Advertisement
E-Paper

বিপদ মনে রাখাই চাবিকাঠি

সফল হয়েছে করোনা ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ট্রায়াল, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সাবধানীভ্যাকসিনের কাজ হল দেহের প্রহরী কোষগুলোকে উত্তেজিত করে সংক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুত করা।

অর্ঘ্য মান্না

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২০ ০৬:১১

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। একই দিনে প্রকাশ পেল তিনটি গবেষণাপত্র, যার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার চাবিকাঠি। এর মধ্যে দুটো প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এ। তৃতীয়টি এখনও ছাড়পত্রের অপেক্ষায়। তবে পড়তে বাধা নেই। ওয়েবসাইটে ঢু মারলেই পড়া যাচ্ছে সেই গবেযণাপত্রও। তিনটিতেই লেখা হয়েছে কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির উপায়।

বেশ কয়েক বছর আগে একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল পৃথিবীতে কোন বাক্যটি শুনতে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে? ‘আই লাভ ইউ’-কে হারিয়ে শীর্ষে উঠে এসেছিল ‘ইট ইজ় বিনাইন’— ‘আপনার টিউমারটি নির্বিষ’, মেটাস্টাসিস পদ্ধতিতে তা গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে না, এটি ক্যানসার নয়। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে একই সমীক্ষা করলে যে বাক্যটি ট্রফি জিতবে তা সবার জানা, ‘করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বাজারে এসে গিয়েছে’।

২০ জুলাই প্রকাশিত তিনটি গবেষণাপত্র সেই আশাই জোরদার করেছে। তিনটি গবেষণাপত্রেরই বক্তব্য এক, করোনা রুখতে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মিলেছে সাফল্য। তৃতীয় পর্যায়ের সাফল্য মিললে ভ্যাকসিন বাজারে আসতে দেরি হবে না। ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াস। তাই গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল সে দেশের সরকারি বক্তব্যের দিকে। ব্রিটিশ প্রাধানমন্ত্রী বরিস জনসন অবশ্য জানিয়েছেন, এই বছরে ভ্যাকসিন বাজারে আসবে না। তা হলে কি আশাবাদী হওয়া বৃথা? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।

‘দ্য ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত দুটো গবেষণাপত্রের একটি প্রকাশ করেছে সারা গিলবার্টের নেতৃত্বে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল, সহযোগী আরও চারটি গবেষণাকেন্দ্র। ২৩ এপ্রিল প্রথম ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়ালের কথা ঘোষণা করে খবরের শিরোনামে আসে এই প্রকল্প। শিম্পাঞ্জির সর্দি-কাশির কারণ হতে পারে এমন একটি নিরীহ ভাইরাসের বাইরের প্রোটিনগুলোকে ছেঁটে ফেলে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে পারে, এমন জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, নিরীহ অ্যাডিনোভাইরাসকে করোনার স্পাইক প্রোটিনে সজ্জিত করে ভ্যাকসিন হিসেবে মানবশরীরে পরীক্ষা করা। ইবোলা সংক্রমণ রুখতে এই পদ্ধতিতেই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল। এই পরীক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়াল সফল। ‘দ্য ল্যানসেট’-এ এই সাফল্যের খতিয়ানই প্রকাশিত হয়েছে।

সাফল্য দু’টি। এক, ভ্যাকসিন প্রয়োগের ১৪ দিনের মধ্যে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য শরীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে টি লিম্ফোসাইটের কার্যক্ষমতা। দুই, ২৮ দিনে শরীরে তৈরি হচ্ছে স্পাইক প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডি।

দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছে চিনের হুবেই প্রভিশনাল সেন্টার ফর ডিজ়িজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এ কর্মরত গবেষক দল। তাঁদের ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতির সঙ্গে অক্সফোর্ডের দলটির তেমন পার্থক্য নেই। সাফল্যও সমান। তা হলে এখনই বাজারে ভ্যাকসিন আসতে বাধা কোথায়?

আসল কথা, প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়াল পর্বে মাত্র কয়েকশো স্বেচ্ছাসেবকের উপর পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় পর্বের ট্রায়ালে সংখ্যাটা হাজারখানেক। একমাত্র তার পরই বলা সম্ভব ভ্যাকসিন তৈরি সফল। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আরও কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখার পরেই তাঁরা একশো শতাংশ নিশ্চিত হবেন। সেগুলি মানবশরীরের জটিল ইমিউনোলজি বা অনাক্রম্যতা বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। চোখ রাখা যাক।

সফল ভ্যাকসিন ট্রায়ালের যেমন তিনটি ধাপ, তেমনই মানবশরীরে ভ্যাকসিনের সাহায্যে ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতা বৃদ্ধিরও রয়েছে তিনটি ধাপ। বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলোকে বলা হয়, প্রাইমিং, বুস্টিং এবং লংটার্ম মেমারি ডেভেলপমেন্ট। ভ্যাকসিনের কাজই হল, সংক্রামক বস্তু থেকে দেহকে রক্ষা করতে যে সমস্ত প্রহরী কোষ রয়েছে, তাদের মাঠে নামতে বাধ্য করা। ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময় সংক্রামক বস্তুর সামান্য অংশ শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, যাতে প্রহরী কোষগুলো আসন্ন বিপদ চিনতে পারে। যেমন করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অ্যাডিনোভাইরাসের খাঁচা সম্বল করে কোভিড-১৯’-এর স্পাইক প্রোটিন দেহে প্রবেশ করানো হয়েছে।

একেই বলে প্রাইমিং। বাইরের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রহরী কোষগুলোর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া, সেনাবাহিনীতে আরও বেশি করে প্রহরী কোষ নিয়োগ করা এবং অস্ত্রভান্ডার মজুত করা— এই পর্যায়ের তিনটি ভাগ। প্রহরী কোষগুলো হল মূলত ম্যাক্রোফাজ, ডেনড্রাইটিক কোষ, বি লিম্ফোসাইট এবং টি লিম্ফোসাইট। অস্ত্র হল অ্যান্টিবডি। দেহে বিপদ তৈরি করতে পারে— বাইরে থেকে আসা এমন প্রোটিনকে বলা হয় অ্যান্টিজেন।

অ্যান্টিবডি অ্যান্টিজেনকে নিষ্ক্রিয় করে। প্রথমেই কোমর বেঁধে মাঠে নামে ম্যাক্রোফাজ ও ডেনড্রাইটিক কোষ। এদের কাজ হল বাইরের শত্রুকে গিলে ফেলা। কিন্তু তাতে তো ভবিষ্যতের বিপদের আশঙ্কা কাটে না। তাই বুদ্ধি করে কোষগুলি শত্রুর অস্ত্রকে উগরে দেয়। অর্থাৎ যদি দেহে করোনার স্পাইক প্রোটিন সজ্জিত অ্যাডিনোভাইরাস প্রবেশ করানো হয়, তা হলে ভাইরাসের দেহটাকে গিলে নেবে এরা, কিন্তু উগরে দেবে বাইরের স্পাইক প্রোটিনকে। ম্যাক্রোফাজের সেই উগরে দেওয়া প্রোটিন চিনতে পারবে বি লিম্ফোসাইট কোষ। ডেনড্রাইটিক কোষগুলি বিপদের সঙ্গে পরিচয় করাবে টি লিম্ফোসাইটকে। টি লিম্ফোসাইটের সঙ্গে এই পরিচয় ভ্যাকসিনের সফল হওয়ার পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

এর পর টি লিম্ফোসাইট শুধু সংখ্যায় বাড়বে না, নানা ধরনের টি লিম্ফোসাইট তৈরি হবে। এই নতুন টি লিম্ফোসাইটগুলো কেবল সেই বি লিম্ফোসাইটকেই প্রভাবিত করবে যারা ইতিমধ্যেই ম্যাক্রোফাজের হাত ধরে বিপদকে চিনে ফেলেছে। বি লিম্ফোসাইটের মধ্যে তখন আসবে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। অনেকেই পরিণত হবে এক নতুন ধরনের কোষে, যার নাম প্লাজমা কোষ। এরাই জোগান দেবে ‘অস্ত্র’। তৈরি হবে অ্যান্টিবডি, যা ছড়িয়ে পড়বে রক্তে। নিষ্ক্রিয় হবে প্রাথমিক আক্রমণ। এই গোটা ধাপটার নাম— প্রাইমিং।

কিন্তু এর পরও বিপদ রুখে দেওয়াটা নিশ্চিত নয়। বিপদকে মনে রাখা জরুরি, আর তা সামলাতে জরুরি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি। এই যে মনে রাখার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, এটাই হল সাস্টেনেবল মেমারি ডেভেলপমেন্ট, যার প্রাথমিক ধাপ— বুস্টিং। এই ধাপে কিছু বিশেষ ধরনের বি লিম্ফোসাইট, যারা আগেই বিপদ চিনে নিয়েছে, সেগুলি পৌঁছে যায় হাড়ের ভিতর অস্থিমজ্জায়। অস্থিমজ্জা হল লিম্ফোসাইট তৈরির কারখানা।

এ বারের কাজ হল স্মৃতিধর প্রহরী প্রস্তুত করা। বিশেষ ধরনের বি লিম্ফোসাইট কোষগুলি প্রচুর পরিমাণে তৈরি করে স্মৃতিধর কোষ, মেমারি-বি লিম্ফোসাইট ও মেমারি-টি লিম্ফোসাইট। এই ধাপের নাম বুস্টিং।

তৃতীয় ধাপ মেমারি ডেভেলপমেন্ট আসলে বুস্টিংয়েরই বর্ধিত পর্যায়। বুস্টিং শুরু হওয়ার পরে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণে মেমারি-প্লাজমা কোষ, যারা ভবিষ্যতে একই ধরনের অ্যান্টিজেনের আক্রমণে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি তৈরিতে প্রস্তুত থাকে। এ ছাড়াও মেমারি-টি ও বি লিম্ফোসাইটের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায় বহু গুণে। বিপদ আসলে রাসায়নিক স্মৃতিতে ভর করে এরা রীতিমতো চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

‘ল্যানসেট’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে অ্যাডিনোভাইরাসের খাঁচা ব্যবহার করে প্রাইমিং ও বুস্টিংয়ের সাফল্য আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় গবেষণাপত্রে ভ্যাকসিনের প্রকৃতি একটু আলাদা। জার্মানির জোহানেস গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি অ্যাডিনোভাইরাসের বদলে ব্যবহার করেছে লিপিড ন্যানোপার্টিকল। মানবকোষে প্রবেশ করার পর এই লিপিড ন্যানোপার্টিকল মিশে যাবে কোষের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকিউলামের লিপিড পর্দায়, দেহে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তৈরি হবে করোনার প্রোটিন। এই প্রোটিনই ধাপে ধাপে উত্তেজিত করবে প্রহরী কোষকে।

করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে প্রাইমিংয়ের পুরোটাই ও অনেকাংশে বুস্টিংয়ের ঘটনা যে ভাবে শরীরে ঘটেছে, তার নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাই এটিকে সফল ট্রায়াল বলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা কিন্তু সাবধানী, কারণ তৃতীয় ধাপ অর্থাৎ দীর্ঘকালীন সাস্টেনেবল মেমারি গড়ে উঠছে কি না তা পরীক্ষা করা এখনও বাকি। তাঁরা জানেন, পুরোপুরি সফল ভ্যাকসিনের আসল চাবিকাঠিটা রয়েছে সেখানে— বিপদ মনে রাখতে পারবে এমন কোষ তৈরি করার মধ্যে।

COVID-19 Coronavirus Vaccine
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy