Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Science News

জৈব অণুর চেহারা দেখিয়ে রসায়নে নোবেল তিন ইউরোপীয়ের

আমাদের এই এত বড় শরীরের অন্তরে, অন্দরে রয়েছে বিভিন্ন জৈব ও জটিল যৌগের অণু আর তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু। ডিএনএ, আরএনএ। সেগুলি এতটাই ছোট, এমনকী ছোট বিন্দুর লক্ষ-কোটি ভগ্নাংশের চেয়েও যে, তাদের আচার-আচরণ, স্বভাবচরিত্র, মতিগতি ঠিক কী রকম, কোনও দিনই তা দেখতে পাওয়া সম্ভব হত না যদি না আমাদের হাতে এসে যেত তাদের দেখার, বোঝার, চেনা ও জানার মোক্ষম হাতিয়ার ক্রায়ো-ইএম।

নোবেল পদক।

নোবেল পদক।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৭ ১৯:১৭
Share: Save:

আমাদের শরীরের ভিতরের অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার উপায় আর আমাদের জীবনের নজর এড়িয়ে চলা ‘কারিগর’দের হাতেনাতে ধরিয়ে ও চিনিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার বাতলিয়ে এ বার রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন বিজ্ঞানী। জাকুস দুবোশে, জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক ও রিচার্ড হেন্ডারসন। প্রথম জন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। দ্বিতীয় জন জার্মান আর তৃতীয় জন স্কটিশ। ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ (ক্রায়ো-ইএম) আবিষ্কারের জন্য। যার ফলে বায়োকেমিস্ট্রির গবেষণাটাই হয়ে গিয়েছে সহজতর। এই ভাবে নজর এড়িয়ে চলাদের ধরিয়ে দেওয়ার পথ দেখিয়েই এ বার নোবেল পুরস্কার কমিটির নজরে পড়ে গেলেন এই তিন বিজ্ঞানী। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, পুরস্কারের অর্থমূল্য ৯০ লক্ষ ক্রোনার (সুইডিশ মুদ্রা) তিন জনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের এই এত বড় শরীরের অন্তরে, অন্দরে রয়েছে বিভিন্ন জৈব ও জটিল যৌগের অণু আর তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু। ডিএনএ, আরএনএ। সেগুলি এতটাই ছোট, এমনকী ছোট বিন্দুর লক্ষ-কোটি ভগ্নাংশের চেয়েও যে, তাদের আচার-আচরণ, স্বভাবচরিত্র, মতিগতি ঠিক কী রকম, কোনও দিনই তা দেখতে পাওয়া সম্ভব হত না যদি না আমাদের হাতে এসে যেত তাদের দেখার, বোঝার, চেনা ও জানার মোক্ষম হাতিয়ার ক্রায়ো-ইএম।

আরও পড়ুন- আসছে ডেঙ্গি, জিকা, ক্যানসারের নতুন ওষুধ, সৌজন্যে ক্রায়ো-ইএম


রসায়নে তিন নোবেলজয়ী: (বাঁ দিক থেকে) জাকুস দুবোশে, জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক ও রিচার্ড হেন্ডারসন

যার হানাদারিতে আমাদের শরীরের কোষগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে, মরে যায়, সেই সালমোনিলা ব্যাকটেরিয়া ঠিক কী ভাবে তার ছুঁচটি ফুটিয়ে দেয় কোষে, তা কোনও দিনই জানা সম্ভব হত না যদি না থাকতো ক্রায়ো-ইএম। ক্যানসার সারানো বা ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলির শরীরে ছড়িয়ে পড়া রুখতে যে সব ওষুধ ব্যবহার করা হয় (কেমোথেরাপি), সেগুলি যে সব প্রোটিনের জন্য ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বা ঘুমিয়ে পড়ে, বা অ্যান্টিবায়োটিক্স, কাউকেই চেনা যেত না ক্রায়ো-ইএম না থাকলে। বলা যেত না কোন কোন প্রোটিন অণু বা কী ধরনের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আমাদের দেহের ঘড়িকে (বডি ক্লক) চালায়, কী ভাবে চালায়। বলা সম্ভব হত না সালোকসংশ্লেষের কোন কোন ধাপে পাতার ভিতরে চলা কোন কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া কী ভাবে কতটা শুষে নেয় সূর্যালোক। এই সব কিছুর কারিগর যে সব জৈব অণু, তাদের প্রথম ধরিয়ে দিয়েছিল, চিনিয়ে দিতে পেরেছিল ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপই।

ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি কী জিনিস? বোঝাচ্ছেন নোবেলজয়ী রিচার্ড হেন্ডারসন। দেখুন ভিডিও

আরও পড়ুন- আইনস্টাইনকে পাশ করিয়ে নোবেল পেলেন তিন পদার্থবিজ্ঞানী

আরও পড়ুন- শরীরের নিজস্ব ঘড়িকে চিনিয়ে তিন বিজ্ঞানীর নোবেল

মুকুটে আরও ‘পালক’ রয়েছে ক্রায়ো-ইএমের

ব্রাজিলে যখন মহামারী হয়ে উঠল জিকা ভাইরাস, তখন হাজারো তল্লাশ করেও সেই ভাইরাসের টিকির দেখা মিলছিল না। মিলছিল না বলেই তাকে বধ করারও কোনও হাতিয়ার খুঁজে বের করতে পারছিলেন না গবেষকরা। বেরচ্ছিল না কোনও ওষুধ বা প্রতিষেধক। কয়েক মাসের চেষ্টার পর সেই অন্ধকারে আলো দেখাল ক্রায়ো-ইএম। ওই বিশেষ ধরনের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমেই প্রথম ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা সম্ভব হয়েছিল জিকা ভাইরাসের।

ক্রায়ো ইএমের তলায়: প্রোটিন অণুর গঠন (বাঁ দিক থেকে), শোনার জন্য সেন্সর ও জিকা ভাইরাস

গত শতাব্দীর আটের দশকে সেই সমস্যা মেটাতে চালু পদ্ধতি এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্র্যাফির বদলে এল নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (এনএমআর) স্পেকট্রোস্কোপি। তাতে যে ছোট ছোট প্রোটিনগুলি কঠিন অবস্থায় আর তরল দ্রবণে থাকতে পারে, তাদের দেখাটা সহজ হল। ওই পদ্ধতিতে শুধুই প্রোটিন অণুগুলির গঠনকাঠামো দেখা যে সম্ভব হল, তাই নয়, শরীরে সেই অণুগুলি কী ভাবে চলাফেরা করে, কার কার সঙ্গে কী ভাবে কোন কোন পথে বিক্রিয়া করে, সেটা চাক্ষুষ করাটাও আর অসম্ভব থাকল না।

দু’টি পদ্ধতিরই যেমন কিছু সুবিধা ছিল, তেমনই ছিল কিছু অসুবিধাও। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্র্যাফিতে যেমন কেলাস অবস্থায় না থাকলে প্রোটিনকে দেখা যায় না, তেমনই কোনও দ্রবণে এনএমআর পদ্ধতিতে একমাত্র তুলনায় ছোট প্রোটিনগুলিকেই দেখতে পাওয়া সম্ভব। আকারে বড় প্রোটিনগুলিকে দেখতে পাওয়া যায় না। সেই জন্যই সাতের দশকে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্র্যাফিকে বাতিল করার পথে এগিয়েছিলেন রিচার্ড হেন্ডারসন। আর জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক সেই ছবিগুলিকে আরও উন্নত করার উপায় বাতলেছিলেন।

দুবোশের কৃতিত্বটা কোথায়?

তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিটির নাম ছিল- ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতি।

ভিট্রিফিকেশন কী জিনিস?

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপিতে জল যোগ করাটাই ছিল দুবোশের কৃতিত্ব। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির শূন্যতায় (ভ্যাকুয়াম) জল বাশ্পীভূত হয়ে যায়। উবে যায়। তার ফলে যে জৈব অণুগুলিকে দেখতে হবে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে, সেগুলি ভেঙে যায়। দুবোশের ভিট্রিফিকেশনের পদ্ধতিটা ছিল খুব তাড়াতাড়ি জলকে ঠান্ডা করা। আর সেটা এতটাই তাড়াতাড়ি করেছিলেন তিনি যাতে তরল অবস্থাতেই জল জমে কঠিন হয়ে যায়। ফলে জৈব অণুর চার পাশে থাকা তরল অবস্থায় থাকা জলই জমে কঠিন হয়ে যায়। তাই সেই জৈব অণুরও আর ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তার চেহারা অবিকৃত থাকে এমনকী ভ্যাকুয়ামেও।

সেই ‘ভানুমতীর খেল’ দেখিয়েই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা অনেক জটিল জৈব অণুকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিতে পেরেছে ক্রায়ো-ইএম।

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: রয্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE