Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
NASA

এ বার জলে চলবে মহাকাশযান, নাসার 'অগ্নিপরীক্ষা' এ মাসেই

জ্বালানি হিসাবে জল ভরে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে নাসা। এই জানুয়ারির শেষেই।

জলের শক্তিতে ছুটবে মহাকাশযান ‘পিটিডি-১’। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

জলের শক্তিতে ছুটবে মহাকাশযান ‘পিটিডি-১’। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২১ ১২:৩০
Share: Save:

তেল বা গ্যাস নয়, জলের শক্তিতে এখনও রাস্তায় গাড়ি চলতে দেখা যায়নি। কিন্তু এ বার জলের জোগানো শক্তিতেই ছুটতে চলেছে মহাকাশযান।

আগামী দিনে মহাকাশযানের ‘রথের রশি’ ধরা থাকতে পারে এক ও একমাত্র জ্বালানি জলের হাতেই। নতুন শতাব্দীর নতুন দশকে পা দিয়েই এই যুগান্তকারী পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করছে মানবসভ্যতা। মহাকাশে।

প্রায় ৬ দশকের পুরনো ভাবনাচিন্তাকে বাস্তবায়িত করা লক্ষ্যে জ্বালানি হিসাবে জল ভরে মহাকাশযান পাঠাচ্ছে নাসা। এই জানুয়ারির শেষেই।

পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি (জেপিএল) সূত্রে খবর, জ্বালানি হিসাবে জল মহাকাশযানে ভরে ‘পাথফাইন্ডার টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটর' (পিটিডি) মিশনে একের পর এক পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ শুরু করবে নাসা। জ্বালানি জলের জোগানো শক্তিতে ছোটা সেই প্রথম মহাকাশযানটির নাম- ‘পিটিডি-১’। আকারে যা একটি জুতোর বাক্সের মতো। মহাকাশ প্রযুক্তির পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘কিউবস্যাট’। প্রাথমিক ভাবে, যা পাঠানো হবে ভূপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি হলে ৪০০ কিলোমিটার উচ্চতার কক্ষপথে। যাকে মহাকাশবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘লো-আর্থ অরবিট’। পরে ধাপে ধাপে এগুলি পরীক্ষামূলক ভাবে পাঠানো হবে পৃথিবীর আরও দূরের কক্ষপথগুলিতে।

যা নাসার ‘ট্রান্সপোর্টার-১’ মিশনে স্পেস-এক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটের পিঠে চেপে মহাকাশে পাড়ি জমাবে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই। ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন থেকে।

ছোটার পথে মহাকাশযানে থাকা জলকে ভেঙে ফেলা হবে বিদ্যুৎশক্তি দিয়ে। তার ফলে মহাকাশেই তৈরি হবে দু’ধরনের জ্বালানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন।

জ্বালানি হিসাবে মহাকাশযানে তরল অক্সিজেন ভরে পাঠানোর প্রথাই এখন চালু রয়েছে। এ ছাড়াও বড় মহাকাশযানগুলি ছোটে সোলার প্যানেলের ভরসায়। মহাকাশে ছোটার সময় সোলার প্যানেলের দু’টি ডানার উপর এসে পড়ে সূর্যের আলো। সেই আলোকশক্তিই মহাকাশযানের ‘রথের রশি’তে টান দেয়। মহাকাশযানকে ছুটতে সাহায্য করে।

‘‘কিন্তু এখন অন্য ভাবে ভাবনাচিন্তার সময় এসেছে’’, বলছেন জেপিএল-এ নাসার সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও ‘ইউরোপা মিশন’-এর অন্যতম বিজ্ঞানী গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

কেন? গৌতম জানাচ্ছেন, বড় মহাকাশযান পাঠানোর বিপুল খরচের বোঝা অনেক সময়ই অভিযানকে বিলম্বিত করে। তা ছাড়া বড় মহাকাশযান মহাকাশে অনেক ছোট ছোট লক্ষ্যবস্তুর উপর নজরদারি চালাতে পারে না নিখুঁত ভাবে। তাই বড় মহাকাশযানের পরিবর্তে এখন বহু ছোট ছোট মহাকাশযান পাঠাতে শুরু করেছে নাসা এবং ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি' (ইএসএ বা এসা)-র মতো বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এই ছোট ছোট মহাকাশযানগুলিই কিউবস্যাট। বড় মহাকাশযানে সোলার প্যানেল বসানোর জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু জুতোর বাক্সের আকারের কিউবস্যাটগুলিতে সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব নয়। আবার কিউবস্যাটগুলিতে তরল অক্সিজেনকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করতে হলে অভিযানের খরচও অনেকটা বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসাবে মহাকাশযানে জল ভরে পাঠানো হলে যে কোনও অভিযানেরই বিপুল খরচের বোঝা অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে।

এই সেই ‘হাইড্রস হার্ডওয়্যার’। যা মহাকাশে জল ভেঙে তৈরি করবে জ্বালানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস। ছবি- নাসার সৌজন্যে।

এই সেই ‘হাইড্রস হার্ডওয়্যার’। যা মহাকাশে জল ভেঙে তৈরি করবে জ্বালানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস। ছবি- নাসার সৌজন্যে।

গৌতমের বক্তব্য, বড় বড় মহাকাশযান আর তাদের চালু জ্বালানিগুলি নিয়ে উদ্বেগের আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মহাকাশযানগুলি পুরোপুরি অকেজো, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আর সেই অবস্থাতেই পৃথিবী-সহ অন্যান্য গ্রহের বিভিন্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। মহাকাশযানগুলি এই অবস্থায় হয়ে পড়ে মহাকাশের আবর্জনা বা ‘স্পেস ডেব্রি’। মহাকাশে রোজ এমন আবর্জনার সংখ্যা ও পরিমাণ দ্রুত হারে বাড়ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক। এই আবর্জনাগুলি একে অন্যকে ধাক্কা মারতে পারে। অথবা সেগুলির সঙ্গে মহাকাশে পাড়ি জমানো কোনও উপগ্রহ বা মহাকাশযানের সংঘর্ষ হতে পারে। মহাকাশযানে মহাকাশচারী থাকলে তো আরও উদ্বেগের। ফলে, মহাকাশে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এই সব দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যই এখন মহাকাশে কিউবস্যাট পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিপদ রয়েছে মহাকাশযানে এখন ব্যবহৃত জ্বালানিগুলি নিয়েও। তরল অক্সিজেন বা হাইড্রোজেনের মতো জ্বালানি খুব বিষাক্ত। মহাকাশযানের কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাতে জ্বালানি থেকে গেলে তা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে মহাকাশে। যা অন্য মহাকাশযানগুলির পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। তরল অক্সিজেন ও তরল হাইড্রোজেন খুবই উদ্বায়ী। তা ছাড়াও অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনকে তরল অবস্থায় রাখার জন্য ক্রায়োজেনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়। সেই যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে হলে মহাকাশযানের ওজন বেড়ে যায়। ওজন বাড়লে মহাকাশযানের বিপদও বাড়ে। তাদের ছোটার গতি কমে। যন্ত্রপাতিগুলিকে মহাকাশে চালাতে গেলে প্রচুর শক্তি খরচ করতে হয়। সোলার প্যানেলের সাহায্য না পেলে যে শক্তি জোগানো মহাকাশে খুবই জটিল কাজ।

নাসার পিটিডি-১ কিউবস্যাট মিশনের প্রোজেক্ট ম্যানেজার ডেভিড মেয়ার বলেছেন, ‘‘কিউবস্যাটে আপাতত থাকবে খুব ছোট সোলার প্যানেল। সেই প্যানেলের মাধ্যমেই সৌরশক্তি দিয়ে কিউবস্যাটে থাকা জ্বালানি জল ভেঙে ফেলা হবে। তার ফলে বেরিয়ে আসবে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস। যাদের শক্তি তরল অবস্থায় থাকা জলের চেয়ে অনেক বেশি। এতে মহাকাশযানগুলি আরও বেশি পরিমাণে শক্তি পাবে মহাকাশে ছোটা ও বিভিন্ন কাজকর্ম চালানোর জন্য। জ্বালানি হিসাবে জলকে ব্যবহার করার আরও একটা সুবিধা, জল কোনও বিষাক্ত পদার্থ নয়। তরল জল বিস্ফোরকও নয়। বলাই বাহুল্য, তরল অক্সিজেনের তুলনায় তা অনেক সস্তাও।’’

চাঁদের যে দিকটায় সূর্যের আলো পড়ে সেখানকার মাটির নীচে দিনকয়েক আগেই তরল অবস্থায় থাকা জলের হদিশ মিলেছে। যদিও তা পরিমাণে খুবই সামান্য। আমাদের সহারা মরুভূমিতে বালির নীচে যতটা জল রয়েছে, তার ১০০ ভাগের ১ ভাগ মাত্র।

তবে জলকে জ্বালানি বানানো সম্ভব হলে আগামী দিনে চাঁদ থেকে ওই জলকে ব্যবহার করেই রকেট উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন গৌতম-সহ নাসার জেপিএল-এর অনেক বিজ্ঞানীই।

যদিও মহাকাশযানের জ্বালানি হিসাবে জলকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আপাতত কয়েকটি সমস্যা রয়েছে বলে ধারণা গৌতমের। তাঁর কথায়, ‘‘কতটা পরিমাণে জল মহাকাশযানে ভরে পাঠাতে হবে, সেই জল থেকে কী পরিমাণে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস তৈরি হতে পারে মহাকাশে, তার জন্য কতটা শক্তি খরচের প্রয়োজন সেই সব দিকও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন। না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’

ছবি- নাসার সৌজন্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE