Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ট্রেনিংয়ের নয়া কৌশলেই সফল ভুবিরা

আগে ছিল আর্মার, গুগলি আর টপ স্পিনের কারখানা। সেখান থেকেই এখন বেরোচ্ছে রিভার্স সুইং, ইয়র্কার আর শর্ট বলের কারিকুরি। স্পিড গানে গড় গতির হিসেবনিকেশে অন্য দেশকে টক্কর দিচ্ছেন বিরাট কোহালির ফাস্ট বোলাররা।

মরিয়া: জিমে এ ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছেন হার্দিক। টুইটার

মরিয়া: জিমে এ ভাবেই নিজেকে তৈরি করেছেন হার্দিক। টুইটার

চিন্ময় রায়
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৮ ০৬:৪২
Share: Save:

আগে ছিল আর্মার, গুগলি আর টপ স্পিনের কারখানা। সেখান থেকেই এখন বেরোচ্ছে রিভার্স সুইং, ইয়র্কার আর শর্ট বলের কারিকুরি। স্পিড গানে গড় গতির হিসেবনিকেশে অন্য দেশকে টক্কর দিচ্ছেন বিরাট কোহালির ফাস্ট বোলাররা। গতির এই বিপ্লবের নেপথ্যে নায়কযুগল হলেন বিরাট আর ট্রেনার শঙ্কর বাসু। ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাওয়া যাক বেশ কয়েক বছর আগের আইপিএলে। হতাশ গলায় সে দিন বিরাট কোচ ভরত অরুণকে বলেন, ‘পাজি, মেরা শট বাউন্ডারি কি উস পার পৌঁছতাই নেহি’। পাশে বসা বাসু বলেন, ‘বিরাট, শটে পাওয়ার বাড়ানোর একমাত্র অস্ত্র হল অলিম্পিক লিফটিং। পেশিতে শক্তি এলেই বল বাইরে গিয়ে পড়বে।’’ ওই আইপিএলে শুরু হওয়া সেই ফিটনেস মন্ত্রের শিকড় এখন অনেক গভীরে পৌঁছে গিয়েছে।

হাওয়া বদলের শুরু: ২০১৪ সালের শেষ দিকে বিরাট ভারতীয় টেস্ট অধিনায়কত্ব পান। কিন্তু অন্য ফর্ম্যাটে ধোনিই অধিনায়ক থেকে যান। এটা সবাই জানেন, টিমের ফিটনেস নিয়ে কড়াকড়িতে কতটা যাওয়া যেতে পারে তার রাশ থাকে অধিনায়কের হাতে। ভারতীয় দলের ফিটনেস বিপ্লব শুরু হয় ২০১৫ সালে বাসু ফিটনেস ট্রেনার হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে। বিরাট অবলীলায় অলিম্পিক লিফটিং করছেন দেখে জোরে বোলারদের বাহিনী বাসুর কাছে জানতে চায়, এই লিফটের মাহাত্ম্যটা কোথায়?

অলিম্পিক লিফট মানে গতির লিফট: ফাস্ট বোলাররা দূর থেকে ছুটে আসে ভরবেগ তৈরির জন্য। তার পরে এক ঝটকায় বলটা ব্যাটসম্যানের দিকে নিক্ষেপ করে। প্রক্রিয়াটা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে এক্সপ্লোসিভ স্ট্রেংথ। ২০ কেজির লোহার রড অর্থাৎ বারবেল গতির সঙ্গে হাঁটুর কাছ থেকে কাঁধ বা মাথার উপরে এক ঝটকায় তুললে পা আর কাঁধের পেশিতে এই ‘এক্সপ্লোসিভ স্ট্রেংথ’ তৈরি হয়। অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক থেকে মিচেল জনসন, এমনকি মিডিয়াম পেসার জেমস অ্যান্ডারসনেরও প্রিয় হল এই অলিম্পিক লিফ্ট। এই ব্যায়ামই ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার গতির ভুবনেশ্বর কুমারকে এখন ১৪০-এ পৌঁছে দিয়েছে।

ফিটনেস জেন-এক্স: ২০১৬ সালের শেষে ধোনি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন। তখন থেকেই বিরাট আর বাসু ফিটনেস মন্ত্র ঢুকিয়ে দেন ক্রিকেটারদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ২০১৭ সাল থেকে ইয়ো ইয়ো টেস্ট আলোচনায় উঠে এসেছে। পরীক্ষায় ফেল করে আটকে গিয়েছেন যুবরাজ সিংহ, সুরেশ রায়না, মহম্মদ শামি আর অম্বাতি রায়ডু। একই সঙ্গে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে একদল তরুণের দুরন্ত ফিটনেস।

অলিম্পিক লিফট কোথায় আলাদা: ভারতীয় ফাস্ট বোলারদের বাসু গোড়াতেই বুঝিয়ে দেন, ‘বার ক্যাচিং’, ‘পিক আপ আর লিফটিং’— সবেতে টেকনিক আর ফর্ম ভালমতো রপ্ত করতে হবে। না হলেই চোট লাগার ঝুঁকি। শুধু ২০ কেজির বারবেল দিয়ে শুরু করে ভুবনেশ্বর, যশপ্রীত বুমরা, হার্দিক পাণ্ড্যরা এখন ৩০ কেজি ওজনের প্লেট লাগিয়ে স্বচ্ছন্দে তুলছেন। ‘হ্যাং ক্লিন’, ‘ক্লিন অ্যান্ড জার্ক’, ‘স্ন্যাচ’, ‘ডেড লিফ্ট’, ‘গুড মর্নিং’ ইত্যাদি সব নামের এক্সারসাইজ। ওজন বেশি আর কম রিপিটিশন। এটাই হল ব্যায়ামের শর্ত। ভুবি-বুমরাদের পরিবর্তন দেখে ইশান্ত শর্মা, শামি, উমেশ যাদব সবাই এখন অলিম্পিক লিফটিং-এর ভক্ত। প্রি-সিজনে সপ্তাহে তিন দিন ছ’টা করে ব্যায়াম।

ভালবাসার লিফটিং: বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেটাররা এই ট্রেনিংয়ে এতটাই মজেছেন যে, ফিটনেস কোচ বাসুর লাগেজে একটা ২০ কেজির বারবেল আর ১৫+১৫=৩০ কেজি ওজনের প্লেট টিমের সঙ্গে শহরে শহরে ঘুরছে। যাতে কোনও হোটেলে যন্ত্রের অভাবে অনুশীলন যেন বন্ধ না হয়।

বন্ধ ‘ভাগ ভাই ভাগ’: ওজন নিয়ে পাওয়ার ট্রেনিং-এর পাশাপাশি জোরে বোলারদের লম্বা পাক মারা দৌড়ে দাঁড়ি টানা হয়েছে। বাসু নিজে স্প্রিন্টার ছিলেন। তাই জানেন, ঘন ঘন লম্বা দৌড়ে (১৫ দিনে এক দিন চলতে পারে) পেশির ক্ষয় হয়। ২০ ওভার বল করার স্ট্যামিনা লম্বা দৌড়ে আসে না। বরং ৪০ মিটার দূরত্ব ৭ সেকেন্ডে স্প্রিন্ট করে পৌঁছানোর পরে ২৩ সেকেন্ডে শুরুর প্রান্তে ফিরে এসে আবার স্প্রিন্ট। এ ভাবে ঠিক ছ’টা বল করার মতো ছ’বার দৌড়, তার পর দু’ মিনিট বিশ্রাম। এটাই এখনকার ফাস্ট বোলারদের দৌড়ের একটা নমুনা।

ট্রেনিং-ম্যাচ প্লে-রিকভারি: আইসিসি-র ভবিষ্যৎ ক্রিকেট ক্রীড়াসূচি দেখে ফিজিয়ো প্যাট্রিক ফারহার্ট আর বাসু দারুণ একটা ছক বানাচ্ছেন। ফাস্ট বোলারদের পরিশ্রম কমাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় নেট বোলারদের উড়িয়ে আনা হয়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভুবনেশ্বর-বুমরাকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। খেয়াল করুন, ইশান্ত শর্মা ও মহম্মদ শামি এখন মূলত টেস্ট বোলার। একজন ফাস্ট বোলার এক সপ্তাহে ক’টা বল করছেন, সব তথ্য ধরা থাকছে ট্রেনার-ফিজিয়োর ল্যাপটপে। বাসু নিজে ফিজিয়োথেরাপিটা জানেন। এতে চোট-আঘাত থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে উপকৃত হচ্ছে ভারতীয় দল।

ডায়েট: খাবারের ক্ষেত্রে ভারতীয় ফাস্ট বোলাররা অনেক সংযমী। উত্তরের ইশান্ত শর্মা এখন আর আলু-পরোটা দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়েন না। বরং গ্রিল্ড চিকেন, নাটস, পিনাট বাটার, স্ম্যাশড পট্যাটো প্লেটে তুলছেন। এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক বিরাট কোহালি নিজে। নিয়মিত প্রোটিন সাপ্লিমেণ্ট নিতে এখন আর বোলাররা ভুরু কোঁচকান না। ট্রেনারের নির্দেশমতো প্রোটিন বার নিতেও কোনও আপত্তি নেই। ফাস্ট বোলাররা সকলেই জানেন, পাওয়ার আর স্ট্রেংথের জন্য প্রোটিন নেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India Englan Test Pace Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE