Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

কলকাতার বইমেলা সদ্য শেষ হল। শীত এখন যাওয়ার পথে। শহরের প্রখ্যাত পানশালায় রোববার সকালে বিয়ার আর স্টেক সহযোগে আড্ডাবাজদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। আজ তাই বিয়ারের গপ্প।

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০০


পিনাকী ভট্টাচার্য

কলকাতার বইমেলা সদ্য শেষ হল। শীত এখন যাওয়ার পথে। শহরের প্রখ্যাত পানশালায় রোববার সকালে বিয়ার আর স্টেক সহযোগে আড্ডাবাজদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই বেড়ে গেছে। আজ তাই বিয়ারের গপ্প।

বার্লি দিয়ে প্রথম বিয়ার তৈরি হয়েছিল পশ্চিম এশিয়ায়, আজ থেকে ছ’হাজার বছর আগে। আর বিয়ার-ভক্তির প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় সুমেরীয় সভ্যতায়, পাঁচ হাজার বছর আগে। সেই ভক্তি এতটাই প্রবল, সুমেরীয় সভ্যতায় বিয়ারের দেবীকে পুজো করা হত। প্রায় চার হাজার বছর পুরনো নথি থেকে সেই দেবী নিন্কাসির উদ্দেশ্যে সুমেরীয়দের বানানো গান উদ্ধার হয়েছে; মজার ব্যাপার সেই গানে বিয়ার তৈরির পুরো পদ্ধতিও উল্লেখ করা আছে।

মহিলা-পুরোহিতদের তৈরি করা এই বিয়ার সুমেরীয়দের দৈনন্দিন জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠার একটা কারণ ছিল এই— সুমেরীয়রা স্বাস্থ্যের কারণে আর মহামারীর ভয়ে নদী আর খালের দূষিত জল খাওয়া ছেড়ে বিয়ার খাওয়া ধরেছিল। সুমেরীয় সভ্যতার উত্তরসূরি ব্যাবিলনীয়রা আজ থেকে চার হাজার বছর আগে ২০ রকমের বিয়ার তৈরি করত নিজেদের জন্য! বিয়ারের গুরুত্ব এতটাই ছিল সেই জমানায় যে, বিনিময়-ব্যবস্থায়, এমনকী মজুরির অঙ্গ হিসাবেও বিয়ারের ব্যবহার ছিল!

বিয়ার তৈরিতে যেহেতু শস্য, বিশেষত বার্লির এক মস্ত ভূমিকা আছে, তাই বিয়ার সেই সব সভ্যতায় বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যেখানে বেশি শস্য উৎপাদন হত। সুমেরীয় সভ্যতা থেকে বিয়ার পৌঁছে যায় মিশরে, যেখানে নীল নদের পাশে কর্মরত মজুরদের দৈনিক খোরাকির মধ্যে বিয়ারও দেওয়া হত। মিশরে বিয়ার এতই জনপ্রিয় ছিল, ফারাও থেকে শিশু, সবার দৈনিক জীবনের অঙ্গ ছিল বিয়ার!

মিশর থেকে বিয়ার পৌঁছয় গ্রিসে। প্লেটো বিয়ার নিয়ে এতই পুলকিত ছিলেন যে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন: বিয়ারের আবিষ্কর্তা প্রকৃত সাধু ব্যক্তি ছিলেন। আর সফোক্লিস ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর বিখ্যাত ‘মধ্যপন্থার সূত্র’-এ বিয়ারের উদাহরণ দিয়েছেন। গ্রিকরাই রোমানদের বিয়ার তৈরি করতে শেখায়।

আমাদের পরিচিত বিয়ারের স্বাদের সঙ্গে সেই জমানার বিয়ারের স্বাদের বিস্তর ফারাক ছিল। মধ্যযুগে বিয়ার বানানোতে ‘হপ্’ (এক ধরনের গাছের অংশ, যা বিয়ারের তেতো ভাবটার মাত্রা ঠিক করে) ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে, বিয়ারে অ্যালকোহলের পরিমাণ অনেক কম ছিল। তাই জলের বদলে বিয়ার খাওয়া রীতিমত দস্তুর ছিল সেই সময়। বিয়ার পরিবার প্রাচীন কাল থেকে তিন সদস্যের— জল, বার্লি আর ইস্ট। স্বাদ বদলের জন্য এবং একটা তিতকুটে স্বাদ আনার জন্য আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে মাঝেমাঝে গ্রুইৎনামের এক শিকড়বাকড়ের মিক্সচার স্থান পেত। এই পরিবারে গুঁতিয়ে ঢোকা নতুন সদস্য হপ্ এসে অনেক কিছু ওলটপালট করে দিল।

হপ্ শুধু বিয়ারের অ্যালকোহল পরিমাণ আর স্বাদে পরিবর্তন আনল না, বিয়ারের আয়ুও বাড়িয়ে দিল বহু গুণ। আর এই বদলের ফলে, বিয়ার বানানো আর বাড়ির রান্নাঘরে সীমাবদ্ধ রইল না। চতুর্দশ শতাব্দীতে দেখা গেল বিয়ার তৈরির মালিকানা চলে গেছে সরাইখানা আর মনাস্ট্রির হাতে, যেখানে জনগণের বিয়ার খাওয়ার জন্য এক সঙ্গে হাজার হাজার লিটার বিয়ার তৈরি হচ্ছে। শোনা যায়, ব্রিটেনের খানদানি বিয়ার-মৌলবাদীরা এই পরিবর্তনের জন্য হপ্-কে বিয়ারের চরিত্রহননের অভিযোগে ১৫১৯ সালে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকে একেবারে নিষিদ্ধ করে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com


‘আমাকে লাথি মারুন ভাই...’

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির। চাতালে শ্বেতপাথরের ফলক ছড়ানো-ছেটানো। বাংলা, ওড়িয়া, তেলুগু, হিন্দি— সব ভাষাতেই কত উৎসর্গ, প্রণতি, পুণ্যকামনা। দেখলাম, পিতা ঁঅমুক চন্দ্র তমুকের অক্ষয় বৈকুণ্ঠলাভ কামনায় কম করে দেড় ডজন নাম। অমুক চন্দ্রের পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি-জামাই সবই আছে। সঙ্গে ভ্যাবলা-পল্টু-বুলা-রুমা-ঝুমা...। এরা কারা জানি না। পুরো নাম ধারণ করার ক্ষমতা ছিল না ওই দুই ফুট বাই দুই ফুট পাথরের। কোনও পাথরের গায়ে ‘পিতামাতার স্মৃৃতির উদ্দেশ্যে অমুক কুমার তমুক’। কোনও পাথরে মাতৃস্তব: ‘হে মোর স্নেহময়ী মাতা’ দিয়ে শুরু, ‘দেবতা কি শুনিবে বারতা’য় শেষ। কোনও পাথরে শোকগাথা অমিত্রাক্ষর ছন্দে: অকালে আমারে ফেলে চলে গেলে দূরে/ করিয়া অনাথ মোরে। তব স্মৃতি লয়ে/ রয়েছি সতত...

এই সব ফলক দেখেছিলাম, এবং জেনেছিলাম— দেখলে হবে? খরচা আছে। ভালই খরচা। এবং যেখানে জনসমাগম বেশি— যেমন সিঁড়ি, মন্দিরের প্রবেশদ্বার, যেখানে ভোগ বিক্রি হয়— সেখানে খরচাও বেশি। এমন কেন? এটা তো পণ্যপ্রচার নয়, কিংবা বিজ্ঞাপনও নয়, অধিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক কীসের? এক জন পান্ডা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন— যত মানুষ তত পা। যত পদ তত পদধূলি। পুণ্যার্থীদের পদধূলিতেই— কামনা-বাসনা সিদ্ধ হয়। দেখলাম কত কামনা-বাসনাকে মাড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ। ইচ্ছেগুলি পদপিষ্ট হলেই ইচ্ছের মুক্তি ঘটে। একটা আশ্চর্য পাথরে লেখা সরল মিনতি— ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রেখো, অণিমা সাঁতরা, পাণ্ডবেশ্বর। পায়ে মাড়াচ্ছে এই মিনতি। আমরা কেউ জানি না ভগবান কথা রেখেছেন কি না।

পুরীর মন্দিরে সর্বত্র সমান লোকঘনত্ব হয় না। কোথাও কম লোক যায়। ওখানে দেখি একটা পাথরে কোনও মিনতি নেই। শুধু লেখা সুদর্শন ধাড়া। পরাশর গোত্র। পিং মধুসূদন ধাড়া। সাং গুপ্তিপাড়া। বৈকুণ্ঠলাভের কামনা নেই, পিতামাতাকে স্বর্গবাস করানোর দাবি নেই, এমনকী জগন্নাথদেবের শ্রীপাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করার ঘোষণাও নেই। কেবল নিজের নাম।

নিজের নাম ছাপা অক্ষরে অনেকেই দেখতে চায়। এটা আবার কাগজে ছাপা অক্ষর নয়। পাথরে ছাপা অক্ষর। জায়গাটা অন্ধকার-অন্ধকার। আমি ফলকটার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি সুদর্শন ধাড়ার নামটা। পিতা মধুসূদন। সাং— মানে সাকিন। এমন সময় শিবমন্দিরের চাতালে বসা একটা প্রৌঢ় মানুষ বলল— দাদা, পাথরটার উপর উঠে দাঁড়ান। আমার মুখে প্রশ্নচিহ্ন। লোকটা বলল— দাদা, পাথরটার উপর উঠে দাঁড়ান, দাঁড়ান না দয়া করে। দাঁড়াই। এ বার অনুনয় মাখানো নির্দেশ— লাথি মারুন। আমাকে লাথি মারুন।

আবার আমার মুখে গভীর প্রশ্নচিহ্ন। লোকটা বলল যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে শুয়ে আছি আমি। আমার নামগোত্রসহ, আমার পিতৃপরিচয় নিয়ে। আমাকে লাথি মারুন ভাই...

লোকটার মুখের দিকে তাকাই। পাগল?

মারুন, লাথি, লাথি... আমি নির্দেশ পালন করি। লোকটা বলে, জয় জগন্নাথ। আমি জিজ্ঞাসা করি— লাথি মারতে বলেন কেন? লোকটা বলে, মুক্তিকামনায়। ‘মানে?’ লোকটা ‘গূঢ় তত্ত্ব’ বলে চুপ করে যায়। আমি একটু দূর থেকে দেখি কোনও লোক ওই ফলকের উপর দিয়ে হেঁটে গেলেই ও বলছে, ‘জয় জগন্নাথ’।

আমার মনে পড়ে, মুর্শিদাবাদ জেলার এক গ্রামে এক পিরের মাজারের নাম পিটাই পিরের মাজার। বটবৃক্ষতলে একটি কবরে শুয়ে আছেন পির, যে কোনও পথচারীর কর্তব্য হল যাওয়ার সময় কবরের উপর একটা ঢিল মারা। স্থানীয় মানুষ এটা জানে। আশেপাশের ঢেলা বাড়ন্ত বলে অনেকে সঙ্গে ঢেলা নিয়ে আসে, এবং কবরে ছুড়ে মারে। পিটাই পির নাকি প্রৌঢ় বয়সে একটা অন্যায় করে ফেলেছিলেন। এর পর ওঁর অনুশোচনা হয়। মুরিদদের বলেন, পাথর মেরে ওঁকে হত্যা করতে। মুরিদরা রাজি হয় না, পির হুকুম করেন। পির নাকি বলেছিলেন, ব্যভিচারিণী নারীকে যদি পাথর ছুড়ে হত্যা করা জায়েজ হয়, ব্যভিচারী পুরুষকেও পাথর ছুড়ে হত্যা করা জায়েজ। এটা আমার হুকুম। আর আমার মৃত্যুর পর কেয়ামত পর্যন্ত আমার কবরে যেন সবাই ঢিল ছুড়ে যায়।

পর দিন মন্দিরে যাই ফের। সেই অন্ধকার-অন্ধকার শিবমন্দিরের পিছনে যাই, দেখি সুদর্শন ধাড়া পাথরের কাছাকাছি মুখে চুনকালি মেখে বসে আছে।

আজ সং সেজেছেন কেন সুদর্শনবাবু?

নইলে যে ইদিকে লোক আসে না।

লোক না এলে কী হয়?

আমার গতি হবে না তো। ঘোরতর পাপ করেছি। আমাকে তিন লক্ষ তিপ্পান্ন লাথি খেতে হবে। ভাল জায়গায় তো শুতে পারিনি, হাই রেট। এই কোনাটাতেই শুয়ে আছি নাম গোত্তর নিয়ে। উপর দিয়ে যদি কেউ হেঁটে যায়, আমাকেই তো লাথি মারা হয়, তাই না? আপনি বলুন, আপনি তো শিক্ষিত মানুষ।

আমি লোকটাকে পাগল ভাবি। কিন্তু ‘শিক্ষিত’ শব্দটা আমাকে কেমন কাঁপায়। আমি ‘শিক্ষিত’ বলেই হয়তো ওর অনুশোচনা আর স্বরচিত প্রায়শ্চিত্ত-পদ্ধতি আমার মাথায় ঢোকেনি।

swapnoc@rediffmail.com

rabibasariyo magazine
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy