Advertisement
০৮ মে ২০২৪

টাইটানিক রক্ষার লড়াই মর্তের মেসির

প্রথমে আইসল্যান্ড, তার পরে ক্রোয়েশিয়াও যেন আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেল, মেসি যে-সুরা পান করেন, তা আঙুর থেকেই তৈরি।

প্রত্যয়ী: সতীর্থের সঙ্গে প্রস্তুতি নেওয়ার পথে মেসি। ছবি:এএফপি

প্রত্যয়ী: সতীর্থের সঙ্গে প্রস্তুতি নেওয়ার পথে মেসি। ছবি:এএফপি

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ০৪:৫৮
Share: Save:

টাইটানিক ধাক্কা খেয়েছে!

ঐতিহাসিক জাহাজ ‘আইসবার্গে’ (হিমশৈলে) ধাক্কা খাওয়ার পরে তার ক্যাপ্টেন হাতে পেয়েছিলেন তিন ঘণ্টার মতো সময়। জাহাজডুবি আটকাতে পারেননি।

ঐতিহাসিক ফুটবলার আইসল্যান্ডে ধাক্কা খাওয়ার পরে তরী রক্ষা করার জন্য সময় পেলেন দশ দিন। সারা দুনিয়া গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখার অপেক্ষায়, ফুটবল ক্যাপ্টেন তীব্র ঝড়ঝঞ্ঝার সঙ্গে লড়াই করে জাহাজডুবি ঠেকাতে পারেন কি না।

ক্রোয়েশিয়ার কাছে ০-৩ হারের রাতে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, সার্কাসের ট্র্যাপিজ মাস্টারকে কেউ উপরে তুলে দিয়ে সরিয়ে নিয়েছে জালটাই! আতঙ্কিত চোখমুখ নিয়ে মাস্টার যেন ভেবে চলেছেন, শূন্যে উড়ে বেড়ানোর খেলা দেখাব কী করে! সামান্য ভুল হলেই যে শেষ! সার্কাস কোথায়, এ তো জীবন নিয়ে ট্র্যাপিজের খেলা!

সমুদ্রের মতো নির্দয় নয় ফুটবল। দু’বার ধাক্কা খাওয়ার পরেও অতলান্তিকের মতো অতলে টেনে নিয়ে যায়নি লিয়ো মেসির তরীকে। আজ, মঙ্গলবার সেন্ট পিটার্সবার্গে শেষ সুযোগ নাইজিরিয়ার বিরুদ্ধে। যাঁরা শুধু দুর্দান্ত জার্সির রং আর ফ্যাশনের জন্যই ঝড় তোলেননি, আগ্রাসী ফুটবলেও মন জিতছেন। আইসল্যান্ডকে হারিয়ে জন ওবাই মিকেলরাই কুইনাইন এগিয়ে দিয়েছেন মেসিদের দিকে। আজ তাঁরাই প্রতিপক্ষ। ফুটবল, নির্মম ফুটবল!

আর্জেন্টিনার জন্য সব চেয়ে বড় আশার কথা— লিয়োনেল মেসি নামক গোলমেশিন আছে তাদের দলে। আর আর্জেন্টিনার কাছে অশনি সঙ্কেত, গোলমেশিনেরই গোল নেই। দু’টি ম্যাচ হয়ে গিয়েছে, তাঁর স্কোরকার্ড শূন্য। আত্মজীবনীতে ওয়েন রুনির অমর উক্তি মনে পড়ে যাবে— ফুটবল যদি জলের নীচে হাঁসফাঁস করা হয়, তা হলে গোল হচ্ছে ভেসে উঠে শ্বাস নেওয়া!

কিংবদন্তি ববি চার্লটনকে টপকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন রুনি। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে বিস্ময়-গোলের মালিক চার্লটন ম্যান ইউনাইটেডের হয়ে করেছিলেন ২৪৯ গোল। মেসির আছে ২৫৩। যত দিন ফুটবল থাকবে, তত দিন থেকে যাবে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির বিরুদ্ধে তাঁর সেই বাইসাইকেল কিকের বিস্ময়-গোল! সেই রুনিরই মনে হয়, ফুটবল মানে জলের নীচে হাঁসফাঁস করা! মনে হয়, গোল হচ্ছে ভেসে উঠে জীবনদায়ী শ্বাস নেওয়া!

ফুটবল, নির্মম ফুটবল!

আর্জেন্টিনার প্রথম দু’টি ম্যাচ ফুটবল ভক্তদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই বাস্তবের সামনে যে, মেসি ফুটবল ‘ঈশ্বর’ নন। তিনি মর্তের এক মানব। অন্য যে-কোনও ফুটবলারের মতো তাঁর পেনাল্টিও আটকে দিতে পারেন কোনও গোলকিপার! ‘ওথেলো’-র সেই দৃশ্যটার মতো। যেখানে ইয়াগো বলছেন, ‘‘ডেসডিমোনা যে-সুরা পান করে, তা আঙুর থেকেই তৈরি। ও মোটেই মাতা মেরির অবতার নয়।’’

প্রথমে আইসল্যান্ড, তার পরে ক্রোয়েশিয়াও যেন আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেল, মেসি যে-সুরা পান করেন, তা আঙুর থেকেই তৈরি। মেসি কোনও ঈশ্বর নন। কোনও জাদুকর নন। বিস্ময়কর সব গোলের পিছনে রয়েছে মানুষের পা, ঈশ্বরের হাত নয়— এই সত্য উপলব্ধিতে মেসির মহত্ত্ব কমে না, বরং বাড়ে।

ক্লাবের জার্সিতে অনেক বার বার্সেলোনাকে এমন এসপার-ওসপার পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেছেন মেসি। ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। প্যারিস সাঁ জারমাঁর বিরুদ্ধে মরণবাঁচন ম্যাচে চোট পাওয়া মেসি বসে ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। পিএসজি গোল করা মাত্র নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ম আপ করা শুরু করে দেন। ম্যানেজারের নির্দেশের অপেক্ষা করেননি। চোটের তোয়াক্কা করেননি। তিনি মাঠে নামার পরে ম্যাচ থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ইব্রাহিমোভিচের পিএসজি। গত বছর পিএসজি-র বিরুদ্ধেই আবার ঘরের মাঠে ৬-১ জিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেন। কিন্তু সে-সবই ক্লাবের জার্সি গায়ে। যখনই অতলান্তিক পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছেন নিজের দেশের দিকে, বার্সেলোনার চাকচিক্য দেখা যায়নি।

মাঠে তাঁর প্রতিপক্ষের নাম যতই হোক নাইজিরিয়া, আসলে অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁরই দেশের কিংবদন্তি— দিয়েগো মারাদোনা। এক জন বিশ্বকাপ জিতেছেন, অন্য জন পারেননি— এটা মামুলি তুলনা। আর্জেন্টিনায় এর চেয়েও জোরালো স্লোগান— মারাদোনা আর্জেন্টিনার, মেসি স্পেনের। ক্রোয়েশিয়া ম্যাচেও এক হতাশ ভক্তকে একটি পুতুল তুলে ধরতে দেখা গিয়েছে। মেসির পুতুল। গায়ে বার্সেলোনার রং।

নীল-সাদা জার্সিতে দাঁড়িয়ে তিনি জাতীয় সঙ্গীত গান না। কখনও আর্জেন্টিনার প্রথম ডিভিশনে ফুটবল খেলেননি। বারো মাস পড়ে থাকেন স্পেনে। নিজের পছন্দের দল না-দিলে খেলেন না। কোচের তৈরি দল পছন্দ না-হলে টিমবাসে বসে মোবাইলে টেক্সট করেন, মুখে কথা বলেন না। একের পর এক অভিযোগের তির আসতেই থাকে। মেসি কখনও পাল্টা উত্তর দেননি। অনেকেই এক দেশের হয়ে অন্য দেশের জার্সিতে খেলেছেন। দিয়েগো কোস্তা ব্রাজিলের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছেন। নিজের দেশে অভাবের তাড়নায় ট্রাক চালাতে শুরু করেছিলেন। কোস্তা জীবন খুঁজে পান স্পেনে। তিনি মনস্থ করে নেন, মৃত্যুকুয়ো থেকে বাঁচিয়ে আনা স্পেনের হয়েই খেলবেন। মেসির দেশের আলফ্রেডো দি স্টেফানো ছিলেন মাদ্রিদের ঘরের ছেলে। তিনিও বেশিটাই খেলেছেন স্পেনের হয়ে।

কোস্তার মতো মেসিও বলে দিতে পারতেন, ছোটবেলায় পুষ্টিজনিত রোগে মরেই যেতাম আর্জেন্টিনায় থাকলে। চিকিৎসা করাতে পারনি তোমরা। বার্সেলোনা আমার বাবার চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। সারা জীবনের জন্য আমার হরমোন ইঞ্জেকশনের দায়িত্ব নিয়েছিল। স্পেন জীবন দিয়েছিল, পরিবর্তে আমি ওদের ফুটবল দিয়েছি।

শত অভিযোগের বাণবিদ্ধ হওয়ার পরেও যত ক্ষণ মেসি নাচবেন, তত ক্ষণ শ্বাস চলবে আর্জেন্টিনার। তিনি স্তব্ধ মানে ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের মতোই ধড়গুলো থাকবে মাঠে। প্রাণ থাকবে না। সেন্ট পিটার্সবার্গের মাঠে যদি মেসি জেতেন, ফুটবল রোম্যান্স জিতবে। যদি না-পারেন? মার্ক টোয়াইনের মতোই হয়তো কখনও লিখবেন, শীতলতম দিন আমি দেখেছিলাম রাশিয়ার এক গ্রীষ্মে!

তা সে যতই তাঁর দেশে স্লোগান উঠুক— মেসি, তুমি বার্সেলোনার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE