Advertisement
E-Paper

খাসমহলের আমচর্চা

আমাদের ভোজ-রীতির প্রতি গ্রাসের মধ্যে গেঁড়ে বসা পুরুষতন্ত্রের কড়া গিঁটও কিন্তু আমের বেলায় খানিক ঢিলে হয়েছে। লিখছেন ঋজু বসুআমাদের ভোজ-রীতির প্রতি গ্রাসের মধ্যে গেঁড়ে বসা পুরুষতন্ত্রের কড়া গিঁটও কিন্তু আমের বেলায় খানিক ঢিলে হয়েছে। লিখছেন ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০০


বিলেতে চোখ বেঁধে ওয়াইনের জাত বিচার করার মতো দক্ষ লোকেদের গপ্পো অনেক শোনা হয়েছে। সে কালের কলকাতাতেও না কি ওস্তাদেরা চোখ বুজে খেয়ে বলে বলে কী জাতের আম শুনিয়ে দিতে পারতেন!

হিমসাগর, পেয়ারাফুলি, বোম্বাই, ফজলি, কিষেণভোগ, তোতাপুরি, মধুকুলকুলি— এক এক জাতের আমের জন্য নির্দিষ্ট ‘এক্সক্লুসিভ’ বঁটি থাকত বড়ঘরের অন্দরমহলে। পাছে অন্য কোনও অর্বাচীন ফলের ছোঁয়া লাগে! আম কোটার পরে সে বঁটি ধুয়েমুছে লুকিয়ে রাখাই দস্তুর! আর মুর্শিদাবাদী নবাবদের আদরের ধন কোহিতুরকে তুলোর বিছানায় শুইয়ে তোয়ের করা হত। বঁটি-ছুরির লোহায় ছুঁলে স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে, তাই বাঁশের ছিলকেয় কোটাই ছিল নিয়ম। আম নিয়ে এমন হাজারো মিথ ঘুমিয়ে থাকে কলকাতার শরীরে। ফি বছর বোশেখ-জষ্ঠির ছোঁয়ায় তা স্মৃতির দরজা ঠেলে বেরোতে চায়।

মার্বেল প্যালেসের মল্লিকবাড়ির কর্তা হীরেন মল্লিক তাই আম-নাম শোনামাত্র গতজন্মে ডুব দেবেন। এই তো মেহগনি কাঠের পিঁড়িতে বসে মা-দিদিমারা কী যত্নে জামাইদের জন্য আম কুটতে বসেছেন! পেতলের গামলায় রেখে ঠান্ডা করা এক একটি নিটোল হলুদবরণ আমের বোঁটা ছিঁড়ে প্রথমেই কষটা ধুয়ে ফেলা হত। নিপুণ হাতে খোসা ছাড়িয়ে এক একটি আম সম্পূর্ণ আঠামুক্ত করার কসরত ছিল দেখার মতো। ‘‘হাতে গ্লাভ্স পরে বা কী সব দোকানের কেনা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুলেও এতটা পবিত্র ভাবে আম কোটা কক্ষণও সম্ভব হবে না।’’— বলছিলেন প্রিন্স রাজেন্দ্রলাল মল্লিকের বংশের উত্তরপুরুষ। আম কোটার বিশেষ বঁটি আসত নবদ্বীপ-কাটোয়া থেকে। কোটাকুটির দক্ষতায় আমের গায়ে একটা আঁশও লেগে থাকত না। ফল খাওয়ার পাথরের বাটিও ছিল দেখবার মতো। জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্নে তপসে ভাজা বা চিংড়ি মালাইকারিকে ছাপিয়ে এই আম্র-পর্বই হয়ে উঠত মেন কোর্স।

যে কোনও উপলক্ষে যে সে আম আবার চলবে না। জামাই আদরের সেরা আম যেমন ‘কপাটভাঙা’। সে সব আমের নামই আজকাল ক’জন শুনেছে? হন্যে হয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। মধ্যমগ্রাম, বারাসত থেকে মালদহ, দিনাজপুরের গাছের ‘কপাটভাঙা’ সে কালে হাতিবাগান, বড়বাজার, ভবানীপুরে ছেয়ে থাকত। সাইজে হিমসাগরের থেকে খানিকটা ছোট। হলুদবরণ গায়ে সব্‌জে আভা। যেমন সোয়াদ, তেমনই ঘ্রাণ। রসালো আম ভরপেট খেয়েও হেসে-খেলে পাঁচ-ছ’টা সাবাড় করে ফেলতে পারতেন নিতান্তই অনুচ্চ, ক্ষীণকায় নারী-পুরুষেও। আমের আবেশ জিভে নিয়েই একেবারে শেষ পাতে সরের ক্ষীরযোগে শেষ হত জামাইবাবাজির আপ্যায়ন।

এই জষ্ঠি মাসেই মঙ্গলচণ্ডীর পুজোর ১৭ রকম ফলের উপচারে আবার কপাটভাঙা চলবে না। তখন চাই বড় হিমসাগর। হিমসাগরের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিতে আবার সে যুগের পুরুষপুঙ্গবেরা প্রায় বাজি ধরে সম্মুখসমরে পাঙ্গা নিতেন। চোরবাগানের মিত্তিরবাড়ির কথাই ধরা যাক। মিত্তিরদের কুটুম এলগিন রোডের নিউ থিয়েটার্সখ্যাত দিলীপ সরকারদের পরিবার কিংবা হাটখোলার দত্তবাড়িও সাক্ষী সেই আম খাওয়ার টক্করের।

হাটখোলার আস্তিক দত্তের মনে আছে, বছর চল্লিশ আগের কৈশোরের কথা। তাঁর মামার বাড়ি চোরবাগানের মিত্তিরদের ওখানে সক্কলে পাশাপাশি বসে আমখাওয়া হত। দিদিমা নিপুণ হাতে খোসা ছাড়িয়ে আস্ত আঁটিসুদ্ধ আম কেটে কেটে দিচ্ছেন। আর তা পাতে পড়তেই নিমেষে নিঃশেষ। আর সেজমামা অজিতেন্দ্রনাথ মিত্রের এমনিতে মাছমাংস মুখে রোচে না। কিন্তু আমের নামে অজ্ঞান। সেজমামা একবার বসলে কম করে খান পঁচিশ-তিরিশ আম সাবাড় না করে উঠতেন না।

ফ্ল্যাশব্যাকে অত দূর পিছনে না হাঁটলেও আড়াই-তিন দশক আগের বিয়েবাড়িও আমের সৌরভে মদির। চোকলা ধরে পাতে পাতে পৌঁছে দিতে এক নাগাড়ে আম কেটে যেতে লোক ফিট করা থাকত। শেষ পাতে আঁটিসুদ্ধ চুষে খাওয়ার মধ্যেই ভোজবাড়ির আমোদ গাঢ় হত।

আর খুব বড়বাড়ির বাইরে ছাপোষা মধ্যবিত্তের অন্দরমহলও তখন খাটের তলায় আমের উপচে পড়া ঝুড়িতে ভরপুর। আলফান্সো-হিমসাগর হল গিয়ে আঁশ-ছিবড়েবিহীন ‘টেব্‌ল ম্যাঙ্গো’। আম-রসিক আম-জনতা অত গুছিয়ে আম কেটেকুটে দেওয়ারও পরোয়া করত না। বরং দেখা যেত, চানে যাওয়ার আগে স্রেফ গামছামাত্র অবলম্বন করে আঙুল দিয়ে ফুটো করা আম অমৃত পানের ঢঙে চুষে-চুষে খাওয়া চলছে বিভোর হয়ে। খেতে গিয়ে কনুই অবধি রস গড়িয়ে পড়ছে। রসে মাখো-মাখো অবস্থায় কনুই অবধি লেগে থাকা রস জিভ বাড়িয়ে সুড়ুত করে টেনে নেওয়াটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যবহার বলেই গণ্য করা হত। ইচ্ছে মতো আমে মাখামাখি হয়ে এই ‘অনার্য’ ভঙ্গিতে আম সাবাড় করেই আম্ররসিক চানে যেতেন।

পুনশ্চ: একটা আনন্দের কথা, আমাদের ভোজ-রীতির প্রতি গ্রাসের মধ্যে গেঁড়ে বসা পুরুষতন্ত্রের কড়া গিঁটও কিন্তু আমের বেলায় খানিক ঢিলে হয়েছে। এটা ঠিকই, সেরা আম সব বাড়ির পুরুষ বা জামাইদের জন্য বাছাই করা থাকত। কল্যাণী দত্তের ফিরিস্তি বলছে, জামড়োধরা, শিলপড়া বা দাগি আমগুলোর গায়েই নম্বর লিখে বাড়ির গিন্নি, কাজের লোকেদের জন্য বরাদ্দ হত। তবু শুধু মেয়েদের জন্যই বাপের বাড়িতে আম খাওয়ার আলাদা নেমন্তন্নের আসরও বসত বৈকি! শ্বশুরবাড়িতে সব সময়ে আম খেয়ে জুত হতো না বলেই এই নিভৃত নারীজগতে ইচ্ছে মতো দেদার আম-আস্বাদের স্বাধীনতা। পাড়ার মেয়ে-বউরাও অনেকেই এই আসরে সামিল হতেন।

প্রাণ ভরে আম খেয়ে সাধ মেটানোর টানে গড়ে ওঠা মুক্তির আসর!

ছবি সৌজন্য: সুইসোতেল
ছবি: শুভেন্দু চাকী

mango riju basu kolkata marbel palace katwa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy