Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

পিনাকী ভট্টাচার্য

আর ক’দিনের মধ্যেই সব্বাই উৎসবে মেতে উঠবে আর গেলাসে গেলাসে ঠুনঠুনানির সঙ্গে হাওয়ায় ভাসবে সুরার সুবাস আর সবার সম্মিলিত আওয়াজ— সুস্বাস্থ্যের জন্য। সুস্বাস্থ্যের জন্য এই আওয়াজটা কিন্তু আসলে হুইস্কি-রাম-ভদকার জন্য বরাদ্দ ছিল না। এটা বরাদ্দ ছিল লিকিয়র-এর জন্য। যা স্বাস্থ্যের জন্যেই খাওয়া হত এক জমানায়।

স্বাস্থ্যের জন্যে বা হজমের জন্যে সুরার সঙ্গে জড়িবুটি মিশিয়ে এক পানীয় তৈরির কথা গ্রিক পুঁথিতে, এমনকী মিশরীয় পিরামিডে পাওয়া দস্তাবেজে পাওয়া যায়— কারণ যে দিন থেকে অ্যালকোহল-এর শুদ্ধিকরণ হয়েছে, তখন থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে এই পানীয় কী ভাবে সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজে লাগানো যায়। কিন্তু আজকে লিকিয়র বলতে আমরা যা পাই, তা তৈরির কৃতিত্বের সিংহভাগ মধ্যযুগের অ্যালকেমিস্ট বা অপরসায়নবিদদের প্রাপ্য। অ্যালকেমিস্ট বলতে আমরা বুঝি সেই মানুষগুলোকে, যাঁরা দিনের পর দিন গোপন গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে সোনা তৈরির জন্য পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন। আদপে মধ্যযুগীয় এই সন্ধানীরা সোনার সঙ্গে সঙ্গে অমরত্বের দাওয়াই তৈরিরও চেষ্টা করতেন। লোকচক্ষুর আড়ালে আধো-অন্ধকার গবেষণাগারে তাই বিভিন্ন ধাতুর পাশেই থাকত হামানদিস্তে, খল-নুড়ি, গাছগাছড়া, শিকড়, বীজ, গাছের ছাল। ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে অ্যালকোহলের শুদ্ধিকরণ করে স্পিরিটটুকু বার করে তার সঙ্গে এই সব শিকড় আর বীজ মিশিয়ে চলত পরীক্ষা। সোনার দিকে আগ্রহ না থাকলেও, অমরত্ব-সন্ধানে যোগ দিলেন অনেক খ্রিস্টীয় সাধু— আর মনাস্ট্রির অন্দরে চলতে লাগল এই গবেষণা।

তৈরি হতে থাকল বিভিন্ন সুস্বাদু অ্যালকোহল-মিশ্রিত পানীয়, যা অমরত্ব না দিতে পারলেও দীর্ঘ জীবন দিতে শুরু করল বিভিন্ন মারণ-রোগ সারিয়ে তুলে। আর তাকে বলা হতে লাগল লিকিয়র। বিশ্বের সর্বকালীন ভয়াবহ মহামারীদের অন্যতম ব্ল্যাক ডেথ যখন ১৩৪৬ সালে ইউরোপ আক্রমণ করল, এই লিকিয়র জীবনদান করেছিল অনেককে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সুইস দার্শনিক-চিকিৎসক পারাসেল্সাস জেহাদ ঘোষণা করলেন স্বর্ণ-সন্ধানীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু লিকিয়র-এর পক্ষে জোর সওয়াল করলেন। তিনি খুবই শ্রদ্ধেয় দার্শনিক ছিলেন সেই জমানায়— সুচিকিৎসকও বটে, তাই তাঁর আবেদনের ফল হল সুদূরপ্রসারী। লিকিয়র বদ্ধ রসায়নাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে শুরু করল। হয়ে উঠল এক জনপ্রিয় পানীয়।

কিন্তু সত্যি কি লিকিয়র তৈরির ফন্দিফিকির সাধারণ মানুষের আয়ত্তে আজও? উত্তরটা জটিল, কারণ আজ বিশ্বের বিভিন্ন কোণে লিকিয়র তৈরি করছে বিভিন্ন প্রস্তুতকারক, কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত লিকিয়র শাৎরুস আজও তৈরি হয় মনাস্ট্রির অভ্যন্তরে। ১৬০৫ সাল থেকে ফ্রান্সের শাত্রুসিয়ান অর্ডারের খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসীরা ওই সময় পাওয়া এক নির্দেশিকা মেনে মনাস্ট্রির অন্দরমহলে এই লিকিয়র তৈরি করেন। আজও কেউ এর ফর্মুলা জানে না— শুধু জানে ব্র্যান্ডির সঙ্গে ১৩০টা জড়িবুটি মিশিয়ে এটা তৈরি হয়। যেমন জানা যায় না আসল বেনেদিক্তিনের ফর্মুলা, যেটা প্রথম তৈরি হয় বেনেদিক্তিন মনাস্ট্রিতে। আজও যার জন্য বেনেদিক্তিনের বোতলে লেখা থাকে দিয়ো অপ্তিমো, মাক্সিমো— ঈশ্বরের প্রতি, সবচেয়ে ভাল, সবার চেয়ে মহান।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

মলিন পাজামা-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা, মুখে দাড়ি, আমার বাড়িতে এলেন কোনও এক প্রভাতে। বললেন, লেখক অভিধানে আপনার ঠিকানাটা পেয়ে গেলুম। দেখলুম বাড়ির কাছেই তো, চলে এলুম। এখন ‘এলুম-গেলুম’ বলার লোক দেখি না আর। বসতে বলি। জিজ্ঞাসা করি, কোথায় থাকেন? বললেন, ওয়াকিং ডিসট্যান্স তো, বালি থেকে পুল ভেঙে গঙ্গা পেরিয়ে দক্ষিণেশ্বর, তার পর চিড়িয়ামোড়, দমদম। বাস। দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলুম। আমি বলি, এ তো অনেক পথ। সাত-আট কিলোমিটার... আমার কথা থামিয়ে উনি বললেন, বিদ্যাসাগর মশাই দেড়শো মাইল হেঁটে বীরসিংহ গাঁ থেকে কলকেতা আসতেন, নরেন দত্ত সিমলে থেকে পদব্রজে দক্ষিণেশ্বর যেতেন। সবই রিলেটিভ। টাইম-স্পেস সবই রিলেটিভ। আমি আইনস্টাইন মানি। বলি, ভাল কথা, কিন্তু কী কারণে এত কষ্ট করে হাঁটা? উনি বললেন, হাঁটলুম তো বাসভাড়া বাঁচাবার জন্য, কিন্তু আসল কারণ হল গে, আমি বই পুষি। ‘পোষা’ শব্দটা অদ্ভুত লাগল। কুকুর বেড়াল ছাগল পোষা জানি। ময়না-টিয়াও। আমি অবাক স্বরে বলি— বই পোষেন?

হ্যাঁ, পুষিই তো। অনাথ বইগুলোকে, বেচারা বইগুলোকে শেল্টার দিই, নইলে এরা টুকরো টুকরো হয়ে যেত। ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। আমার এখন হাজার দুয়েক পোষ্য আছে। আপনার কাছে যদি এমন বই থাকে, যাদের বিদেয় করতে চাইছেন, দিতে পারেন। আমার মুখে লেপ্টানো প্রশ্নচিহ্ন দেখে উনি ব্যাখ্যা করলেন— আপনাকে নিশ্চয়ই তরুণ কবি-লেখকরা ওদের বইপত্র দিয়ে অনুরোধ করে পড়ে মতামত জানাতে, আপনি পাতা উলটে দেখে রেখে দেন, তার পর তো খবরের কাগজের সঙ্গে সের দরে। আমি মাথা চুলকোতেই উনি বললেন, শুধু আপনি কেন? অনেকেই। আপনার কম বয়সে আপনি যাদের বই দিয়েছিলেন, তারাও এমনিধারাই করেচেন। ভাবুন না, তরুণ লেখকরা টাকা ধার করে, কেক-বার্গার-হ্যানোত্যানো না খেয়ে, বইগুলো করেচে, ওদের অপমানে আমার ইয়ে হয় না? তাই আমি এদের আমার ঘরে রাখি। গত তেরো বছর ধরে এই কম্মো করে আসচি। এক বার হয়েছিল কী, চিনেবাদামের সঙ্গে দেওয়া ঝালনুনের পুরিয়া খুলে দেখি ‘কী ভাবে মন্থন করো চাতকীর প্রাণ?’ আর একটা পুরিয়া খুলে দেখি— ‘লালায়িত জিহ্বায় নৃত্য করে কীটের লহরা।’ বুঝি, কবিতাগুলোকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করে এই নুনের পুরিয়া। পোস্তর ঠোঙায় দেখলাম ‘ঘুমের দীর্ঘচুল ওড়ে বাতাসে।’ একটা গল্পের পৃষ্ঠা দেখি চাটনি-মাখা চিটচিটে। ভেলপুরি খেয়েছিল কেউ। আমি আমার কর্তব্য-কর্ম ঠিক করে ফেললুম। কাগজওয়ালাদের ঝোলা থেকে সের দরে কেনা সাহিত্যের বইগুলো কিনে নিতে লাগলুম— ওদের কিছুটা লাভ দিয়ে। কিন্তু আমার তো কোনও রোজগারপাতি নেই, কত কিনব? তাই আপনাদের কাছে আসচি। খুব সাড়া পেইচি, যাকে বলে আশাতীত।

কয়েক জন কবি-সাহিত্যিকের নাম করলেন উনি, বললেন, ওঁদের কাছে গেলেই কুড়ি-পঁচিশটা করে বই পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসা করি, কোথায় রাখেন? উনি বললেন বালিতে আমার ঠাকুরদাদার তৈরি বাড়ি। রোডের উপর। আমার ভাগে, দেড়খানা ঘর। খাটের তলায় পিচবোর্ডের বাস্কো ভরে বই রেখে দিই, পাশের আধখানা ঘরও বইয়ের। অসুবিধে নেই, আরও অনেক বই ধরবে। সবই রিলেটিভ। ফুটপাতে পলিথিনের তলায় একটা গোটা সংসার চলে যায়। আমার তো তবু দেড়খানা ঘর। পরিবার নেই তো। বে-থা’র ঝামেলায় যাইনি। এক তলাটা ভাড়া দেওয়া আছে। ছ’টা দোকান। আমি এখন ২১০০ টাকা ভাগে পাই। তাইতেই চালাই। অসুবিধে নেই। চিঁড়েটা অনেক ক্ষণ পেটে থাকে। ঠান্ডা তেলেভাজা খেয়ে জল খেলেও খিদেটা মরে যায়। তা ছাড়া রুটির দোকান তো আছেই। সুখেই আছি।

এর পর থেকে উনি মাঝেমধ্যে আসেন। বইটই দিই। আমার নিজের লেখা বইও দিয়েছি। পড়েন উনি। একটাই অসুবিধা, ওঁর গায়ের দুর্গন্ধ। পরিধেয় বস্তু খুব নোংরা। জিজ্ঞাসা করলাম, জামাটামা কাচেন না? উনি অবলীলায় বললেন, না তো। বলি, একটু পরিষ্কার-টরিষ্কার পোশাক পরতে ইচ্ছে হয় না? উনি বললেন, পরিষ্কারই তো পরি। আমার আলনায় দু’সেট পাজামা-পাঞ্জাবি আছে। এক সেট নোংরা হলেই অন্য সেটটা পরতে থাকি। কিছু দিনের মধ্যে একটা বেশি নোংরা অন্যটা কম নোংরা থাকে, অপটিমিস্টিকালি, একটা কম পরিষ্কার, একটা বেশি পরিষ্কার থাকে, আমি বেশি পরিষ্কারটাই পরি। ওটা আরও নোংরা হলে আগেরটা তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার থাকে। আমি কিন্তু পরিষ্কারটাই পরি। সবই রিলেটিভ স্যর। দেখেছেন তো, বামফ্রন্টের সময় জ্যোতিবাবু-বুদ্ধবাবুরা কেবল বিহারের কথা বলতেন, ছত্তীসগঢ়ের কথা বলতেন। বলতেন— ওদের তুলনায় আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য এ সবে কত ভাল আছি। আমাদের এখনকার মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এক নম্বরেই আছি বলেন, কিন্তু সে দিন পাড়ার রাস্তায় বক্তৃতা শুনলাম— সারদা নিয়ে এত হইচই কেন? কয়লা, টু-জি— এ সবে তো আরও বেশি হাজার কোটির ইয়ে। তার মানে সারদা তো পরিষ্কার। সবই তো রিলেটিভ, তাই না স্যর? দিন, কী বই আছে দিন।

swapnoc@rediffmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE