Advertisement
E-Paper

সানি লিওন: দেখালেন তিনি দেখালেন

সানি লিওনের নাম আমি প্রথম শুনি ২০১০ সালে। একটি পর্ন ফিল্মে তিনি অভিনয় করেছিলেন যার নাম ছিল ‘পোর্ট্রেইট অফ আ পর্ন স্টার’। ফিল্মটি বেশ কয়েকটি এভিএন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। প্রসঙ্গত, এই পুরস্কারটি পর্নের দুনিয়াতে অস্কারের সমতুল্য। সেই পুরস্কারের লিস্টে চোখ রাখার সূত্রেই প্রথম সানির সিনেমার সঙ্গে পরিচয় এবং যথারীতি দেখে ছিটকে গিয়েছিলাম।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৩:৩৩

সানি লিওনের নাম আমি প্রথম শুনি ২০১০ সালে। একটি পর্ন ফিল্মে তিনি অভিনয় করেছিলেন যার নাম ছিল ‘পোর্ট্রেইট অফ আ পর্ন স্টার’। ফিল্মটি বেশ কয়েকটি এভিএন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। প্রসঙ্গত, এই পুরস্কারটি পর্নের দুনিয়াতে অস্কারের সমতুল্য। সেই পুরস্কারের লিস্টে চোখ রাখার সূত্রেই প্রথম সানির সিনেমার সঙ্গে পরিচয় এবং যথারীতি দেখে ছিটকে গিয়েছিলাম। তাঁর বিভঙ্গ, শরীরী লীলা, তাঁর উন্মুক্ত আকাঙ্ক্ষার প্রদর্শনী আরও অনেকের মতোই আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তবে তখন তিনি আমার কাছে শুধুই এক পর্ন-অভিনেত্রী ছিলেন।

কিছু দিন বাদে শুনলাম সানি লিওন পর্ন-কেরিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করে বলিউডে পাকাপাকি ঘাঁটি গাড়তে চলেছেন। তার পর তো ইতিহাস। বলিউডে একটার পর একটা হিট সিনেমা, বিতর্কিত অ্যাড, দেশের রাজনীতিবিদদের সানি সম্বন্ধে কটূক্তি, আবারও হিট, নামীদামি এনডোর্সমেন্ট ইত্যাদি পেরিয়ে এসে সানি আবার খবরের শিরোনামে। যখন তিনি মুখোমুখি অন-স্ক্রিন সাক্ষাতকারে তাঁর অতীত জীবন নিয়ে অ্যাঙ্করের বাঁকা বাঁকা প্রশ্নের জবাবে মাথা ঠান্ডা করে গ্রেসফুলি উত্তর দিয়ে আমাদের লিবারাল আমজনতার মন জয় করে নিলেন। আমি মনে মনে টুপি খুলেছিলাম। পর্ন সিনেমা থেকে বেরিয়ে এসে কঠিন লড়াই করে এক জন নারী মূলস্রোতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন, দৃপ্ত সাহসিকতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন এবং ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁকে ঘিরে যাবতীয় ইনহিবিশন তথা পুরুষতান্ত্রিক বিদ্বেষ— এগুলো দেখে মনে হয়েছিল আমি নিজের আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তা দিয়ে মনে মনে যে স্বপ্নের নারীপ্রতিমা তৈরি করেছি সানি লিওন তার একেবারে খাপে খাপ। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই, তারাও জাগছে। আমার ঘুম নিশ্চিন্ত এবং নিশ্ছিদ্র রেখেছিল এই বিশ্বাস যে আধুনিক ভারতের মেয়েরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবে ঠিক যেমন সানি লিওন করেছেন। ঠিক সেই পথে যে পথে আমি চাই।

আর এই পর্যন্ত এসেই এই গল্পটা আর সানির অথবা আমার গল্প থাকল না। হয়ে গেল কোটি কোটি পুরুষের গল্প। আমরা সেই পুরুষেরা যারা নিজেদের লিবারাল ভাবি। আমরা যারা নারীমুক্তির হয়ে গলা ফাটাই এবং পর্ন দেখে আইডেন্টিফাই করি এ সব আসলে নারীকে ভোগ্যবস্তু করে তোলার হাতিয়ার। আমরা যারা নিজেরাই আমাদের মেয়েদের জন্য একটা গণ্ডি বেঁধে দিয়েছি, যার মধ্যে থাকলে সে আমাদের মনের মতো হবে। আমি এবং আমরা, যারা ভেবে এসেছি যে নারীমুক্তি ঘটানোটা আসলে আমাদের পুরুষদেরই দায়িত্ব।

যখন সানি লিওন বলিউডে এলেন আমি আনন্দ পেয়েছিলাম। কারণ, আমার শিক্ষিত বিদগ্ধ মনে কাঁটার মতন বিঁধে থাকত এই বাস্তবটা যে সানি আসলে পর্নস্টার। বার বার এটাই মনে করে এসেছি যে ও পথ আসলে ঠিক নয়। ঠিক নয় কারণ আমি ওটাকে ঠিক মনে করি না। তাই তথাকথিত মূলস্রোতে ফেরার জন্য সানির লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছি। যখন ইন্টারভিউয়ারের বাঁকা প্রশ্নে সানি বিব্রত, আমি নিজের মনে চেঁচিয়ে উঠেছি, “আরে সানি ওকে দেখিয়ে দে তুই কতখানি কষ্ট করে আজ মেনস্ট্রিমে এসেছিস। দেখিয়ে দে যে পর্নস্টার হলেও তোর শিক্ষা মেধা আর বুদ্ধি আমাদের থেকে কিছু কম নয়।” ক্ষিদ্দার মতন চেঁচিয়ে গেছি, “ফাইট সানি ফাইট!”

এই যে আমাদের তৈরি করে দেওয়া সমীকরণ— এক মহিলা অপমানিত হবেন, অপমানের যথাযোগ্য জবাব দেবেন এবং লড়াই করে মূলস্রোতে নিজের সম্মান অর্জন করে নেবেন— সানি লিওন আমাদের সেই বেঁধে দেওয়া গন্ডিতেই খেলে যান। আমরা তাঁকে হাততালি দিই তাঁর রুচি বা বৈদগ্ধের জন্য নয়! হাততালি দিই কারণ ‘পর্নস্টার হয়েও’ তিনি এত ডিগনিফায়েড এবং বুদ্ধিদীপ্ত লড়াই করছেন বলে (নরেন্দ্র মোদী যেমন শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘এক মহিলা হয়েও আপনি যে ভাবে সব কিছু সামলান তা সত্যি স্যালুট করার মতো’)। সানি আমার এত প্রিয় এবং শ্রদ্ধেও কারণ তিনি আমার লিবারাল পুরুষমনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে গেছেন খাপে খাপ। নিজের অতীতকে ডিঙিয়ে এতটা এগিয়ে গেছেন। নারীত্বকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। নিজের ডিগনিটি বজায় রেখেছেন আগাগোড়া। সানির জয় তাই একা সানির জয় নয়। এক প্রাক্তন পর্নস্টারের-ও জয় নয়। সানির জয় আসলে আমার লিবারাল পৌরুষের অতৃপ্ত ইন্টেলেকচুয়াল অর্গাজমের জয়।

সানিকে দেখে আমার স্লামডগ মিলিওনেয়ারের বাচ্চা ছেলেটির কথা মনে পড়ে। ক্যুইজের আসনে তার উল্টো দিকে প্রতিকূল পরিবেশ এবং বিরূপ মনোভাবাসম্পন্ন ক্যুইজ মাস্টার। কিন্তু সে মাথা ঠান্ডা রেখে একটার পর একটা প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে যায়। তার জয় আসলে এক নতুন ইন্ডিয়া ইন মেকিং-এর জয় ছিল যা এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল যে ‘জীবনে লড়াই করে সব কিছু ছিনিয়ে নিতে হয়’। সানি লিওন সেই নয়া ইন্ডিয়ার আধুনিকতাকেই ভিন্ডিকেট করে দিলেন। আমাদের শহুরে মধ্যবিত্ত লিবারাল পুরুষদের চোখ নারীর প্রতিষ্ঠার যে যে সমীকরণগুলো সযত্নে নির্মাণ করেছি— লড়াই, ডিগনিটি, পঙ্কিল অতীত এবং বিরূপ বর্তমান জয় করে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়ানো, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য্য, মর্যাদাপূর্ণ আচরণ, আধুনিকা দৃষ্টিভঙ্গি— সানি লিওন সেগুলোর একদম বাস্তব রূপ। তাই সানিকে আমি এত পছন্দ করি। কারণ জানি সানি লিওনের যে আর্কেটাইপ তা যতই নারীমুক্তি এবং আধুনিকতার কথা বলুক না কেন সেটাও হবে আমার বেঁধে দেওয়া নিয়মাবলী অনুসারেই। আমার আধিপত্যের নন্দন ওটুকুই পারমিট করে। সেই গণ্ডির বাইরে একচুলও যদি পা রাখে কেউ, সানি লিওন যদি আবার পর্ন ফিল্মে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অথবা কাল থেকে এমন আচরণ করেন যা আমাদের বেঁধে দেওয়া ডিগনিটির সঙ্গে যায় না, তা হলেই আমার এই সফট আধিপত্য চূড়ান্ত ঝাঁকুনি খাবে। ওলটপালট হয়ে যাবে সব সমীকরণ। কিন্তু আমি জানি যে তা ঘটবে না। সানি অত বোকা নন যে বহু কষ্টে অর্জিত নিজের ইমেজ ছুড়ে ফেলে দেবেন। তিনিও জানেন যে দিনের পর দিন প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে কুস্তি করেই তাঁকে ইঞ্চি ইঞ্চি ইমেজ নির্মাণ করে যেতে হবে যাতে আমরা ভারতীয় সমাজ রিং-এর ভেতর তাঁর এই রক্তাক্ত লড়াইকে হাততালি দিয়ে গ্লোরিফাই করতে পারি।

আরও পড়ুন: ‘জিজ্ঞেস করতে পারতে সানি, আপনাকেও কি আনন্দ দিতাম…’

তাই দিনের শেষে সানি লিওন আসলে একটা আইডিয়ার বাইরে আর কিছু থাকেন না। যখন তিনি পর্ন ফিল্মে অভিনয় করে গেছেন তখন সমবেত পুরুষদের কামনার অবজেক্ট হয়ে থেকেছেন। যখন তিনি বলিউডে আসলেন তখন থেকে গেলেন লিবারাল ভারতীয় পেট্রিয়ার্কির ইচ্ছেপূরণের অবজেক্ট হয়ে। তিনি ততটুকুই দেখালেন যতটুকু দেখলে আমাদের আধিপত্যের নন্দনে অন্তর্ঘাত ঘটবে না। তাই আজকাল আমার ঘুম আরও নিশ্ছিদ্র এবং গভীর হচ্ছে। কারণ, আমি জানি যে মেয়েরা জাগছে কিন্তু তাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না।

women sunny leone pornstar pornography
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy