প্রকৃতির রোষে তখন চার দিক লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের জল ফুঁসে চলেছে নীচ দিয়ে। আর ন’বছরের মেয়েটা গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলছে। ঝুলছে মানুষের সবচেয়ে আদি-অকৃত্রিম আঁকুতিটাকে রসদ করে— আমাকে বাঁচতে হবে।
এক যুগের ওপর হয়ে গিয়েছে। ভয়ঙ্কর সেই চার-পাঁচটা দিন কখনও আবছা হয়ে যায় তাঁর মনে, কখনও বা দুঃস্বপ্ন হয়ে ভেসে ওঠে। কিন্তু একটা জিনিস আবছা হয়নি। বরং দিনে দিনে যার বুনিয়াদ আরও মজবুত হয়েছে। মেয়েটার ইস্পাত কঠিন মন। যে মন তাঁকে লড়তে শিখিয়েছে। দিয়েছে জীবন যুদ্ধে জেতার মন্ত্র। যে মন এখন আর শুধু তাঁকেই স্বপ্ন দেখায় না, দেখায় গোটা দেশকে। যে মনটা তাঁকে নিয়ে এসেছে বিশ্বের দরবারে।
ডেবোরা হেরল্ড। ২০০৪ সালের আন্দামান-নিকোবর দীপপুঞ্জের সুনামি হানা থেকে বেঁচে আসা মেয়ে। ডেবোরা হেরল্ড। ভারতের প্রথম মেয়ে সাইক্লিস্ট যিনি র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের চার নম্বরে উঠে এসেছিলেন। ডেবোরা হেরল্ড। যিনি আগামী ১০ থেকে ১২ নভেম্বর ম্যাঞ্চেস্টারে অনুষ্ঠেয় ট্র্যাক-সাইক্লিং বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে পদক জেতার লড়াইয়ে নামবেন।
আরও পড়ুন: প্রণবই বেশি ভাল প্রধানমন্ত্রী হতেন, বললেন মনমোহন
দিল্লিতে গত তিন ধরে চলা ট্র্যাক এশিয়া কাপে ভাল পারফরম্যান্সের ফলে অর্জিত পয়েন্টের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবারই ডেবোরা এবং আলিনা রেজি বিশ্বকাপের ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছেন। ‘‘স্বপপূরণের আরও কাছে চলে এসেছি আমি,’’ শুক্রবার নয়াদিল্লি থেকে ফোনে বলছিলেন এই ‘বিস্ময় মেয়ে’। কী সেই স্বপ্ন? ‘‘আমর দেশের নাম বিশ্ব মঞ্চে উজ্জ্বল করা। দেশের হয়ে পদক জেতা। আর ২০২০ অলিম্পিক্সে নামা,’’ বললেন ডেবোরা।
ভবিষ্যৎ এখন তাঁর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কিন্তু তাঁর অতীত? ভারতীয় সাইক্লিং ফেডারেশনের কর্তাদের সঙ্গে কথা বললে যে ভয়ঙ্কর অতীত সামনে উঠে আসে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামিতে তছনছ হয়ে যায় কার আইল্যান্ড। বাবা-মার থেকে ছিটকে যায় বাচ্চা ডেবোরা। আজ বাইশ বছর বয়সে এসেও সেই অতীত নাড়া দিয়ে যায় তাঁকে। ‘‘তিন-চার দিন হবে হয়তো। গাছের ডালে বসেছিলাম। নীচে তাকালে দেখছিলাম সমুদ্র ফুঁসছে। আমি তো শেষ দিকে খিদের জ্বালায় গাছের পাতা, ছালও খেয়ে নিয়েছিলাম,’’ বলতে বলতে কিছুটা যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন ডেবোরা।
যে লড়াই জিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন ডেবোরা, বরাবর খেলাধুলায় ঝোঁক যে মেয়ের, সে যেন এর পরে আরও বেশি করে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় মাঠের লড়াইয়ে। ‘‘ছোট থেকেই আমি স্কুলের প্রতিযোগিতায় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভাল ছিলাম। তার পর সাইক্লিংয়ে আগ্রহ বাড়ে। টুর্নামেন্টও জিতি। সেই শুরু,’’ আনন্দবাজার-কে বলছিলেন বায়ুসেনা কর্মীর মেয়ে।
প্রথমে আন্দামান সাই। সেখান থেকে বছর চারেক আগে দিল্লি। ভারতীয় সাইক্লিং ফেডারেশনের মহাসচিব ওঙ্কার সিংহ ফোনে বলছিলেন, ‘‘ডেবোরা আমাদের কাছে একটা পরীক্ষামূলক প্রোজেক্ট ছিল। ও সেই পাইলট প্রোজেক্টের ফল। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, ভারতের বিশেষ বিশেষ জায়গার আদিবাসীরা এই ধরনের খেলায় কতটা মানিয়ে নিতে পারে। এখন আমরা ভারতের নানা জায়গা থেকে এ রকম প্রতিভা তুলে আনার লড়াই লড়ছি।’’
বিশ্বকাপে এই নিয়ে ভারত দ্বিতীয়বার প্রতিনিধিত্ব করছে বলে জানালেন ফে়ডারেশন কর্তা। গত বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও নেমেছিলেন ডেবোরা। কী ভাবে আপনাদের চোখে পড়ে যায় মেয়েটি? ওঙ্কার সিংহ বলছিলেন, ‘‘ডেবোরার কাহিনি আমরা সবাই শুনেছিলাম। তবে আমরা কোনও সাইক্লিস্ট বাছতে যাই না। আমাদের লক্ষ্য থাকে ছেলেটা বা মেয়েটা কেমন ফিট, সেটা দেখা। ফিটনেস দেখে মনে ধরলে আমরা তাদের বেছে নিই। ডেবোরা-কেও সে ভাবে বেছেছিলাম।’’
এক মাস বাদে বিশ্বকাপ। কী আশা করছেন ডেবোরাদের থেকে? ‘‘দেখুন, আমরা একটা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করা। সেটা ডেবোরা-রা করেছে। এ বার পরের দু’টো লক্ষ্য হল, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর অলিম্পিক্সের ছাড়পত্র পাওয়া। আশা করছি, সেটাও হয়ে যাবে।’’
সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এখন লড়ে যাচ্ছেন ডেবোরা। চার বছরের বেশি হয়ে গেল বাবা-মাকে ছেড়ে দিল্লি চলে এসেছেন ট্রেনিংয়ের জন্য। বলছিলেন, ‘‘আমি আর ঘরে ফিরে যাইনি। গেলে ট্রেনিংয়ের ক্ষতি হবে বলে। বাবা-মায়ের সঙ্গে ফোনেই কথা হয়। আমি শুধু নিজেকে তৈরি করে চলেছি। আমাকে জিততেই হবে।’’
ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে তো বটেই ট্র্যাক এশিয়া কাপেও সোনা জিতেছেন। পদক এসেছে তাইওয়ান কাপেও। এ বার মিশন বিশ্বকাপ।
প্রকৃতির রোষের সঙ্গে লড়াই করে জিতে এসেছেন যে মেয়ে, এ বার তাঁর সামনে বিশ্বজয়ের চ্যালেঞ্জ।