Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

...

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৪ ১৭:২৮
Share: Save:

পিনাকী ভট্টাচার্য

ফরাসি দেশের প্রিয় খাবার ক্রেপ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। ভারতে, এমনকী বাংলাতেও ক্রেপ-এর দোকান গজিয়ে উঠেছে।

আমাদের দেশের মতো রকমারি খাবার আর কোনও দেশেই নেই— ক্রেপের বেশ কিছু নিকটাত্মীয় আমাদের দেশের রসুইঘরে অনেক বছর ধরে আছে। যেমন গোলারুটি বা পাটিসাপটা, বা পশ্চিমের চিলরা। আর এক আত্মীয় দক্ষিণ ভারতের দোসা তো গত দেড় হাজার বছর ধরে আমাদের সঙ্গে জড়িত। ক্রেপের ইতিহাস কিন্তু অত পুরনো নয়। এই খাবারের জন্ম দ্বাদশ শতাব্দীর পরে। যে বজরার আটা (আমাদের দেশে ‘কুটু কে আটে’ বলে উত্তর ভারতে পরিচিত) থেকে ক্রেপের জন্ম, সেই আটার সঙ্গে ফরাসি রসুইঘরের পরিচয় হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই প্যানকেকটার নাম এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ক্রিস্পাস’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘কুঁকড়ে যাওয়া’। এর জন্মস্থান ফরাসি দেশের উত্তর-পশ্চিমের ব্রিটানি প্রদেশ যার উত্তরে ইংলিশ চ্যানেল আর দক্ষিণে বে অফ বিসকে। সাইডার-এর পাত্রে ডুবিয়ে ডুবিয়ে, ফায়ারপ্লেসে কাঠের আগুনের ওপর লোহার চাটুতে বানানো ক্রেপ খাওয়া ফরাসি রোম্যান্টিকতার এক চরম নিদর্শন ছিল মধ্যযুগে। রোম্যান্টিকতার আমেজ আজও একই রয়েছে ফরাসিদের ক্রেপ-প্রীতিতে, তা সে যতই বজরার কালচে আটার জায়গা নিক গমের সাদা আটা আর কাঠের আগুনের বদলে গ্যাসের চুল্লি।

ফরাসি দেশের-ক্রেপ প্রীতি এতটাই প্রবাদপ্রতিম যে ২ ফেব্রুয়ারির ছুটি ‘লা শান্দেলিয়ঁ’-র অপর নাম হল ‘জ্যর দ্য ক্রেপ’ সে দিন ওই দেশে সারা দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে ক্রেপ খাওয়া হয়। ওই দেশের মানুষের এক সংস্কার হল ডান হাতের মুঠোয় একটা কয়েন রেখে বাঁ হাতে ক্রেপ রান্না করতে করতে ক্রেপটাকে শূন্যে ‘টস’ করা। যদি সেই ‘টস’ করা ক্রেপ আবার চাটুর ওপর এসে পড়ে, মনে করা হয় বাকি বছরটা পরিবারের কোনও অভাব থাকবে না।

ক্রেপের অনেক গল্প। তারই একটা গল্প হল এক ছিলেন ইংরেজ রাজপুত্তুর। সাগরপারের এক অন্য দেশে বেড়াতে গিয়ে সেই দেশের এক মেয়ের প্রেমে পড়লেন। এক দিন রাজপুত্র ঠিক করলেন সেই মেয়েটিকে নিয়ে এক নামী রেস্তরাঁয় খেতে যাবেন। রেস্তরাঁয় সাজো-সাজো রব, রাজপুত্র খেতে আসবেন বলে কথা! রুপোর পিরিচ, সোনার থালা এলাহি ব্যাপার! এক অল্পবয়সি ছোকরাকে দায়িত্ব দেওয়া হল শেষ পাতের মিষ্টিমুখের। এমন সময় হল এক কাণ্ড! রাজপুত্র অন্যান্য পদ খেয়ে তখন শেষ পাতের মিষ্টির অপেক্ষায়। সেই অকালপক্ব ছোকরার ক্ষণিকের ভুলে ক্রেপ-এ আগুন ধরে গেল। সবার মাথায় হাত নতুন করে আবার ক্রেপ বানানোর সময়ও নেই। সেই বেয়াক্কেলে ছেলেটা ক্রেপটি অল্প চেখে দেখতে গিয়ে চমকে গেল। আগুনের ধরা গন্ধে ক্রেপের স্বাদ তো নষ্ট হয়ইনি, বরঞ্চ আরও খোলতাই হয়েছে। মনে মনে ‘জয় কালী’ বলে (স্থানভেদে ‘জয় যিশু’) সে ক্রেপটা পরিবেশন করল। রাজকুমার গল্প করতে করতে ক্রেপটা মুখে দিলেন। কথা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর। ধীরে ধীরে পুরো ক্রেপটা খেয়ে শেষ করে ওয়েটারটিকে এই অপূর্ব ক্রেপটার নাম জিজ্ঞেস করলেন। প্রত্যুৎপন্নমতি ওয়েটার উত্তর দিল ‘ক্রেপ প্রিন্সেস হুজুর!’ রাজকুমার অনুরোধ করলেন নামটা বদলে ‘ক্রেপ সুজেত’ রাখতে এবং বকশিশ স্বরূপ দিলেন এক রত্নখচিত আংটি। এই ভাবেই জন্ম নিল বিশ্ববিখ্যাত ক্রেপ সুজেত।

আশির দশক। সল্টলেক সেজে উঠছে। গাছ লাগানো চলছে, নতুন নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আমার এক নিকটাত্মীয় দিল্লিতে থাকেন, আমাকে বলেছিলেন, এক জন কনট্রাক্টরকে সল্টলেকে বাড়িটা করতে দিয়েছি, তুমি গিয়ে মাঝে মাঝে একটু তত্ত্ব-তালাশ কোরো।

যেতাম, বেশ ভালই লাগত— বিশেষত সন্ধের পর। হাওয়ায় কেমন যেন একটা সোঁদা গন্ধ। গঙ্গার পলি দিয়েই সল্টলেক ভরাট হয়েছিল তো।

তখন চক্ররেলের কাজও শুরু হয়ে গেছে। দমদম থেকে উল্টোডাঙা হয়ে চিৎপুরের রেল ইয়ার্ড হয়ে গঙ্গার ধার দিয়ে প্রিন্সেপ ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার কথা, কিন্তু উল্টোডাঙার কাছে গিয়ে কাজটা থমকে ছিল, কারণ ঝুপড়ি উচ্ছেদ করা যাচ্ছিল না। ঝুপড়িবাসীরা প্রতিরোধ করছিল। এতে আমার দিল্লির আত্মীয়টির খুব মন খারাপ ছিল। বলতেন, ওয়েস্ট বেঙ্গলের কিস্সু হবে না। কেবল চলছে না চলবে না। ট্রেনটা হয়ে গেলে সল্টলেকের কমিউনিকেশন কত ভাল হয়ে যেত।

মাঝে মাঝে যেতাম ওখানে, বাড়িটার টানে নয় ততটা, যতটা সল্টলেকের সোঁদা গন্ধমাখা হাওয়ার টানে। কতটা ফাঁকা জায়গা, বালিময়, চাঁদের আলো পড়লে দারুণ লাগত।

এক দিন বিকেলের দিকটায় গিয়েছি, কনট্রাক্টরের লোকজন নেই, কাজ বন্ধ আছে। পিলার উঠেছে বেশ কয়েকটা, দেখি পাঁচিলের ধারে একটা লোক উপুড় হয়ে কী যেন করছে।

জিজ্ঞাসা করি, কী করছেন?

লোকটা বলল, অয়েল টেস্ট।

লোকটার মুখে দাড়ি। অতি অপরিষ্কার শার্ট, খাকি ফুলপ্যান্ট বুটের ভেতরে গোঁজা।

আমি জিজ্ঞাসা করি, কে আপনি?

লোকটা বলে, চেনেন না আমাকে? আমি ডি.সি.পাল। আর্কিটেক্ট, এস্টিমেটর, কনট্রাক্টর অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার।

আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। প্যান্টের বোতাম ঠিকমত লাগানো নেই, বেল্ট ঝুলছে।

লোকটা বলল— তিন কাঠার প্লট, এর মধ্যে টুয়েল্ভ হান্ড্রেড স্কোয়ার ফিটের বাড়ি। লিভিং কাম ডাইনিং স্পেসটা চারশো স্কোয়ার ফুট। এখান থেকে একশো ফুট কেটে নিয়ে একটা ব্যালকনি করা উচিত ছিল সাউথের দিকে। আপনার ইঞ্জিনিয়ারকে বলুন, প্ল্যান ডিফেক্টিভ। আপনার কনট্রাক্টরকে বলুন ঠিকমত কাজ করতে। লিন্টেনে স্টোন চিপ্স-এর সঙ্গে ঝামা পাইল করেছে। আরে ডি.সি.পালের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, আস্ক ইয়োর কনট্রাক্টর হোয়াই হি অ্যাডালটারেটেড ঝামা ইন দি স্টোন চিপ্স।

বুঝে যাই যা বোঝার। লোকটা ছিটেল।

একটা ছেলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে, বলল, নমস্কার পাল সাহেব...। লোকটা বলল, আরে, তোমাকেই তো খুঁজছিলাম, তোমার কোনও রেসপনসিবিলিটি আছে? নিউ গাঁথনি, নো ওয়াটার স্প্রে। ক্র্যাক করবে না? বেচারা বাড়িটা তো কিছু বলতে পারে না। আমি গতকাল মগ থেকে জল ছেটালাম। ইমিডিয়েটলি একটা ঝাঁঝরি বসানো পিতলের পিচকিরি কিনে নাও, গণেশ টকির কাছে পাবে। আমি একা কত দিক সামলাব? আর শোনো, ঢালাই যে দিন করবা, আমি আসবখনে, ঢালটাই আসল। ঠিকমত ঢাল না হলে ছাদে জল জমবে। মিস্ত্রিরা রাম ফাঁকিবাজ। সুপারভিশনটাই আসল। আই ডু অ্যাপ্রিশিয়েট ইয়োর ফাদার বিকজ হি হ্যাজ ডেপুটেড ইউ টু সুপারভাইজ দিস বিল্ডিং। বাট ইউ হ্যাভ নো এক্সপিরিয়েন্স। সো আই অ্যাম ফর ইয়োর হেল্প।

আমি কৌতূহলী হই। জিজ্ঞাসা করি, সারা দিন এমনি এমনি থাকবেন, ঢালাইয়ের দিনে?

লোকটা বলে, আমার কোনও প্রবলেম নাই, মিক্সিং মেশিনের ঘটর ঘটর, জামায় সিমেন্টের দাগ, মাথার চুলে বালির কিচকিচ কী যে ভাল লাগে আমার...।

ওর সঙ্গে আরও কথা হয় কিছু। এক কনট্রাক্টরের কাছে কাজ করত। ছিটলেমির জন্যই সম্ভবত চাকরিটা গেছে! উল্টোডাঙায় ছেলের কাছে থাকে। অন্তরঙ্গ হয়ে গেলে, বাঙাল উচ্চারণে বলেছিল ‘নিজের বাড়ির প্ল্যানখান অ্যামোনিয়ায় ছাপাইতে পারি নাই, বুকের মইধ্যে শামুকের মতো পুরা বাড়িখান বইয়া বেড়াই। এইখানে আসলে বড় ভাল লাগে, মনে হয় এই সব বাড়িগুলিই আমার। আমি এক ডি.সি.পাল হাজার শরীরের হইয়া যাই। যে দোলনায় দোলে, সেও আমি, মার্বেল মোড়া বাথরুমে শাওয়ারে ছ্যান করে ডি.সি.পাল। সাউথের ব্যালকনির রেলিংয়ে যার চোখেমুখে লাগে আদরের শাড়ির আঁচল সে-ও আমি, ডি.সি.পাল। রামকৃষ্ণ ঠাকুর কইতেন, আমি তো শতমুখে খাই। আমিও শত শরীরে। বাগান করে যে, সেও এক ডি.সি.পাল, আর যে পয়সার অভাবে ভিতটুকু কইরা ফালাইয়া রাখছে, সেও আর এক ডি.সি.পাল।’

ইতিমধ্যে বুলডোজার নামিয়ে ঝুপড়ি সাফ। দিল্লির আত্মীয় উৎফুল্ল।

এক দিন যাই। দেখি, প্লাস্টিকের চাদর পেতে ও-বাড়িটার একটা ঘরে শুয়ে আছে ডি.সি.পাল। বলে, উল্টোডাঙার বাড়িটা ভেঙে দিয়েছে, তাই নিজের মনে করে এই বাড়িটাতেই এসে পড়লাম। সবই তো আমার। ইজ ইট নট?

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE