Advertisement
০২ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১

ভোটের ছড়া

ভোটের নানা আমোদের মধ্যে, দেওয়ালে দেওয়ালে নখ-দাঁত-শিং’ওলা ছড়ার ছড়াছড়ি এই বঙ্গের স্পেশালিটি।১৯৬৯-এর নির্বাচনে দুই প্রতিযোগী দল, কংগ্রেস ও যুক্তফ্রন্ট। আগের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল, তাই বরানগর, ঢাকুরিয়া, যাদবপুরে দেওয়াল জুড়ে কংগ্রেসের ছড়া: ‘যুক্তফ্রন্টে কী পেলাম/ গুলি-বুলি-লাল সেলাম।’ অন্য দেওয়াল লিখন: ‘শুন হে দেশের ভাই/ যুক্তফ্রন্টে গদিই সত্য/ দেশপ্রেম কিছু নাই।’ আর: ‘গত ভোটের ভুলের মাসুল দিলাম ন’মাস ধরে/ ফ্রন্টবাবুদের ভোট দিয়ে টের পেলাম হাড়ে হাড়ে।’ এ ছাড়া, উত্তম-সুচিত্রার ‘শাপমোচন’ ছবির গানের আদলে: ‘শোনো বন্ধু শোনো—/ ফ্রন্টের ঐ ন-মাসের ইতিকথা/ চোদ্দ জনের গোঁজামিলের/ সে এক বীভৎসতা।/ ওদের নীতি নেই/ ওদের স্থিতি নেই/ ভাঁওতা দিতেই— ভুল বোঝাতেই/ ওদের দক্ষতা।’

১৯৯১ সালের একটি দেওয়াল লিখন

১৯৯১ সালের একটি দেওয়াল লিখন

আবীর কর
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

১৯৬৯-এর নির্বাচনে দুই প্রতিযোগী দল, কংগ্রেস ও যুক্তফ্রন্ট। আগের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জিতেছিল, তাই বরানগর, ঢাকুরিয়া, যাদবপুরে দেওয়াল জুড়ে কংগ্রেসের ছড়া: ‘যুক্তফ্রন্টে কী পেলাম/ গুলি-বুলি-লাল সেলাম।’ অন্য দেওয়াল লিখন: ‘শুন হে দেশের ভাই/ যুক্তফ্রন্টে গদিই সত্য/ দেশপ্রেম কিছু নাই।’ আর: ‘গত ভোটের ভুলের মাসুল দিলাম ন’মাস ধরে/ ফ্রন্টবাবুদের ভোট দিয়ে টের পেলাম হাড়ে হাড়ে।’ এ ছাড়া, উত্তম-সুচিত্রার ‘শাপমোচন’ ছবির গানের আদলে: ‘শোনো বন্ধু শোনো—/ ফ্রন্টের ঐ ন-মাসের ইতিকথা/ চোদ্দ জনের গোঁজামিলের/ সে এক বীভৎসতা।/ ওদের নীতি নেই/ ওদের স্থিতি নেই/ ভাঁওতা দিতেই— ভুল বোঝাতেই/ ওদের দক্ষতা।’

যুক্তফ্রন্ট এর উত্তরে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘খুকু ও খোকা’ কবিতার আদলে লিখল: ‘কিল মারেনি, ঢিল মেরেছে!/ তাতেই তোমরা রুষ্ট হলে?/ তোমরা যখন হুকুম দিয়ে/ চালাও গুলি দুষ্ট বলে!/ —তার বেলা?/ তোমরা কেবল শৃঙ্খলা চাও/ আইন করো, চাও বিচার/ বলছ না তো— ব্যর্থ শাসন,/ অক্ষমতার দাও বিচার?/ —তার বেলা?’

তা ছাড়া সেই সময় বামপন্থীরা আরও প্যারডিতে দেওয়াল ভরেছিল: ‘এক যে আছে মজার দেশ/ সব রকমের ভালো/ চালের বদলে খুদ দেয়/ খুদের বদলে মাইলো।’ নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’-এ আছে, ‘কংগ্রেস নেত্রী আভা মাইতি মেদিনীপুরের বুভুক্ষুদের মধ্যে সাধু অভিপ্রায়ে চালিত হইয়া মাইলো বিতরণ করিয়াছিলেন। অমনই কংবিরোধী বামদেবরা গান বাঁধিল— ‘একটি বালিকা চাইলো’-র সুরে— আভাদিদির মাইলো/ সবাই মিলি খাইলো/ উদরাময় হইল।’ এ ছাড়াও ব্যক্তিগত আক্রমণ ছিল: ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুুম সাজে/ সেন প্রফুল্ল, ঘোষ প্রফুল্ল, আর অতুল্য নাচে।’

১৯৭৭-এ ইন্দিরা গাঁধী ভোটে হারার পর, জনতা পার্টি জোট সরকার গড়ে। প্রধানমন্ত্রী হলেন মোরারজি দেশাই, কিন্তু ১৯৭৯ সালে জোটসঙ্গীদের সমর্থনের অভাবে মোরারজি পদত্যাগ করলে ১৯৮০ সালে আবার ইন্দিরা গাঁধী নির্বাচিত হলেন। পরের বিধানসভার ভোটে বাংলার কংগ্রেসিদের দৃপ্ত দেওয়াল লিখন: ‘রায়বেরিলি ভুল করেছিল, চিক্মাগালুর করেনি/ সিপিআইএম মনে রেখো, ইন্দিরাজি মরেনি।’ ইন্দিরা গাঁধীর হার এবং জয়ের নির্বাচনী কেন্দ্র ছিল যথাক্রমে রায়বেরিলি এবং চিক্মাগালুর। মাত্র আড়াই-তিন বছরের ব্যবধানে ইন্দিরা গাঁধীর পুনরুত্থানের নেপথ্যে ছিলেন তাঁর ছোট ছেলে সঞ্জয় গাঁধী। ইন্দিরার জয়কে কটাক্ষ করে বামফ্রন্টের দেওয়াল লিখন: ‘বড়লোকের বেটি লো, সাদা কালো চুল/ বাপের কোটে গোঁজা ছিল লাল গোলাপ ফুল।/ সেই বেটির বেটা লো, পাতলা পাতলা চুল/ দেশ জুড়ে ফুটিয়ে দিল হলুদ সর্ষেফুল।’

ওই ভোটে বামফ্রন্টের প্রত্যয়ী লিখন: ‘হবে বাম হবে বাম হবে বাম হবে হবে।’ কংগ্রেসিদের উত্তর: ‘হবে কষ্ট হবে কষ্ট হবে কষ্ট হবে হবে।’

এর পর দীর্ঘ ৩৪ বছরের পাকাপোক্ত বাম রাজ্যপাট। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময় বিরোধীদের দেওয়াল লিখনই উল্লেখ্য। কংগ্রেসি দেওয়াল লিখন: ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে/ ছাঁদনাতলায় কে?/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ জ্যোতিবাবুর বে।’ বামপন্থীদের জবাব: ‘ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ভাই।/ ইন্দিরাকে ছাঁদনাতলায় সাজিয়ে আনা চাই।’ বিলো দ্য বেল্টের বিকল্প কোনও কালেই নেই। কংগ্রেস এক সময় লিখেছিল: ‘দেহের শত্রু প্যাঁচড়া খোস/ দেশের শত্রু জ্যোতি বোস।’

১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে এল সম্ভবত সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত দেওয়াল লিখন, বফর্স-কেলেংকারি নিয়ে: ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়/ রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।’

আর যে বার তেরো মাসের বাজপেয়ী সরকারের পতন ঘটল, তরুণ তেজপালের নেতৃত্বে তহলকা-র ফাঁস করা রিপোর্ট এবং পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বামপন্থীরা দেওয়াল লিখল: ‘নোটন নোটন মন্ত্রীগুলো ঝোটন বেঁধেছে/ ওপারেতে জর্জ-জায়া ভেসে উঠেছে/ কে দেখেছে? কে দেখেছে? তহলকা দেখেছে।/ তহলকার হাতে ‘ডট-কম’ ছিল ছুঁড়ে মেরেছে/ উঃ দিদির বড্ড লেগেছে।’

২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের লিখন: ‘হাত উঠেছে ফুল ফুটেছে/ জোট করেছে কে/ দিদি নাচছে দাদু নাচছে/ দেশ ভোগে যাকগে।’ তৃণমূল লিখল: ‘যেখানে বুদ্ধ সেখানে যুদ্ধ/ যেখানে বিমান সেখানে কামান/ যেখানে জ্যোতি সেখানে ক্ষতি/...বুদ্ধ-মোদী একই নাম/ দেখিয়ে দিল নন্দীগ্রাম।’ এবং অবশ্যই: ‘টাটা আর ন্যানো গেল/ বাংলা হল শুদ্ধ/ আর কটা দিন সবুর করো/ এবার যাবে বুদ্ধ।’ বামফ্রন্টের পালটা: ‘দিদিরা যখন ন্যানো তাড়ায়/ দাদারা যায় সাথে/ বেকার যুবক ভোট দেবে না/ ফুলে কিংবা হাতে।’ এবং ‘নোটন নোটন চিল-শকুনে জোটন বেঁধেছে/ ...দিদির হাতে মিথ্যে ছিল ছুঁড়ে মেরেছে/ আস্তে, দিদি, মানুষ জেগেছে।’

২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে, তৃণমূল লিখল: ‘মাসিক বেতন বিশ হাজার/ BPL পায় তারা/ রিক্সা চালায় যে বন্ধুরা/ ঘৃণার পাত্র তারা/ ঘর নেই, চাষ নেই, পায় না খেতে ভাত/ CPIM-কে ভোট না দিলে কেটে নেবে হাত।’ এবং অবশ্যই তাদের হিট দেওয়াল লিখন: ‘১৯৭৭ নং বামফ্রন্ট ডাউন লোকাল ৩৪ নং প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। ২০১১ নং আপ মা-মাটি-মানুষ এক্সপ্রেস ঐ প্ল্যাটফর্মে আসছে।’ এটা ছড়া নয়, কিন্তু তা বলে এটি উদ্ধৃত করার লোভ ছাড়া যায়?

‘পরিবর্তন’ আসার পর, মুঠোফোন থেকে মুঠোফোনে ছড়াল: ‘কাল ছিল লাল খালি/ আজ ফুলে যায় ভরে।’ অবশ্য এসএমএস বা ফেসবুকের ওয়াল-এ লেখাকে ‘দেওয়াল লিখন’ ধরে নিলে, ঝুলি উপচে পড়বে। তখন আমাদের পুলকিত করবে এই টু-লাইনার: ‘কী পরিবর্তন আনলে কাকা/ বাজার করতে পকেট ফাঁকা!’

এ বারের ভোটে, বামফ্রন্টের দেওয়াল লিখন স্বাভাবিক ভাবেই অ্যাগ্রেসিভ: ‘মানুষের পাশে আছে কাস্তে হাতুড়ি/ সেই দেখে মুষড়ে পড়েছে মুকুল/ দিল্লির স্বপ্ন দেখো না দিদিমণি/ বাংলার মানুষ করবে না আর ভুল।’ কিংবা: ‘যে বেকারের জ্বলছে পেট/ ঘুষ না দিয়ে পায়নি টেট/ সেই বেকারেরা দিচ্ছে ডাক/ তৃণমূল সরকার নিপাত যাক।’ অথবা: ‘ভাইয়ের আয়ু বাড়বে বলে/ ফোঁটায় ফোঁটায় বর্ষণ/ বোনের জন্য থাকে কেবল/ ইভ-টিজিং আর ধর্ষণ।’ আর তৃণমূলের ‘সৎ’ ইমেজকে ব্যঙ্গ করে: ‘তৃণমূলের ৩৪ মাস/ মানুষের সর্বনাশ/ দিদির পায়ে হাওয়াই চটি/ দিদির ভাইয়েরা সব কোটিপতি।’

তবে বিজেপি-ও পিছিয়ে নেই। লিখছে: ‘বন্ধু, পরিবর্তন কাহারে কয়!/ CPI(M) হল তৃণমূল/ প্রকৃত তৃণমূল হল নির্মূল/ ‘মা’ সইবে না আর ভুল/ ‘মাটি’-তে ফুটবে না আর জোড়া ফুল/ ‘মানুষ’ করবে না আর ঐতিহাসিক ভুল/ এখন একমাত্র বিকল্প হল পদ্মফুল।’ আবার, নরেন্দ্র মোদীর ইমেজকে ব্যবহার করে: ‘দুপুর গেল সন্ধ্যা হল/ ফিরল পাখি বাসায়/ পথ চেয়ে বসে আছি/ নরেন্দ্র মোদীর আশায়।/ ঢোল বাজায়, কাঁসি বাজায়, বাজায় বিরোধী দল/ উঠছে মোদীর ঝড় পারবি কি রুখতে/ ক্ষমতা থাকলে বল?’

এ সব বিরোধী বক্তব্যকে পালটা চ্যালেঞ্জ, বঙ্গের শাসক কণ্ঠে— ‘হাত, হাতুড়ি কাস্তে তারা/ এবার হবে বাংলা ছাড়া/ ফুটবে নাকো পদ্মফুল/ ভারত গড়বে তৃণমূল।’ কিংবা: ‘সূর্য কাঁদিয়া কহে, বিমান আমার ভাইরে/ বুদ্ধকে বলে দিও, ভারতে বামফ্রন্ট আর নাইরে।’ আর আছে যুগসই ট্রেন্ডি ওয়ান-লাইনার: ‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল/ সব কেন্দ্রে তৃণমূল।’

baichitra9@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abir kar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE