Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Sport News

রোনাল্ডো, আপনাকে না ভালবেসে উপায় কী!

কে জানত, কয়েক ঘণ্টার তফাতে মাথা হেঁট হবে আপনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর! কে জানত, আপনি পেনাল্টি থেকে গোল করবেন আর লিয়োনেল মেসি পারবেন না!!

শুক্রবার রাতে পর্তুগালের নায়ক রোনাল্ডো। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুক্রবার রাতে পর্তুগালের নায়ক রোনাল্ডো। ছবি: গেটি ইমেজেস

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৮ ০৫:৩৩
Share: Save:

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, আপনি এক ধন্দের নাম! যাঁকে অনেকেই ভালবাসতে চান না, তবু যাঁর মুখ বারবার ভেসে ওঠে বিজয়ী হিসেবে।

যেমন শুক্রবার রাতেও ভেসে উঠল সোচির মাঠে। ম্যাচ শেষে আপনার হ্যাটট্রিক দেখে স্পেনের সমর্থকেরাও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন! দেখে মনে হচ্ছিল, মাদ্রিদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদকে জিতিয়ে ফিরছেন। মনে হচ্ছিল, ৩-৩ স্কোরলাইনের দু’জন বিজয়ী। এক জন আপনি, অন্যটা ফুটবল।

তখন কে জানত, কয়েক ঘণ্টার তফাতে মাথা হেঁট হবে আপনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর! কে জানত, আপনি পেনাল্টি থেকে গোল করবেন আর লিয়োনেল মেসি পারবেন না!! কে ভেবেছিল আপনি হ্যাটট্রিক করে উচ্ছ্বাসে উড়বেন আর আর্জেন্টিনা ম্যাচে ছবি উঠবে নতজানু মেসির!!!

আর এক জন নামছেন আজ, রবিবার। আধুনিক ফুটবলের মোৎজ়ার্ট, বিথোভেন, বাখ আপনারা। মেসি, রোনাল্ডো, নেমার। ফুটবলে সঙ্গীতের সুর তোলায় কে সেরা, হয়তো রাশিয়াই ঠিক করে দেবে। কিন্তু সি আর সেভেন, শনিবার রাত পর্যন্ত আপনিই এগিয়ে। দুরন্ত হ্যাটট্রিকে চাপে ফেলে দিয়েছেন বাকি দুই চ্যালেঞ্জারকে।

রাশিয়া বিশ্বকাপের চিত্রনাট্য যাঁর হাত দিয়েই লেখা হয়ে থাকুক, তিনি সম্ভবত চান না মেসির সামনে আপনি চিরন্তন দ্বিতীয় হয়ে থাকুন। তবু ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, ভীষণই অতিরঞ্জিত এক চরিত্র আপনি। সারাক্ষণ হাত-পা ছুড়ে নাটক করে চলেছেন। রেফারিকে ধোঁকা দিয়ে ডাইভ মারছেন পেনাল্টি আদায় করার জন্য। শুক্রবার রাতের ম্যাচেও পেনাল্টিটা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। পিকে অভিযোগ করেছেন, ইচ্ছে করে মাটিতে পড়ে গিয়ে পেনাল্টি আদায় করেছেন আপনি। আগেও অনেকে বলেছেন, রোনাল্ডো বিশ্বের সব চেয়ে বড় অভিনেতা। তাঁর জায়গা হলিউড!

এ বারের বিশ্বকাপ শুরুর আগে ফুটবল দুনিয়ার গরিষ্ঠ অংশের ধারণা ছিল পরিষ্কার— তেত্রিশ বছরের রোনাল্ডো এখনও বিনোদন ম্যাগাজিনের কভার হওয়ার উপযুক্ত। বিশ্বকাপে জাদু দেখানোর সম্ভাবনা নেই। রিয়াল মাদ্রিদে আলো-আঁধারি মরসুমের পরে শেষ বিশ্বকাপ থেকে কী ভাবে স্বপ্নভঙ্গ ঘটে বিদায় নেবেন, সেই শোকগাথা তৈরি রাখছিলেন সমালোচকেরা। স্পেনের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকের পরে সেগুলোকেই দ্রুত পাল্টে ফেলতে হচ্ছে।

দু’ধরনের খেলোয়াড়ের মিশ্রণে ঈশ্বর তৈরি করেছেন আপনাকে। পা দু’টো স্প্রিন্টারের মতো। ঊর্দ্ধাঙ্গ বক্সারের। প্রতিপক্ষ গোলের সামনে ময়ূরের মতো পেখম মেলে সেই শরীর। যদি কোনও ফুটবলারের ভাস্কর্য করতেন কোনও শিল্পী, নিশ্চয়ই তাঁর সৃষ্টির নাম হত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। দেখে কে বলবে, পর্তুগালের মেদেইরা দ্বীপের রাস্তায় খেলতে খেলতে এগারো বছরের যে কিশোর পাড়ি দিয়েছিল স্পোর্টিং লিসবনের ফুটবল অ্যাকাডেমিতে, তার সব চেয়ে বড় বাধা ছিল শারীরিক গঠন। রোজ রাতে পাবলিক বুথ থেকে মায়ের কাছে ফোন করে সেই কিশোর কান্নাকাটি করত বাড়ি ফেরার জন্য। লিসবনে থেকেও তার মনে হত দূরান্তের কোনও নির্জন দ্বীপে বিসর্জিত! অ্যাকাডেমিতে সতীর্থরা মন্তব্য করল, ‘‘ছেলেটা ভাল খেলে। কিন্তু এই রোগাপাতলা চেহারা নিয়ে কত দূর আর যাবে!’’

সেই কটাক্ষ শুনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আপনি রাতের অন্ধকারে ছুটে যেতেন জিমন্যাসিয়ামে। শপথ নেন, লৌহপুরুষের শরীর বানিয়ে ফিরে আসবেন। ছ’মাসের মধ্যে হাজির নতুন রোনাল্ডো। অ্যাকাডেমির সতীর্থ, কোচেরাও দেখে অবাক। আর আপনি সদর্পে ঘোষণা করে দিলেন, এক দিন ফুটবল পৃথিবীকে আমিই শাসন করব। নিজেকে বললেন, ‘যত দিন ফুটবল খেলব, এই দায়বদ্ধতা দেখাব। অধ্যবসায় দেখাব। সাধনা চলবে।’

তিরিশ পেরিয়ে যেখানে অনেক ফুটবলারের নেটওয়ার্কেই ঢুকতে শুরু করে দেয় অবসরের সিগন্যাল, সেখানে এই ফিটনেসের নেপথ্যে নিশ্চয়ই নিঝ্ঝুম রাতের সেই লিসবন জিমন্যাসিয়াম। একটি বইতে খোঁজ পেলাম আপনার ফুটবল দর্শনের— ‘মাঠে হারলে, জানবে আজ তোমার উপোস। যে দিন জিতবে, জানবে সে দিনও উপোস। শুধু সামান্য জলপানের অনুমতি পেয়েছ।’ সাফল্যকে মাথায় চড়তে না দেওয়ার কী অসামান্য পন্থা! এই সংযমই ঠিকরে বেরোয় ফ্রি-কিক নিয়ে অধ্যবসায়ে। দিনের পর দিন পড়ে থেকে শিখেছেন বিশেষ ওই শট— নাক্‌ল বল ফ্রি-কিক।

তবু ক্রিশ্চিয়ানো, আপনাকে ভালবাসব কী করে?

বিরাট শোম্যান যে আপনি। স্পেনের সঙ্গে শুক্রবার রাতের ম্যাচে ফ্রি-কিক নেওয়ার আগেও কী না কী করছিলেন! অনেকেই বিড়বিড় করছিল, যত্ত সব নাটক। বাইরে মারবে! কুস্তিগিরের ভঙ্গিতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন শর্টস গুটিয়ে। তার পরেই সেই চোখ! শিকারির মতো তাকিয়ে আছেন স্পেন গোলের দিকে। কে বলবে, ফুটবলার ফ্রি-কিক নিতে যাচ্ছেন! মনে হচ্ছিল যেন অর্জুন তির-ধনুক নিয়ে পাখির চোখ দেখছেন। লক্ষ্যভেদ না হয়ে যায়!

কয়েক বছর আগে একটি সংস্থা আপনাকে নিয়ে তথ্যচিত্র করেছিল। কয়েকটি জায়গা মনে গেঁথে রয়েছে। যেমন আপনার শটের গতি ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। চোখ বেঁধে দিলেও শূন্যে লাফিয়ে বল হেড করে দিতে পারেন। গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য ধরা পড়ে যে, বল দখলের সময়ে রোনাল্ডো নাকি বলের দিকেই তাকান না। পাখির চোখ ডিফেন্ডারের পা!

কী অনমনীয় আত্মবিশ্বাস! বল দখলে আসার আগেই মানসিক ভাবে নিয়ে নিয়েছি বলের অধিকার। ফ্রি-কিকের আগে শর্টস গোটানো নিয়ে লোকে হাসাহাসি করছে, গোল করতে না পারলেই ধিক্কার ধেয়ে আসবে জেনেও বিশ্বকাপের বৃহত্তম মঞ্চে নিজস্ব ভঙ্গি বিসর্জন দিতে নারাজ। উদ্ধত, আবার অসীম দুঃসাহসীও!

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, আপনাকে না ভালবেসে উপায় কী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE