Advertisement
E-Paper

যে পথ সাগরের

আলট্রাসাউন্ড মেশিনের কর্মীটি লম্বা এক জন মহিলা, চোখগুলো গভীর। কুড়ি সপ্তাহের স্ক্যান করানোর সময় ডিলান আর টেসা ওদের বাচ্চার প্রথম সাদা-কালো ইমেজ দেখতে পেল। ‘আপনারা এ বার ওর জন্য জামাটামা কিনতে বেরোন,’ মহিলাটি বলল। ‘আসছে সাত বছর গাদাগুচ্ছের জামাকাপড় কেনা আর গোলাপি রংটার জন্য রেডি হোন। চার দিক দেখবেন গোলাপিতে ভরে যাবে। আমার ঘরেও একটা আছে কিনা! গোলাপি ছাড়া কিচ্ছু পরবেই না।

অনুবাদ শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৪

আলট্রাসাউন্ড মেশিনের কর্মীটি লম্বা এক জন মহিলা, চোখগুলো গভীর। কুড়ি সপ্তাহের স্ক্যান করানোর সময় ডিলান আর টেসা ওদের বাচ্চার প্রথম সাদা-কালো ইমেজ দেখতে পেল। ‘আপনারা এ বার ওর জন্য জামাটামা কিনতে বেরোন,’ মহিলাটি বলল। ‘আসছে সাত বছর গাদাগুচ্ছের জামাকাপড় কেনা আর গোলাপি রংটার জন্য রেডি হোন। চার দিক দেখবেন গোলাপিতে ভরে যাবে। আমার ঘরেও একটা আছে কিনা! গোলাপি ছাড়া কিচ্ছু পরবেই না। ওর ইচ্ছেই সব, আমাদের দিদা-ঠাকুমারা যেন আন্দোলনটন জানতেন না!’ মহিলাটি হাসল, টেসার পেটের ওপর ছড়িটা বোলাল এক বার। ঠান্ডা।

‘এই যে, এটা ওর ছোট্ট পেটু। এখন ভর্তি।’

‘তার মানে কিডনিও আছে!’

‘হ্যাঁ আছে, কাজও করে। আর এই যে এটা মেরুদণ্ড। সব কিছু কেমন সুন্দর গুটোনো।’

‘যাক, স্পাইনা বিফিডা নেই।’

‘আপনারা সব জানেন দেখছি!’

‘হ্যাঁ, ওই গুগ্ল করেছিলাম আর কী।’

‘করবেন না। উচিত না।’

‘ঠিক, ঠিক।’

‘হার্টের দুটো চেম্বার এই যে, দারুণ। নিউকাল ফোল্ড। দেখতে তো ঠিকই লাগছে। এখনও পর্যন্ত যা দেখছি, বেবি একদম ঠিকঠাক আছে।’

‘সত্যি?’

‘সত্যি। সব কিছু অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না। তবে যেটুকু পাচ্ছি তা থেকে পরিষ্কার, দুশ্চিন্তার কোনও ব্যাপারই নেই।’

‘নেই?’

‘না। সব আছে, ঠিকঠাক জায়গায় আছে।’

ওরা হাসল। মহিলা স্ক্রিনটা ফ্রিজ করে ইমেজগুলো প্রিন্ট করতে দিল, ওরা বাড়ি নিয়ে যাবে বলে।

‘একটা মিনি-আমি’, টেসা বলল, ‘অবশেষে।’

‘ছোট্ট একটা মেয়ে’, ডিলান বলল। দুজনেই তাকিয়ে রইল কালো স্ক্রিনের ওপর কয়েকটা ধূসর বুটির দিকে, যেগুলো হয়তো ওদের মেয়ের ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা। আঙুল।

‘ওর নাম রাখব সামার’, বাড়ি ফিরে টেসা বলল। পেটে হাত বোলাল এক বার। ‘আমার ছোট্ট-আমি। তোর নাম সামার, কেমন?’ ওর প্রিয় ঋতু। উষ্ণতার ঋতু। ‘ঘরে সোনা সামার থাকতে আসল সামার ফুরোবেই না!’

ডিলান ভাবল, ‘সামার’ নামটা দিব্যি। রোদেলা। তবু নাম নিয়ে আর একটু ভাবা দরকার। টেসা জানত, তা-ই হবে। ভাববে ও, আর ডিলান ভাব দেখাবে যেন ভাবনাটা তার। যাক গে, টেসার ও-সবে আপত্তি নেই।

সুতরাং ব্যাপার দাঁড়াল এই, ওই মহিলার মতে, একটা ফুটফুট্টি মেয়ে আসছে, যার গোলাপি রং প্রিয়। একটা মিনি-আমি। ওই নামে ডাকা যাবে না অবশ্যই, টেসা ভাবে, ওরও তো একটা ব্যক্তিত্ব থাকবে। তবু, টেসার চোখে ভাসে, ও হেঁটে বেড়াচ্ছে ওরই একটা একরত্তি সংস্করণের সঙ্গে। ছোট্ট একটা মেয়ে, ঠিক ওরই মতো। ওকে আদর করছে। চুমোয় পাগল করে দিচ্ছে। দুজনে একই-দেখতে বর্ষার জুতো পরে একসঙ্গে ছপছপাচ্ছে বৃষ্টির জলভরা গর্তে। হাসছে কলকলিয়ে। ওরই মতো মজা করে, মিনি-আমি ওর হাত ধরবে, ওরই মতো চোখে তাকাবে ওর দিকে। অবিকল টেসা, শুধু আরও মিষ্টি, আরও সুন্দর, আরও রোগা। ওরই উন্নত সংস্করণ। মনে মনে টেসা অবশ্য একটা ‘আদর্শ’ বাচ্চা চাইছিল, যদিও এ-ও ভাল করেই জানত যে আদর্শ বলে কিস্যু নেই। আর বেচারি বাচ্চাটার কাছেই বা শুধুমুধু এত আশা করা কেন।

কিন্তু, শেষমেশ টেসার পেট থেকে যেটা বেরল, তার সঙ্গে ওর কোনও মিলই ছিল না।

ডিলান ওর বেড-এর পাশেই দাঁড়িয়েছিল, চোখে খুশির কান্না। প্রথম অ্যাপগার টেস্ট করার সময় নার্স আর আয়ার চাউনি-বিনিময় ওর নজরেই পড়েনি। পাঁচ মিনিট পর যখন দেখা গেল বাচ্চাটার বেশির ভাগ রিফ্লেক্সও কাজ করছে না, টেসা দেখল ওরা স্টেরাইল কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলছে। ডিলান সেটাও দেখেনি। সে শুধু বলে যাচ্ছিল, ওদের জীবনে ও-ই হল শ্রেষ্ঠ পাওয়া। ‘ঠিক না, টেস?’

পুশ করে করে বের করার সময় বাচ্চাটা নড়ছিল না। টেসার শরীরের ওপর সে শুয়ে রইল, স্থির, একটা নিরেট বাটখারা যেন। হালকা ধূসর, কুনোব্যাংয়ের মতো লাগছিল দেখতে। নির্জীব, জীবনের প্রথম পরীক্ষাতেই ফেলটুস। এটাই যদিও শেষ পরীক্ষা নয়। জীবনের শুরুতেই, পর পর দু’বার একটা টেস্টে পাশ করতে পারল না।

‘বেঁচে আছে?’ টেসা প্রথম কথা বলেছিল এটাই। না থাকলেই সবচেয়ে ভাল হয়, ও মনে মনে বলল। তক্ষুনি মনে হল, বাচ্চাটা ওর কাছ থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ছিনিয়ে নিয়েছে। কিছু একটা, এতগুলো বছর যা ওর কাছে ছিল। কী, ও জানত না। শুধু জানত, ওকে ওটা ফিরে পেতে হবে, যে করেই হোক।

‘কী মিষ্টি মেয়ে, টেস!’ ডিলানের গাল বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়ছিল। জীবনে টেসা ওকে এত খুশি দেখেনি। ‘সোনামণি সামার লিয়া মন্টগোমারি।’

‘ও ঠিকঠাক নয়, ডিল’, টেসা শান্ত স্বরে বলল, ‘তুমি খেয়াল করোনি?’

‘দশ দশটা খুদে আঙুল আছে, হাতে, পায়েও। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর শিশু ও-ই। আমাদের মেয়ে বলে বলছি না। সত্যিই সুন্দর ও।’

‘কী আর বলব।’

টেসা শুধু ভাবছিল, বাচ্চাটা দম আটকে মারছে আমাকে। ওটা মরলে বাঁচি। মরতেই হবে ওটাকে। নিজের মেয়েকে ভাল করে এক বার দেখার আগে থেকেই ও লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। লজ্জা, ও ওটার জন্ম দিয়েছে বলে। লজ্জাটার ওজন ঠিক ন’পাউন্ড দু’আউন্স। শরীরটা তখনও গরম, আর লেপটে ছিল ওর শরীরের সঙ্গে। একটা ন্যাংটো চামড়া আর একটার সঙ্গে লেগে। একটু পর আস্তে আস্তে কেঁদে উঠল। ওরও নিশ্চয়ই এখানে থাকতে আর ভাল লাগছে না, টেসা ভাবল। নার্স এসে নিস্তেজ ওজনটাকে ওর শরীরের ওপর থেকে উঠিয়ে নিলে ও একটু শ্বাস নিতে পারল। কিন্তু একটু পরেই ফের চাপিয়ে দিয়ে গেল। ঘুমোচ্ছে। জামা-পরা এখন। মা’র সঙ্গে টান বাড়াতে? ধুস, শাস্তি দিতে। টেসা ওর থুতনিটা বুকের ওপর নামাল। বাচ্চাটার টাকমাথাটা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট একটা মাথা, ঠিক টেসার মতোই। ডিলানের আঙুলগুলো খুদে খুলিটায় আদর বোলাচ্ছে। ওরা বাচ্চাটাকে পরিয়েছে গোলাপফুল-আঁকা দামি পাজামা, টেসা যেটা বাচ্চাদের পোশাকের বুটিক ঢুঁড়ে কিনেছে। ‘পেতি বাতো’ ব্র্যান্ড, সাইজে বড়। কিন্তু ওই ফুলেল পাজামাটা এই মেয়েটার জন্য কেনা হয়নি। এটা রাখা ছিল ‘অন্য’ মেয়েটার জন্য। ‘ঠিক’ মেয়েটার জন্য।

দশ মিনিট পর, তিন নম্বর অ্যাপগার টেস্ট হয়ে গেলে যখন ডাক্তার নিজে এসে জানালেন যে বাচ্চাটার মোটর ফাংশন খুব দুর্বল, ডিলান বলে উঠল, ‘তার মানে ও ভাল হাঁটতে পারবে না।’

‘তা হোক। ওর বাবা-মা’ও হাঁটায় খুব কিছু সড়গড় কি? আমরা তো সুযোগ পেলেই গাড়িতে যাই, তাই না টেস?’

ঠিকই। সুযোগ পেলে ওরা গাড়িতেই যায়।

প্রসবের দু’ঘণ্টা পর, টেসা তখনও চিৎ হয়ে শুয়ে, পা দুটো ঠেকনা দেওয়া, অপেক্ষা করছিল কেউ এসে ওর সেলাই-টেলাইগুলো সারবে। কিন্তু সব ডাক্তার তখন অন্য কোথাও, কাজে। টেসার সময় অঢেল। ওর তো যাকে বলে মডেল ডেলিভারি হয়েছে। শেষমেশ এক জন ইন্টার্ন এল। পেটানো চেহারা। হুগো বস-এর মডেল টাইপ। ভরাট ঠোঁট। সোজা নাক। মোটা ভুরু। ঘন সোনালি চুল, ডান দিকে এলানো।

‘আমায় দেখতে খুব বাজে লাগছে’, টেসা বিড়বিড় করল, ‘সরি।’ ওর সন্দেহ হচ্ছিল, মুখের মেক-আপটা বুঝি ধেবড়ে গেছে। হলই বা ডিওর-এর মেক-আপ!

পেশাদার গায়নোকলজিস্টের মতো ইন্টার্ন তার কাজ করছিল। কিন্তু টেসা ঠিক ধরতে পারল, লোকটা আসলে হামবাগ। সবাই ওকে ডাকে ‘মিস্টার কান্ট’ বলে। কালই নির্ঘাত ব্যাটা কোনও বার-এ বসে গেঁজিয়ে বলবে, ওই মহিলার ‘ওটা’ দেখছিলুম, একখান চিজ বেরল বটে! ‘তা ওই জিনিস থেকে আর কীই বা আশা করবে? ঘটে ছটাক বুদ্ধি থাকা যে কেউ বলবে, ওইখান থেকে নর্মাল কিচ্ছুটি বেরোবে না। আর এই পাবলিকগুলোও তবু ঘষে যাবে। আমার মাথায় ঢোকে না বাপু। কী, ঠিক না? জিনগুলোকে দুর্বল করা, এ তো একটা ক্রাইম!’ টেসা ওর বন্ধুদের হ্যাহ্যা-ও শুনতে পাচ্ছিল।

‘মিসেস...? কেমন লাগছে এখন?’ হুগো বস মডেল ওর দিকে মাথা তুলে বলছিল।

‘খুব যন্ত্রণা।’

‘তার কারণ প্রসবকালীন শরীরের যে যে অঙ্গ আপনার ব্যথাটা কমিয়ে দেয়, সেগুলো ঝিমিয়ে গেছে। ডেলিভারির পর পরই সেলাইফোঁড়াইগুলো চুকে গেলে কোনও যন্ত্রণা থাকত না।’

‘ঠিক আছে, এ কী আর এমন’, টেসা হাসল।

পরের রুগির ‘ওটা’র দিকে নজর দেওয়ার আগে লোকটা টেসাকে প্রথম বার মা হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাল। বলল, বাচ্চা এমনিতে ঠিকঠাক আছে। টেসা জানত, এ আসলে ওকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া।

‘ঠিকই আছে’, ডিলান বলল, ‘এত কিছুর পরও ও আমাদের প্রথম বাচ্চা।’

‘হু।ঁ শাস্ত্রে বলে না, যা পেয়েছ তা-ই নিয়ে থাকো।’ টেসা বলল।

‘এক্সকিউজ মি?’

টেসা হাসতে লাগল। ডিলানও। ইন্টার্নও খুশি, ওরা অন্তত এটা নিয়ে মজা তো করছে! একটা ঘটনার মজার দিকটা দেখতে পারলে তার তিতকুটে ধারগুলো কমে যায়। রসবোধ একটা দরকারি জিনিস। ‘এটা হারাবেন না, শুনছেন? আগামী মাস আর বছরগুলোয় ও-জিনিসটা খুব দরকার হবে আপনাদের!’

ঠিক। টেসা মাথা নাড়ল। গোটাটাই তো একটা রসিকতা।

iwritemyright@gmail.com

sisir roy rabibasariya anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy