Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তদন্তে গা নেই, কমিশনারকেই উল্টে প্রশ্নবাণ ফেডারেশনের

এর পরেও সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন এখনও পর্যন্ত নিরপেক্ষ কমিটি বা সংস্থার বাইরের কাউকে দিয়ে তদন্ত করতে উদ্যোগী হয়নি। সংস্থার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে এই দু’জনের চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এ ধরনের গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে যা নজিরবিহীন এবং খুবই আশ্চর্যজনক। 

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৯ ০৪:০৮
Share: Save:

মিনার্ভার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ম্যাচ কমিশনার বালসুব্রহ্মণ্যম চিঠি জমা দিয়েছেন তিন দিন হয়ে গেল। সেই চিঠিতে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, তাঁর দেখে মনে হয়েছে মিনার্ভা খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে খেলেনি। ‘রেফারিজ অ্যাসেসর’ও (রেফারিদের মান নির্ণয় করার জন্য যিনি থাকেন) একই সংশয় প্রকাশ করে চিঠি জমা দিয়েছেন।

এর পরেও সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন এখনও পর্যন্ত নিরপেক্ষ কমিটি বা সংস্থার বাইরের কাউকে দিয়ে তদন্ত করতে উদ্যোগী হয়নি। সংস্থার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির কাছে এই দু’জনের চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এ ধরনের গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে যা নজিরবিহীন এবং খুবই আশ্চর্যজনক।

ফেডারেশন জানিয়েছে, তাদের ‘ইন্টিগ্রিটি অফিসার’ জাভেদ সিরাজ তদন্ত শুরু করেছেন। ঘটনা হচ্ছে, সেই তদন্তও শুরু হয়েছে সংবাদমাধ্যমে ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্ট বেরিয়ে যাওয়ার পরে। তার আগে ফেডারেশন থেকে ম্যাচ কমিশনারের চিঠি যে জমা পড়েছে, সে কথাও জানানো হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, ফেডারেশন কি আদৌ অভিযোগ সঠিক ভাবে খতিয়ে দেখার ব্যাপারে আগ্রহী? না কি অতীতে ক্রিকেটে যেমন গড়াপেটার অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার বহু ঘটনা দেখা গিয়েছে, ফুটবলও সে দিকে যাচ্ছে?

চেন্নাই বনাম মিনার্ভা ম্যাচ নিয়ে ম্যাচ কমিশনার যে সব পর্যবেক্ষণ জমা দিয়েছেন, তা বিস্ফোরক। তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘চেন্নাইয়ের বিদেশি ফুটবলার পেদ্রো মানজ়ি পেনাল্টি মারার আগে হাত দিয়ে দিকনির্দেশ করেছিলেন। সে দিকেই তিনি শট মারেন। মিনার্ভার গোলকিপার উল্টো দিকে ঝাঁপ দেন।’’ আরও লিখেছেন, ‘‘৫৩ মিনিটে মিনার্ভা তাদের ১৭ নম্বরকে (রোল্যান্ড বিলালা) তুলে নেয়। সেই সময় তাঁর দল তাঁরই গোলে এগিয়ে ছিল। উঠে আসতে বলায় সেই ফুটবলার নিজেও খুব চমকে যায় কারণ সেই সময়ে খুব আক্রমণাত্মক ফুটবল সে খেলছিল।’’ চিঠিতে এর পরের অংশ, ‘‘মিনার্ভা তাদের ১০ নম্বরকে (খুয়ান কোয়েরো) তুলে নেয় ৭৬ মিনিটে। খুবই ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল সেই ফুটবলারকে। বেঞ্চের দিকে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও ছাড়েনি সে।’’

অতীতে ক্রিকেটে গড়াপেটার অভিযোগ ওঠার পরে চোখে ধুলো দেওয়া তদন্ত হত। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যে চন্দ্রচূড় কমিশন তৈরি করেছিল ম্যাচ গড়াপেটার তদন্ত করার জন্য, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এন শ্রীনিবাসন দুই প্রাক্তন বিচারপতিকে নিয়োগ করেছিলেন জামাই গুরুনাথ মাইয়াপ্পানের বিরুদ্ধে ওঠা বেটিংয়ের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করার জন্য। তা নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। প্রশ্ন উঠে যায়, নিজের জামাইয়ের বিরুদ্ধে কারা তদন্ত করবেন, তা কী করে শ্রীনিবাসন ঠিক করে দিতে পারেন? প্রশ্ন বাড়তে বাড়তে এমনই আকার ধারণ করে যে, মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এবং সর্বোচ্চ আদালত নিরপেক্ষ কমিটি গড়ে দেয় শ্রীনির জামাই মাইয়াপ্পান এবং রাজ কুন্দ্রার বিরুদ্ধে ওঠা গড়াপেটার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করার জন্য। সেই মামলা এমনই বড় আকার ধারণ করল যে, শ্রীনিবাসনকে সরে তো যেতে হলই, ক্রিকেট কর্তাদের অবস্থানই প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। ক্রিকেট বোর্ড চালাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত প্রশাসকেরা। বিচারপতি লোঢার সুপারিশে আমূল বদলে ফেলা হচ্ছে ক্রিকেট বোর্ডের গঠনতন্ত্র।

ফুটবল ফেডারেশনে এখনও লোঢার ঘা পড়েনি। কর্তারা সংস্থার অভ্যন্তরীণ ইন্টিগ্রিটি অফিসারকে দিয়ে তদন্ত করাচ্ছেন। ওয়াকিবহাল মহল প্রশ্ন তুলছে ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে। এঁরা বলছেন, ক্রিকেট বোর্ড বা আইসিসি-র মতো বড়সড় দুর্নীতি দমন শাখা নেই সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ)। এখনও তা এক সদস্যের বিভাগ। শুধু অফিসার জাভেদ সিরাজই রয়েছেন। ক্রিকেট বোর্ড বা আইসিসি-তে সিবিআইয়ে কমিশনারের পদে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেক ম্যাচে হোটেল থেকে মাঠ সর্বত্র নজরদারি রাখেন। তার পরেও তাঁদের চোখ গলে ক্রিকেটের ম্যাচ গড়াপেটার ঘটনা ঘটে যায়। ফুটবলে একা ব্যক্তি কী করবেন?

শুধু তাই নয়, সন্দেহ প্রকাশ করে চিঠি জমা দিয়ে ম্যাচ কমিশনারই এখন পড়ে গিয়েছেন চাপে। মিনার্ভা এ দিন মানহানির মামলা করেছে ম্যাচ কমিশনারের বিরুদ্ধে। ফেডারেশন কর্তাদের মনোভাব দেখেও মনে হচ্ছে, অভিযোগ খতিয়ে দেখার চেয়ে তাঁরা ম্যাচ কমিশনার এবং রেফারিদের নির্ণায়ককে পাল্টা প্রশ্ন করতে বেশি আগ্রহী। ফেডারেশন সচিব কুশল দাস বুধবার চাঞ্চল্যকর দাবি করে বললেন, ‘‘ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্টে সন্দেহ প্রকাশ করে কিছু লেখা ছিল না। পরে ই-মেল করে তিনি ম্যাচ নিয়ে তাঁর আলাদা পর্যবেক্ষণ পাঠান। একই কাজ করেছেন রেফারিজ অ্যাসেসর। যেটা তাঁর করার কথা নয়। শুনেছি, পরে পাঠানো এই দু’টি ই-মেলের নেপথ্যে টাকাপয়সার লেনদেন হয়েছে। সেই কারণেই আমরা ঘটনার তদন্ত করতে পাঠিয়েছি ইন্টিগ্রিটি অফিসারের কাছে।’’ কাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে? ফেডারেশন কি তাদেরই ম্যাচ কমিশনার, রেফারিজ অ্যাসেসরের সততা নিয়ে উল্টে প্রশ্ন তুলছে? সচিব সে প্রশ্নের জবাব দেননি।

বোঝাই যাচ্ছে, ম্যাচ কমিশনারের বয়ান চূড়ান্ত বলে যে ধরে নেওয়া হয়, যে কোনও কারণেই হোক এ ক্ষেত্রে তা মানতে নারাজ ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তারা। উল্টে প্রশ্নবাণের মুখে কমিশনার এবং অ্যাসেসর। কেন শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধানের কাছে পাঠানো হল না ম্যাচ কমিশনারের চিঠি? সত্য কী? তা প্রকাশ করার জন্য তদন্ত করা হচ্ছে না কি ক্রিকেট গড়াপেটা অভিশাপের সেই শুরুর দিনের মতো সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? জানতে চাইবে ফুটবল মহল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE