Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ফুড়ুৎ আর ফাড়াৎ

ঘণ্টুকে আদর করে দিদুন বলল, জানিস তো আমার বন্ধু আলো ফোন করেছিল। তার বাগানে টুনটুনি বাসা বেঁধেছে। আর তারই মধ্যে চারটে ডিম। শিগ্গির দেখতে ডেকেছে। জিজ্ঞেস করল, টুনি পাখি— সেই রাজা খেল ব্যাঙ ভাজা? দিদুন হাসল। বলল, এ বার সত্যিকারের টুনি দেখতে পাবি। ঘণ্টুর মাকে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে নাকচ। দিদুন বলল, শনি-রবি তো ছুটি।

মন্দার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩০
Share: Save:

ঘণ্টুকে আদর করে দিদুন বলল, জানিস তো আমার বন্ধু আলো ফোন করেছিল। তার বাগানে টুনটুনি বাসা বেঁধেছে। আর তারই মধ্যে চারটে ডিম। শিগ্গির দেখতে ডেকেছে। জিজ্ঞেস করল, টুনি পাখি— সেই রাজা খেল ব্যাঙ ভাজা? দিদুন হাসল। বলল, এ বার সত্যিকারের টুনি দেখতে পাবি। ঘণ্টুর মাকে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে নাকচ। দিদুন বলল, শনি-রবি তো ছুটি। মা বলল, ওরে বাবা সোমবার স্কুল। ঘণ্টুকে নিয়ে তার মা বাড়ি চলে যেতেই, দিদুন সুটকেস গুছিয়ে ফেলল। শুক্রবার ইস্কুল থেকে ফেরার পর ঘণ্টুদের বাড়ি গিয়ে দিদুন বলল, অনেক দিন তোদের কাছে থাকা হয়নি, তাই এই শনি-রবিটা এ বাড়িতে কাটাব। ঘণ্টুর মা বলল, তার জন্যে সুটকেস? দিদুন হাসল।

রাতে ঘণ্টুর পাশে শুয়ে নাক কাটা রাজার গল্পটা বলে ঘণ্টুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট নোটপ্যাড আর কলম বার করে একটা চিঠি লিখল দিদুন, ঘণ্টুর বাবা-মাকে। ‘তোমাদের আলোমামার বাগানে টুনি পাখির বাসা দেখার নেমন্তন্ন। আমি আর ঘণ্টু চললাম। চিন্তা কোরো না। রবিবারে ফিরব।’ ঘুম থেকে তুলে দিল দিদুন। ঘণ্টু বলল, কেন তুলছ? দিদুন বলল, চল একটু বেড়িয়ে আসি। ঘণ্টু এককথায় রাজি। চিঠিটা খাবার টেবিলে নুন-মরিচদানির নীচে রেখে, সুটকেসটা নিয়ে দিদুন বেরিয়ে পড়ল, ঘণ্টুর হাত ধরে। ঘণ্টুর বাবা-মা এখনও ঘণ্টাখানেক ঘুমোবে।

নীচে এসেই ঘণ্টু দেখল, দিদুনের গাড়ি নিয়ে সঞ্জিতকাকু দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িতে উঠেই ঘণ্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখল, চোখ জুড়ে সবুজ গাছ। রাস্তার ধারে ধারে দাঁড়ানো গরু, ছাগল, কুকুর দেখতে দেখতেই এসে গেল ঘণ্টুর আলোদাদুর বাগানবাড়ি ‘বনবাতাস’। মস্ত মস্ত গাছের মধ্যে একটা জায়গা, পাঁচিল ঘেরা। দিদুন বলল, এটাকে বলে হোম স্টে। এখানে অনেকে বেড়াতে আসে। গাড়ির হর্ন শুনে বেরিয়ে এলেন আলোদাদু। ঘণ্টুকে অনেক আদর করলেন। তাঁর কোল থেকে ঘণ্টু দেখতে লাগল, লালা মাটির রাস্তা আর ফুলের বাগান। দিদুন বলল, কই, বাসাটা কোথায়? আলোদাদু বলল, চলো খাওয়ার ঘরের কাছে, বাতাসে দুলছে। কিন্তু শব্দ করবে না আর ছবি তুলবে না। ওরা ভয় পেয়ে যাবে।

খাবার জায়গার সামনে লতিয়ে উঠেছে বুগেনভিলিয়া। তারই একটা ডালে দুলছে টুনিদের বাসা। দিদুন বলল, দেখ ঘণ্টু, কী চমৎকার। পেঁয়াজের খোসা আর মাটি দিয়ে বাসাখানা বেঁধেছে। তাই বাসাটার রংও হয়েছে ধূসর আর পেঁয়াজি রঙের এক অপূর্ব ডুরি নকশায়। কিছুক্ষণ পরই ঘণ্টু দেখল দুটো পাখি বাসার কাছে উড়ে উড়ে আসছে। দিদুন চিনিয়ে দিল, ওই দেখ মা-পাখিটা ফুড়ুৎ, বাবা-পাখিটা ফাড়াৎ আর বাসার ভেতর ডিমগুলো কড়মড় কড়মড়। ঘণ্টু ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল শস্স্— চুপ। ওরা ভয় পাবে না!

দিদুন আর ঘণ্টু দুপুরের খাওয়া সেরে বিশ্রাম করতে লাগল। বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে, ঘণ্টুকে তাড়া মেরে তুলে দিল দিদুন। খাবার জায়গায় এসে দেখে, আলোদাদু বসে আছেন দিদুনের সঙ্গে চা খাবার জন্যে। ঘণ্টুকে দেখেই দাদু বললেন, ওই দিকে দেখ, টুনির বাসার আড়াল দিয়ে সূর্যটা কেমন ডুবে যাচ্ছে। সে দেখল মস্ত একটা মাঠ পেরিয়ে দূরের গ্রামে সূর্য ডুবতে। দিদুন বলল এটাকে বলে প্রান্তর। আলোদাদু বললেন, কালকেই ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বেরোবে। পাখি দুটো ঠোঁট দিয়ে টুকটুক করে ঠুকরে ঠুকরে ফাটিয়ে দেবে আর তখনই ছানাগুলোর ন্যাড়া ন্যাড়া মাথা দেখা যাবে। ঘণ্টু অবাক হয়ে দেখতে লাগল আস্তে আস্তে কেমন বাসার চার পাশটা অন্ধকার হয়ে গেল। বাবা টুনি আর মা টুনি ডানা মুড়ে গুটিসুটি হয়ে ঢুকে গেল বাসায়।

সন্ধের আলো জ্বলে উঠেছে সারা বাগানে। হঠাৎ আলোদাদুর পোষা শিম্পু বাঁদরটা ডেকে উঠল। দূরে গাড়ির হর্ন। আলোদাদু বললেন, দেখ কে আসছে। শিম্পু দৌড়ল, পাঁচিল টপকে রাস্তার মধ্যিখানে। দেখা গেল ঘণ্টুর মা এসেছে হন্তদন্ত হয়ে। মা তো ঢুকেই দিদুনকে খুব বকতে লাগল। ঘণ্টু বলল, শস্স্— চুপ। কথা বোলো না। ওরা ভয় পেয়ে যাবে। চায়ের কাপ হাতে মা বসতে না বসতেই আলোদাদুর পোষা ষাঁড় শুভ ডেকে উঠল হাম্বা! সঙ্গে শিম্পুর কিচকিচ। আলোদাদু গাড়ির হর্ন শুনেই বুঝলেন আবার কেউ এসেছে। দেখা গেল, ঘণ্টুর বাবা উপস্থিত। মাকে খুব বকল, এ ভাবে একা চলে আসবার জন্যে। ঘণ্টু বলল, শস্স্— চুপ। ওদের ঘুম ভেঙে যাবে! মায়ের পাশে বসে বাবা চায়ে চুমুক দিতেই আলোদাদুর মেয়ে বাবলি ডেকে উঠল ভৌ ভৌ। আলোদাদু বুঝলেন আবার কোনও গাড়ি আসছে। দেখা গেল, ঘণ্টুদের বাড়ির কাজের মাসিরাও এসে পড়েছে। তারা এসে বলতে লাগল, কী ভাবে শেষে খুঁজে পেল আলোদাদুর ‘বনবাতাস’ বাগানবাড়িটা। ঘণ্টু তাদের গিয়ে বলল, শস্স্—চুপ করো। পাখিরা সবাই ঘুমোচ্ছে! সোমামাসি, কাজলমাসি, রীতা, বিশু এরা সবাই চা নিয়ে বসতে না বসতেই ‘প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক’ করে ডাকতে লাগল চার-পাঁচটা ধবধবে সাদা রাজহাঁসের দল। গাড়ির হর্ন শুনেই আলোদাদু বললেন, মনে হয় ‘হোম স্টে’র জন্যে কোনও বড় গাড়িতে লোক আসছে। গেট খুলতেই দেখা গেল একটা ট্রাভেল বাসে ভর্তি হয়ে চলে এসেছেন ঘণ্টুর দাদু, আম্মা, কাকাদাদু, ডুমদাদু, ছোড়দিদা, ছোট খুকুপিসি, বড় খুকুপিসি, মামদিদি, জাম্মু, দাদাভাই আর রঞ্জুদিদু। ‘কী আক্কেল’ বলে আম্মা কথা শুরু করতেই ঘণ্টু ছুটে গিয়ে বলল, শস্স্— চুপ! শব্দ শুনলেই ওরা ভয় পাবে।

রাতে একসঙ্গে খাওয়া হল। সবাই আড্ডায় মশগুল। ঘণ্টু দিদুনকে বলল, ঘুম পেয়েছে ঘরে চলো। দিদুন ঘণ্টুর হাত ধরে ঘরে চলে এল। ঘণ্টুকে সে বলল, কেন চলে এলাম জানো? ভোরবেলা উঠতে হবে। না হলে টুনিদের ফুড়ুৎ-ফাড়াৎ দেখায় কম পড়ে যাবে যে। ঘণ্টুকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দিদুন বলল, টুনিটা কেমন রাজার হাত থেকে প্রাণে বেঁচেছিল। খুব বুদ্ধি ওইটুকু পাখির। ঘণ্টুর চোখে তখন টুনি দুটোর পেঁয়াজি রঙের বাসা, সূর্যাস্তের কমলা আলো আর অন্ধকারের ছায়া।

ভোর না হতেই দিদুন আর ঘণ্টু বাসাটার কাছে এসে বসল। আলোদাদু একটা বড় বাইনোকুলার ঘণ্টুকে চোখ রাখতে বলাতেই বাসাটা একেবারে তার নাকের ডগায় চলে এল। টুনি-মা আর টুনি-বাবা পালা করে ডিমে টুক করে ঠোঁট বসাচ্ছে আর উড়ে উড়ে যাচ্ছে— ফুড়ুৎ-ফাড়াৎ। ডিমগুলো সত্যি সত্যি কড়মড়, ফাটা ফাটা ডিমের মধ্যে থেকে মাথা বার করছে ন্যাড়া ন্যাড়া টুনিগুলো। ঘণ্টু বুঝতে পারল না তিনটে না চারটে ছানা। আলোদাদু বললেন, এ সময়টাই সবচেয়ে ভয়ের। সাপ ঢুকে যায়। কত রকম পোকা, দূষিত বাতাস। বললেন, বাবা-মা তাই বাসাটার ধারপাশেই ওড়াউড়ি করে। ওদের তো নিজেদের জন্যেও খাবার জোগাড় করতে হয়। সকালের চা-পর্ব শেষ না হতে হতেই গেট খুলে ঢুকল বাবাইমামা আর মিঠুমামি। টুনিদের বাসাটা দেখেই ব্যাগ থেকে বড় ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে লাগল। আলোদাদু তাকে বারণ করলেন না। দিদুনকে বললেন, ও বনবাদাড়ে ঘুরে নিঃশব্দে ছবি তুলতে জানে। বাপিমামার ডিজিটাল স্ক্রিনে চোখ রেখে ঘণ্টু হতবাক। বন্ধ চোখের ছানাগুলো কেমন মাথা নাড়াচ্ছে। গায়ে লেগে থাকা ডিমের খোসাগুলি বাবা-মা ঠুকরে ঠুকরে সরাচ্ছে।

এরই মধ্যে ঘণ্টুদের বাড়ির সবাই ফিরে যাওয়ার জন্যে তৈরি। আলোদাদু বললেন, সে কী দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে যাও। বড় বড় শোল মাছ হয়েছে পুকুরে। আর খেতের কুমড়ো-পটল-বরবটি-উচ্ছে। ঘণ্টুর মা রাজি নয়। ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। ঘণ্টু ঘুমিয়ে না নিলে কাল ইস্কুল যাওয়া হবে না। বাবারও একই কথা। ঠিক হল রুটি-তরকারি আর ক্ষীর খেয়ে সবাই রওনা দেবে। দিদুন ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে। ঘণ্টুও বায়না শুরু করল। টুনির ছানাগুলো না ফোটা অবধি সে এখান থেকে যাবে না। আলোদাদু বললেন দিদুনও ছুটি নেয়নি। কালকে তো তারও ক্লাস নিতে হবে। মা রাগ করে বলে ওঠে, এ রকম তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। উনি ভগবান। নাতিকে নিয়ে পালিয়ে এলেন, টুনির বাসা দেখাতে। সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলে। ঘণ্টু বুঝল, দিদুন আসলে একটুও বড় হয়নি। ঘণ্টুকে কাছে ডেকে বাবাইমামা বলল, আজ তোরা চলে যা। আমি তো ক’দিন থাকব। প্রতি দিন ছবি তুলে রাখব। সবগুলো তোর দিদুনকে পাঠাব।

সবাই গাড়িতে উঠে পড়ল। আলোদাদু দিদুনকে পাকা তেঁতুল, সর্ষে, ঢেঁকিছাঁটা চাল, ঘি এ রকম আরও কী সব দিয়ে বললেন, ঘণ্টুকে খায়িয়ো। বললেন, আবার এ ভাবেই কাউকে না জানিয়ে ঘণ্টুকে নিয়ে চলে এসো। তোমাদের এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখব যে কেউ খুঁজে পাবে না। দিদুন হেসে গাড়িতে উঠল। মা আর ঘণ্টুকে হাতছাড়া করেনি। সবার শেষে বাবা উঠে দরজা বন্ধ করতেই একসঙ্গে স্টার্ট নিল চারটে গাড়ি।

কয়েক দিন পর দিদুন ঘণ্টুদের বাড়ি এল। ঘণ্টু ইস্কুল থেকে আসতেই, ল্যাপটপ খুলে সার সার টুনির বাসার ছবি দেখাল। তিনটে ছানা বাসার মধ্যে ঠোঁট ফাঁক করছে। প্রিন্ট আউট দিল দিদুন। আসার সময় দিদুনের কোলে বসে ঘণ্টুর ছবি নিয়েছিল বাবাইমামা। পিছনে দুলছে বেগুনি বুগেনভিলিয়ার ডালে টুনি পাখির বাসা। দিদুন আদর করে বলল, মা পাখিটা? ঘণ্টু বলল, ফুড়্ ফুড়্ ফুড়্ ফুড়ুৎ। আবার বলল, আর বাবা পাখিটা? ঘণ্টু ডানার মতো করে হাত দুটো পিছনে উড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে বলতে লাগল ফাড়্ ফাড়্ ফাড়্ ফাড়াৎ! ফাড়্ ফাড়্ ফাড়্ ফাড়াৎ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE