়তো সে ভাবে ব্যাপারটাকে দেখেননি। কিন্তু তা বলে বিজেপি যদি তাঁকে সাভারকর-গোলওয়ালকর-দীনদয়াল উপাধ্যায়দের সঙ্গে একই সোফায় বসাতে যায়, ভয়ানক ঠকবে। গাঁধীহত্যার পর আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করার ঘোষণাটা কিন্তু বল্লভভাইয়ের কলমেই লেখা হয়েছিল!
প্রতি: তবে এটা তো ঘটনা, সর্দার পটেল গুজরাতের রোদ-খরা-রুক্ষতা থেকে উঠে আসা কৃষক নেতা— ‘লৌহপুরুষ’। সেখানে আপনি সোনার চামচ মুখে জন্মানো, ইটন-হ্যারো-কেমব্রিজে কৈশোর-যৌবন কাটানো ননীর পুতুল। আপনার তথাকথিত মুক্ত উদার গণতান্ত্রিক আদর্শবাদ আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক এলিটিজ্ম। সে জন্যই কি নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের রাজনীতিতে আমরা এর ‘ব্যাকল্যাশ’ বা উলটো চলন দেখেছি? ওই এলিটিজ্মের পালটা রাজনীতি করেই তো লালু, মমতা উঠে এসেছেন, আর এখন প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে এক জন ‘চায়ওয়ালা’?
নেহরু: আমি কখনওই মনে করি না, একটা ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বা একখানা ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ না লিখলে, কেউ ভারতের প্রধামন্ত্রী হওয়ার যোগ্য হবেন না! কোনও আঞ্চলিক নেত্রী যদি জেনেই থাকেন, আমি মাঝরাত্তিরে স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার অভিজ্ঞতা নিয়েই ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ নামে কোনও বই লিখেছি, তাতেও তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা এতটুকু কমে না। তবে আমার মনে হয়, যাঁরা রাজনীতি করতে আসছেন, নিজের দেশটা আর তার চারপাশটা সম্পর্কে তাঁদের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। সে জন্যেই আমি অজস্র চিঠি লিখে গেছি। আমার মেয়েকে, আমার মুখ্যমন্ত্রীদেরও। তাঁরা সেগুলো কতটা পড়েছেন, কতটা কাজে লাগিয়েছেন, আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এই কমিউনিকেশনটা খুব জরুরি। লম্বাচওড়া ডিগ্রির দরকার নেই, তবে লেখাপড়ার পাটটা যেন রাজনীতি থেকে উঠে না যায়। এটাকে যদি কেউ ‘এলিটিজ্ম’ বলে, আমি নাচার।
প্রতি: কিন্তু আপনি এই যে গুচ্ছের লেখাপড়া করে, ভারতবাসীর গণতান্ত্রিক বিবেককে এত জাগানো-টাগানোর চেষ্টা করলেন, অথচ দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু মূর্তিটা তো বসছে সর্দার পটেলের। এটা আপনার হার বলে মনে হয় না?
নেহরু: হাহাহা। আরে সে তো সারা দেশে ইন্দিরা, এমনকী রাজীবের মূর্তির সংখ্যাও আমার চেয়ে অনেক বেশি। বোধহয় মায়াবতীরও। মূর্তির সংখ্যা আর উচ্চতা দিয়ে কি রাজনীতির হারজিত হয়? আমি তো ভেবেছিলাম আমার আমলে তৈরি মস্ত মস্ত পি.এস.ইউ বা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোই আমার জয়ের স্মারক হয়ে থাকবে। কিন্তু আমার সাধের কংগ্রেস পার্টিই তো আমার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিসুদ্ধ সেগুলোকে ডকে তুলে দিল! আমি সে দিনই গোহারা হেরে গেছি। পটেলের ১৮২ মিটার মূর্তি আর আমায় নতুন করে কি হারাবে?
sanajkol@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy