ছবির ইনসেটে বিজ্ঞানী বিশ্বজিত্ পাল (উপরে) এবং বিজ্ঞানী অঞ্জন দত্ত
আবার বাঙালির জয়জয়কার! এ বার আদিগন্ত, অতলান্ত মহাকাশে।
আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে ভিনগ্রহের ভিন মুলুকে। এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘আমাদের পাড়া’ মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির খাসতালুকেই।
এক ‘পাগলাটে’ ভিনগ্রহ আবিষ্কার করলেন দুই বাঙালি। বিজ্ঞানীদের এক জন বেঙ্গালুরুর। অন্য জন দিল্লির। আর এই ভাবেই ভিনগ্রহ আবিষ্কারের সঙ্গে এই প্রথম জড়িয়ে গেল বাঙালির নামও। বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আরআরআই) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ পাল আর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অঞ্জন দত্তের সুবাদে। মূল গবেষক বিশ্বজিৎবাবু ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) আসন্ন মেগা প্রোজেক্ট ‘মিশন পোলিক্স’-এর প্রধান। পাঁচ জনের গবেষকদলে রয়েছেন দিল্লির হংসরাজ কলেজের গবেষক চেতনা জৈনও।
আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে ভিন মুলুকে যে গ্রহটির হদিশ পেয়েছেন বাঙালিরা, তা আমাদের পৃথিবীর চেয়ে ২৫ হাজার গুণ বড়! আর আমাদের বৃহস্পতি গ্রহের ২৫ গুণ চেহারা সেই সদ্য আবিষ্কৃত ভিনগ্রহটির। রয়েছে আমাদের থেকে ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। ‘ওফিউকাস’ নক্ষত্রপুঞ্জে।
যে ভাবে জোরালো অভিকর্ষ বলে তারার দেহাংশ টেনে নেয় নিউট্রন নক্ষত্র
অবাক করা সেই ভিনগ্রহটি দিনরাত ‘পুজো’ দেয়, প্রদক্ষিণ করে তার দু’-দু’টি নক্ষত্র বা তারাকে। সেই ভিনগ্রহের দুই ‘দেবতা’! সেই দুই ‘দেবতা’র মধ্যে আবার বনিবনা নেই একেবারেই। এক জন খাদক। অন্য জন খাদ্য। এক ‘দেবতা’ মৃত্যুপথযাত্রী। ধীরে ধীরে তার শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে আর এক ‘দেবতা’। অন্য ‘দেবতা’ দেখতে কার্যত বিন্দুর মতো হলেও, তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। সে আদতে একটি নিউট্রন নক্ষত্র। দু’জনকেই প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছে সেই সদ্য আবিষ্কৃত ভিনগ্রহটি। বলা ভাল, কিছুটা মজাও দেখছে! কারণ, দুই ‘দেবতা’র অহি-নকুল সম্পর্ক দেখতে দেখতে সে দু’জনকেই ছেড়ে চলে যাচ্ছে আদিগ্ন্ত, অতলান্ত মহাকাশের আরও আরও দূরে। সর্বগ্রাসী ক্ষুধার রাক্ষুসে ‘দেবতা’রও সাধ্য নেই তাকে গিলে খাওয়ার!
এই চমকে দেওয়া আবিষ্কারের খবরটি ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মান্থলি নোটিশ অফ রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র ১৪ মার্চ সংখ্যায়। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘ইন্ডিকেশান অফ আ ম্যাসিভ সারকামবাইনারি প্ল্যানেট অরবিটিং দ্য লো মাস এক্স-রে বাইনারি এমএক্সবি ১৬৫৮-২৯৮’।
বাঙালির এই আবিষ্কারের অভিনবত্ব কোথায়?
ডান দিকে বিন্দুর মতো সেই নিউট্রন নক্ষত্র। বাঁ দিকে সেই ‘খাদ্য’ তারা
বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আরআরআই) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ পাল বলছেন, ‘‘আমরা যে নক্ষত্রমণ্ডলে ভিনগ্রহটির হদিশ পেয়েছি, সেখানে আসলে দু’টি তারা রয়েছে। এটাকে বলে বাইনারি সিস্টেম। এই রকম অনেক বাইনারি সিস্টেমের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। আসলে এই ব্রহ্মাণ্ডে বাইনারি সিস্টেমের সংখ্যাই বেশি। আমাদের সৌরমণ্ডল বরং কিছুটা ব্যতিক্রমই। এখানে একটি নক্ষত্রেরই মাতব্বরি। আর আমরা যে নক্ষত্রমণ্ডলে ভিনগ্রহটির হদিশ পেয়েছি, সেখানে রয়েছে একটি নিউট্রন নক্ষত্র। যা অসম্ভব রকমের ভারী (আমাদের সূর্যের চেয়ে দেড় থেকে দু’গুণ ভারী)। যাকে বলে কমপ্যাক্ট নক্ষত্র। তার মানে কোনও সুদূর অতীতে সেটাও ছিল কোনও বড় নক্ষত্র। কোনও নক্ষত্র তার জীবন-চক্রের শেষ ধাপে হয় কোনও ব্ল্যাক হোল হয়ে যায় বা তা হয়ে যায় কোনও নিউট্রন নক্ষত্র। দু’টিরই অসম্ভব খিদে। দু’টিই রাক্ষুসে। এ ক্ষেত্রেও নিউট্রন নক্ষত্রটি অন্য তারাটিকে গিলে নিচ্ছে। সেই তারাটিকে বলে কমপ্যানিয়ান স্টার বা সঙ্গী নক্ষত্র। দূর থেকে দেখলে এই সঙ্গী নক্ষত্রটিকে মনে হবে যেন চোখের জলের একটি বিন্দু। নিউট্রন নক্ষত্র বিন্দুর মতো দেখতে হলে হবে কি, ব্ল্যাক হোলের মতোই তা অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বল দিয়ে টেনে নিতে থাকে সঙ্গী তারাটির দেহাংশগুলিকে। অনেকটা যেন থালার আশপাশে (অ্যাক্রিশন ডিস্ক) এঁটোকাঁটা ছড়িয়ে রাখে। আর সেই থালার ওপর যখন যাকে খাচ্ছে, সেই তারাটির শরীরের অংশগুলি এসে পড়তে থাকে, তখন তা শক্তি হারিয়ে এক্স-রে বিকিরণ করে। সেই জন্যই এই ধরনের বাইনারি সিস্টেমকে বলে এক্স-রে বাইনারি সিস্টেম। এই দু’টি তারার এক্স-রে বাইনারি সিস্টেমটির আবিষ্কার হয়েছিল আগেই। কিন্তু সেই বাইনারি সিস্টেমে যে এমন একটি ভিনগ্রহও রয়েছে, তা আগে জানা যায়নি। আমরা তারই হদিশ পেয়েছি। এই ভিনগ্রহটি গড়ে সাত ঘণ্টায় তার দু’টি তারার চার পাশে পাক মারে। এটাই তার অরবিটাল পিরিয়ড। তবে আমরা এটাও দেখেছি, সেই অরবিটাল পিরিয়ড বদলায়। মানে, আমাদের পৃথিবীর মতো তা সূর্যকে ঘড়ির কাঁটা ধরে ৩৬৫ দিনে পাক মারে না। এখনও পর্যন্ত কোনও বাইনারি সিস্টেমে যে ভিনগ্রহগুলির হদিশ মিলেছে, এটি তার মধ্যে বৃহত্তম।’’
আরও পড়ুন- সূর্যকে দিয়ে ভিনগ্রহ খোঁজাবে নাসা, কাজে লাগাবে আইনস্টাইনকেও!
১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নালে প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রটি
আরও একটি অভিনবত্ব রয়েছে বাঙালির এই প্রথম ভিনগ্রহ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। সেটা কী?
বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘আমরা যে পদ্ধতিতে এই ভিনগ্রহটি আবিষ্কার করেছি, বিশ্বে এই পদ্ধতিতে এর আগে কোনও ভিনগ্রহ কেউ আবিষ্কার করেননি। পদ্ধতিটির নাম- পিরিয়ডিক ভেরিয়েশন্স ইন একলিপ্স টাইম।’’
সঙ্গী দুই তারাকে ছেড়ে মহাকাশে দূর থেকে দূরে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও একটি দৃষ্টান্ত গড়ে দিয়ে গেল এই ভিনগ্রহ!
ছবি সৌজন্যে; নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy