Advertisement
E-Paper

সু ম না মি

বর্ষাকালের মতো বর্ষার রাগ গান আমাদের দেশে একটা ব্যাপার। আমাদের সংস্কৃতিতে আবার বৈষ্ণব সাহিত্য, পদাবলির প্রভাব যথেষ্ট। ফলে বর্ষা এনে দিতে পারে অভিসারের গন্ধ, বিরহের আকুতি— যদি মন ঠিকঠাক সুরে বাঁধা থাকে। উচ্চ-মধ্য-মোটামুটি-নিম্ন’বিত্ত মানুষরা পাকা বাড়িতে থাকেন। ফলে সলিল চৌধুরীর তরুণ বয়সে লেখা গণগান ‘ভাঙা ঘরে বরষা ঝরঝর ঝরিলে কোথা যাই’-এর ভুক্তভোগী হবার সুযোগ প্রায় নেই।

কবীর সুমন

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৪ ০০:২০
ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

বর্ষাকালের মতো বর্ষার রাগ গান আমাদের দেশে একটা ব্যাপার। আমাদের সংস্কৃতিতে আবার বৈষ্ণব সাহিত্য, পদাবলির প্রভাব যথেষ্ট। ফলে বর্ষা এনে দিতে পারে অভিসারের গন্ধ, বিরহের আকুতি— যদি মন ঠিকঠাক সুরে বাঁধা থাকে।

উচ্চ-মধ্য-মোটামুটি-নিম্ন’বিত্ত মানুষরা পাকা বাড়িতে থাকেন। ফলে সলিল চৌধুরীর তরুণ বয়সে লেখা গণগান ‘ভাঙা ঘরে বরষা ঝরঝর ঝরিলে কোথা যাই’-এর ভুক্তভোগী হবার সুযোগ প্রায় নেই। বরং বাইরের কাজ তেমন না থাকলে ঘরের জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে ভালই লাগে। তখন সেই সলিল চৌধুরীরই ‘ঝিরঝিরঝির ঝিরঝিরি বরষায়’ গানটি জানা থাকলে মোক্ষম গেয়ে ফেলা যায়। ‘শনশনশন বহে হাওয়া/ মিছে গান গাওয়া’— কিন্তু গাইতে বড় সুখ, এমন গান।

বর্ষা নিয়ে গান বেঁধে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দফারফা করে গিয়েছেন। লিরিকের আবেদন, সুর ও ছন্দের বৈচিত্র— সব দিক দিয়েই তাঁর বর্ষার গানগুলি আমাদের দেশের ও আমাদের মনের বর্ষাকালের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়।

কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর বর্ষার গানে সুরসৌকর্যের ঘোড়ায় চেপে ছুটে বেড়িয়েছেন মর্জি হলেই। তাঁর ‘পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে’ কেউ ঠিকমত গাইলে কণ্ঠশিল্পীর পায়ে পড়ে যেতে ইচ্ছে হয়, গানটির তো বটেই। এ গানে মধ্যলয় খেয়ালের মেজাজ। অথচ কোথাও ক্লাসিকিয়ানা নেই। অর্থাৎ, বর্ষার বিষয়টি যখন আছেই, বর্ষামার্কা রাগই বেছে নেব সুরের উপাদান হিসেবে, তেমন নয়। গানটি আধুনিক গান। অবশ্য, কোনও গান রাগভিত্তিক হলেও তা আধুনিক হতেই পারে। আমাদের ভাণ্ডারে এমন উদাহরণ বিস্তর।

‘ক্লাসিকিয়ানা’ শব্দটি যাঁর লেখা থেকে শিখেছি, সেই রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান বাঁধতে গিয়ে কানে আঙুল দিয়ে বর্ষার রাগ চিনিয়ে দেবার লোক ছিলেন না। কয়েকটি বর্ষার গান বর্ষার রাগের ওপর, কিন্তু সব নয়। কার কোন গান চট করে মনে পড়বে, জানি না। তবে আমার যেমন মনে পড়ছে, ধরুন, ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে’, ‘যেতে দাও যেতে দাও গেল যারা’, ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ’, ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’। মৌসুমী রাগই বা কোথায়, ভারী গোছের অন্য রাগই বা কই? বরং হিমাংশু দত্তর সুর-করা ‘ওগো বাদলরাতি’ গানটি মৌসুমী রাগে না হলেও অবিসংবাদিত ভাবে ওজনদার রাগ দরবারি কানাড়ায়।

আধুনিক যুগে বাংলার বর্ষার গান বর্ষার রাগের পাড়ায় বেশি ঘোরাঘুরি না করলেও প্রেম ও বিরহকেই করে তুলেছে প্রধান উপজীব্য। এর কারণ হয়তো আমাদের বৈষ্ণব সাহিত্যের উত্তরাধিকার। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই আমরা পেয়েছি প্রেম-বিরহের ভাবাবেগ-বর্জিত বর্ষার ‘এমনি এমনি’ উদ্যাপন। যেমন, ‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে’ বা ‘আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া’।

রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে লিরিকের যে গুরুত্ব ও ব্যঞ্জনা, ‘স্বর্ণযুগ’-এর বর্ষা-গানের লিরিকে তা বিরল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের বেশ কিছু বর্ষার গানের ভাবগাম্ভীর্য যদি এই ঋতুর গানের একমাত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে থেকে যেত, দেখা দিত একঘেয়েমি। সব গান আর্ট সং হলে চলে না। বর্ষাকালে দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছি, সুকণ্ঠের অধিকারী কেউ এক জন গান ধরলেন ‘সঘন গহন রাত্রি’ বা ‘শাওনরাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’— মাপ করবেন, পারলাম না। মজা করতে করতে, এ-ওর পেছনে লাগতে লাগতে বেড়াতে যাচ্ছি আমরা। মোটেও তেমন গানের গলা নেই এমন কেউও যদি তখন ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটি গলা খুলে ধরে ফেলেন তো কারুর ‘নিমন্ত্রণ’ তিনি বাস্তবিকই পেয়ে যেতে পারেন বই কী।

গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের রম্যগীতিতে গোপাল দাশগুপ্তর কথায় ও আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সুরে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় একটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন: ‘বন্ধু হে পরবাসী’। ‘দেখেছ কি হায়/ বাদলধারায়/ দিগন্ত আজি যায় ভাসি...বন্ধু হে পরবাসী’। এই এক জন মানুষ ছিলেন— গোপাল দাশগুপ্ত। কেউ তাঁকে মনে রাখে না আর। দেশভাগের পর পুব থেকে পশ্চিমে চলে আসেন। যেমন গান লিখতেন, তেমন করতেন সুর। হাসিখুশি, সদালাপী অথচ মিতভাষী এই সংগীতকার আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সংগীত বিভাগে চাকরি নিয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকেই। রাগসংগীত-ঘেঁষা, মধ্যলয় তিনতালে প্রায় খেয়ালের বন্দিশের মতো করে বাঁধা এই গানটি আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ম্যাজিকে এক মুহূর্তের জন্যেও রবীন্দ্রকথিত ‘ক্লাসিকিয়ানা’ বা ‘সাবেকিয়ানা’র হাতছানিতে তার আধুনিকতাকে খোয়ায়নি। কী গানই না গেয়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

তেমনি, রম্যগীতিতে পঞ্চাশের দশকেই গায়ত্রী বসু রেকর্ড করেছিলেন ‘মেঘ’ রাগে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষেরই সুরে (লেখাও কি তাঁর?) ‘ময়ূরী নাচ’। বর্ষার গান। বলতে গেলে ‘আর্ট সং’ পর্যায়েরই। ‘মেঘ’ রাগে আধুনিক বাংলা গান সম্ভবত সেই প্রথম এবং শেষ।

পঞ্চাশের দশক থেকে বর্ষা-সংক্রান্ত লিরিকওয়ালা আধুনিক বাংলা গানে আমরা মান্না দে’র গাওয়া ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ গানটিতে কথা, সুর, গায়কি মিলিয়ে নিঃসঙ্গতা ও দুঃখভারাক্রান্ত যে মেজাজ পেয়েছি, কালক্রমে তা সরে গিয়ে— বিরহ সত্ত্বেও— একটা স্ফূর্তির ছন্দোময়তা দেখা যায়। যেমন, মৃণাল চক্রবর্তীর সুরে-গাওয়ায় ‘ঠুং ঠাং ঠুং ঠাং চুড়ির তালে’। এই গানের সুরগত রোম্যান্টিকতা বিরহ-ছোঁয়া, কিন্তু তাতে দুঃখের ভার নেই।

নতুন যুগে, বর্ষার গানে দেখা গিয়েছিল লিরিকে প্রকৃতির ছবি কমে আসছে। আধুনিক বাংলা গান নগরজীবনের গান— সেই কারণেই হয়তো। সুর-ছন্দ-গায়কির দিক দিয়েও যেন একটা নতুন মেজাজ তৈরি করে নিয়েছিলেন গীতিকার-সুরকার-কণ্ঠশিল্পীরা, যেখানে ভাবগাম্ভীর্য কম, সাধারণত্ব বেশি। সুর, ছন্দ ও যন্ত্রানুষঙ্গে যে ইডিয়মগুলি ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেগুলি পঞ্চাশের দশকের আগে বাংলা গানে প্রায় ছিল না বলাই ভাল।

বর্ষার গানে সেই নবযুগের জনপ্রিয় সৃষ্টিগুলির মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে রয়েছে— সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘এল বরষা’ ও ‘আকাশ এত মেঘলা’ (সুধীন দাশগুপ্ত), গায়ত্রী বসুর গাওয়া ‘মেঘ মেঘ মেঘ কত মেঘ করেছে আজ’ ও ‘যা ছিল কথা আমার হৃদয়মাঝে’ (অভিজিৎ), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘থই থই শাওন এল ওই’ (সুধীন দাশগুপ্ত), মান্না দে’র গাওয়া ‘রিমঝিমঝিম বৃষ্টি’ (রতু মুখোপাধ্যায়)।

লিরিক লেখকদের নাম লিখতে না পারার লজ্জা নিয়ে শেষ করছি।

kabir suman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy