Advertisement
E-Paper

ব্র্যাডম্যানের প্রিয় ওপেনার এ বার তাঁরই সঙ্গে ওপরে

অস্ট্রেলিয়ার প্রবীণতম ক্রিকেটার শনিবার সকালে সিডনি শহরতলিতে মারা গেলেন। বয়স হয়েছিল ৯৩। নিছক সে দিনের জন্য একটা তথ্যভিত্তিক খবর। ছেচল্লিশ টেস্টে সাড়ে তিন হাজারের ওপর রান। ৪৬ গড় এ গুলো অঙ্ক। আর আর্থার রবার্ট মরিসকে মাপার জন্য অঙ্ক কখনও উপযুক্ত মাপকাঠি হতে পারে না। আধুনিক ক্রিকেট দর্শন বলে— যাঁরা প্রাক ফ্রন্টফুট, প্রাক-পিচ কভার ব্যবস্থা এবং প্রাক হেলমেট যুগে খেলেছেন নতুন যুগে তাঁদের মাপতে হলে প্রত্যেকের ব্যাটিং গড়ে গণহারে ১০ যোগ হওয়া উচিত।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪১
সিডনির অদূরে নিজের বাড়ির ক্রিকেট লাইব্রেরিতে মরিস। গত বিশ্বকাপের সময় ছবিটি তোলেন গৌতম ভট্টাচার্য।

সিডনির অদূরে নিজের বাড়ির ক্রিকেট লাইব্রেরিতে মরিস। গত বিশ্বকাপের সময় ছবিটি তোলেন গৌতম ভট্টাচার্য।

অস্ট্রেলিয়ার প্রবীণতম ক্রিকেটার শনিবার সকালে সিডনি শহরতলিতে মারা গেলেন। বয়স হয়েছিল ৯৩।
নিছক সে দিনের জন্য একটা তথ্যভিত্তিক খবর। ছেচল্লিশ টেস্টে সাড়ে তিন হাজারের ওপর রান। ৪৬ গড় এ গুলো অঙ্ক।
আর আর্থার রবার্ট মরিসকে মাপার জন্য অঙ্ক কখনও উপযুক্ত মাপকাঠি হতে পারে না। আধুনিক ক্রিকেট দর্শন বলে— যাঁরা প্রাক ফ্রন্টফুট, প্রাক-পিচ কভার ব্যবস্থা এবং প্রাক হেলমেট যুগে খেলেছেন নতুন যুগে তাঁদের মাপতে হলে প্রত্যেকের ব্যাটিং গড়ে গণহারে ১০ যোগ হওয়া উচিত। আর তা হলে মরিস হয়ে যান ৫৬.৪৮। সঙ্গকারার নিকটতম প্রতিবেশী।
কেরিয়ার শুরুর দিকে নেভিল কার্ডাস উগ্র সমালোচনা করেছিলেন মরিসের। তিনি খুব ভেঙে পড়েছেন দেখে পরামর্শ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন বয়সে তাঁর চোদ্দো বছরের বড় অধিনায়ক। ‘‘মাথায় নিও না...নিজে খেলেনি তো... জানে না।’’
ডন ব্র্যাডম্যানের কাছে তরুণদের এই সব পরামর্শ পাওয়ার কোনও উপায়ই তখনকার দিনে ছিল না। নিল হার্ভি আনন্দবাজারকে একবার বলেছিলেন, ডনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলে তাঁর কাছের কোনও সিনিয়র ক্রিকেটারের মাধ্যমে যেতে হত। অথচ মরিস ক্রিকেট জীবনের শুরুতেই ডনের এমন প্রিয় হয়ে যান যে টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভাবের দু’বছরের মধ্যেই ব্র্যাডম্যান তাঁকে করে দেন ভাইস ক্যাপ্টেন। এমনকী উনিশশো আটচল্লিশের সেই অবিস্মরণীয় সফরে বানিয়ে দিয়েছিলেন অন্যতম ট্যুর সিলেক্টর।
ওভালের শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যানের শূন্য রানে বোল্ড হওয়া নিয়ে হাজার খানেক তত্ত্ব আছে। মরিসেরটা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য— ‘‘হোলিসের বলটা দারুণ পড়েছিল। ডন বুঝতেই পারেনি। মনে রাখবেন হোলিস ওই ইনিংসেই পাঁচ উইকেট নিয়েছিল।’’

মরিসের বক্তব্য আধুনিক সময়ে এমনিতেও সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া উচিত কারণ ঘটনাটার নিকটতম চার প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন। বোলার হোলিস, ব্যাটসম্যান ডন, উইকেটকিপার গডফ্রে ইভান্স আর তিনি নন স্ট্রাইকার— মরিস। মৃত্যুর কিছু দিন আগেও মরিস মজা করে বলেছেন, ‘‘ওই একটা শূন্য নিয়ে লাখ লাখ প্রশ্ন শুনেছি। আমার ইনিংস নিয়ে কেউ একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি।’’ মরিস করেছিলেন কত? ১৯৬।

হেডিংলেতে অস্ট্রেলিয়া যে চতুর্থ ইনিংসে চারশোর ওপর রান তাড়া করে জেতায় ইতিহাস তৈরি করেছিল তার পিছনেও মরিস-ব্র্যাডম্যানের জোড়া সেঞ্চুরি। আটচল্লিশের সেই সফরে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তিনি অধিনায়কের। ইংরেজ শো-গার্লের প্রেমে পড়েছেন তখন মরিস। আজকের দিনে বিরাট-অনুষ্কা প্রেম নিয়ে যেমন লেখালেখি হয়, তেমনই হইচই হয়েছিল তাঁদের নিয়ে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডে। ব্র্যাডম্যান চাপের মুখে বরাবর এই জুটির পাশে থেকেছেন।

মরিসের হাতে বিয়ার দেখে ডন নাকি বলেছিলেন কী সব যে ছাইপাঁশ খাও তোমরা। হোটেলের নীচে বারে বসে যখন গোটা টিম খেলার পর গলা ভেজাত, তিনি ডন তখন ওপরে বসে ফ্যানমেলের উত্তর দিতেন বা বই পড়তেন। মরিসের ধারণা ছিল ব্র্যাডম্যান যদি ড্রিঙ্ক করতেন তা হলে বাকি টিম তাঁকে এত ভুল বুঝত না। ‘‘টিম তো ওকে খেলার সময় ছাড়া দেখেইনি। ওর মধ্যে যে একটা সফট মন লুকিয়ে ছিল সেটা ওরা জানার সুযোগ পায়নি।’’

আটচল্লিশের ছয় মাস লম্বা ইংল্যান্ড সফরে তিনটে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন মরিস। পরের মরসুমেও চলতে থাকে তাঁর ব্যাটিং বিক্রম। একটা সময় টেস্ট গড় ছিল ৬৫। তার পর পঞ্চাশেরও নীচে নেমে আসে কিন্তু ডনের মুগ্ধতাবোধ তাতেও কাটেনি। ব্র্যাডম্যানের বাছাই করা সর্বকালের সেরা দলে ওপেনার হিসেবে হবস, হাটন, গাওস্কর কেউ নেই। আছেন মরিস আর ব্যারি রিচার্ডস। অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচিত শতাব্দী-সেরা দলেও হেডেন, সিম্পসন, লরিকে ছাপিয়ে মরিস! প্রথম স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে অবসর নিতে না হলে আরও কয়েক হাজার রান এবং সেঞ্চুরি তাঁর সিভি-তে জমা পড়ত।

কার্ডাস পরে মরিস সম্পর্কে নিজের মনোভাব সংশোধন করে নেন। আমার ভুল হয়েছিল— সাক্ষাতে বলেন। মরিস তা মেনেও নেন। শনিবার তিনি মারা যাওয়ার পর ব্র্যাডম্যানের আটচল্লিশের দলের একমাত্র জীবিত সদস্য থাকলেন ছিয়াশি বছরের নিল হার্ভি। কিন্তু মরিস চলে যেতে যেন অপেশাদার ভদ্রলোক ক্রিকেটের শেষ ধারাটাই বিলুপ্ত হয়ে গেল। মরিস সম্পর্কে ই ডব্লিউ সোয়ান্টন লিখেছিলেন, ‘ফিউ মোর চার্মিং মেন হ্যাভ প্লেড ফর অস্ট্রেলিয়া।’

মরিস এই গ্রহের একমাত্র মানুষ যাঁর সঙ্গে ব্র্যাডম্যান এবং জার্ডিন দু’জনেরই একই রকম হৃদ্যতা ছিল। ‘‘জার্ডিন মানুষটা কিন্তু ভাল ছিলেন। ওঁকে লোকে ভুল বুঝেছে।’’ এই পর্যবেক্ষণ কি কখনও ডনকে শুনিয়েছেন? ‘‘না। ডনের বিশ্বাস আমার কথায় বদলাত না।’’

পাঁচ মাস আগে সিডনি থেকে দেড় ঘণ্টা মোটর দূরত্বের বাড়িতে বসে এবিপিকে যে সাক্ষাৎকার দেন মরিস সেটাই সম্ভবত তাঁর শেষ ইন্টারভিউ। দ্বিতীয় স্ত্রী জুডিথ আগাগোড়া পাশে সাহায্যকারীর ভূমিকায় ছিলেন। কিন্তু তিরানব্বই বছর বয়সেও বিশেষ সাহায্য লাগেনি মরিসের। গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন পুরনো সব কথা। সাফ বলেছিলেন বিশ্বকাপ দেশে হলেও পারতপক্ষে দেখছেন না। ‘‘আমার সব প্রিয় টিভি সিরিয়াল ছেড়ে ওয়ান ডে ক্রিকেট দেখব কেন?’’

ওয়ান ডে-র প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় অসম্ভব মিল ছিল আর এক কিংবদন্তি নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেটারের সঙ্গে। যাঁর নাম কিথ মিলার। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মিলার নিয়ে একটাও প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি মরিস। এই ২০১৫-তে বসে নতুন কী থাকতে পারে সেই আটচল্লিশের টিম মেট মিলারের সঙ্গে যিনি মারা গিয়েছেন এগারো বছরেরও আগে। বার করতে পারিনি। রহস্যই থেকে গিয়েছে।

ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে সচিনদের তফাত কী সেটা কিন্তু বুঝিয়ে বলেছিলেন— ‘‘সচিন-লারা-ভিভ এরাও ডনের মতোই ভাল ছিল। কিন্তু তফাতটা মনঃসংযোগের তীব্রতায়। ডনের কনসেনট্রেশনটা অমানুষিক পর্যায়ের ছিল। প্রত্যেকটা বলকে ও ফ্রেশ হয়ে এক একটা নতুন বল হিসেবে দেখত আর রান বাড়াত। অবিকল মেশিনের মতো। এই গুণটার জন্যই ও সবার উপরে থেকে গেল।’’

শেষ দিকে অসুস্থ থাকলেও টেস্ট ক্রিকেটে কোথায় কে কী করছে খুঁটিনাটি খবর রাখতেন মরিস। ওপরে প্রিয় স্কিপারের সঙ্গে দেখা হলে নির্ঘাৎ প্রথমেই বলবেন, ‘‘সঙ্গার কলম্বো ইনিংসটা দেখে এলাম ডন। ধুর অ্যাভারেজ ষাটে নিয়ে যেতে পারল না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’’

Australia Don Bradman cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy