Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রোনাল্ডোর মাঠে মেসি-ধ্বনি, দশের জয়, গ্রহণ লেগেছে সাতে

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর অভিব্যক্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত যত শব্দ ব্যবহার হয়েছে, তার পাশে নিঃসন্দেহে তাঁর ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার-এর সংখ্যা ফেল মেরে যাবে! পৃথিবীর অগুনতি ভাষায় সিআর-সেভেনকে যত তকমায় ধরা হয়েছে, তার পাশে তেষট্টি মিলিয়ন সংখ্যাটা কি খুব বেশি? কিন্তু শনিবার রাতের পার্ক দে প্রিন্সেসের সিআর?

হরিষে-বিষাদে। গোল করে, করিয়ে উচ্ছ্বসিত মেসি। অন্য দিকে, পেনাল্টি মিস করে ভেঙে পড়েছেন রোনাল্ডো। ছবি: এএফপি, রয়টার্স

হরিষে-বিষাদে। গোল করে, করিয়ে উচ্ছ্বসিত মেসি। অন্য দিকে, পেনাল্টি মিস করে ভেঙে পড়েছেন রোনাল্ডো। ছবি: এএফপি, রয়টার্স

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ১০:০১
Share: Save:

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর অভিব্যক্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত যত শব্দ ব্যবহার হয়েছে, তার পাশে নিঃসন্দেহে তাঁর ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার-এর সংখ্যা ফেল মেরে যাবে!

পৃথিবীর অগুনতি ভাষায় সিআর-সেভেনকে যত তকমায় ধরা হয়েছে, তার পাশে তেষট্টি মিলিয়ন সংখ্যাটা কি খুব বেশি?

কিন্তু শনিবার রাতের পার্ক দে প্রিন্সেসের সিআর? কী বিশেষণ বসানো যায় তাঁর ওই মুখের পাশে? ম্যাচের আশি মিনিটে পেনাল্টি কিকটা যখন পোস্টে লেগে ছিটকে বেরিয়ে গেল, টিভির রোনাল্ডোকে বড় অদ্ভুত দেখাল। রোনাল্ডো তখন অসাড় প্রস্তরমূর্তি। রোনাল্ডো তখন শূন্য দৃষ্টিতে অবাধ্য বলের দিকে তাকিয়ে। রোনাল্ডো কখনও ব্যস্ত অবাক হাসিতে। রোনাল্ডো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে।

যন্ত্রণা যে তখন রোনাল্ডোর একমাত্র বিশেষণ, অদ্বিতীয় ভূষণ।

ফুটবল-অদৃষ্ট যে কোনও কোনও সময় খেলোয়াড়ের ফুটবল-সম্পত্তি কেড়েকুড়েই ছেড়ে দেয়, তা তো নয়! কখনও-কখনও তার সম্মানের রাজকোষও ফাঁকা করে দিয়ে যায়।

একই রাতে দু’জনের খেলা ছিল। মোনালিসার দেশে রোনাল্ডো। আব্রাহাম লিঙ্কনের দেশে মেসি। রোনাল্ডো পেনাল্টি মিস করলেন, গোলের হেড অফসাইড হয়ে গেল, নব্বই মিনিটে গোলের কাছে পৌঁছেও বঞ্চিত থেকে গেলেন বারবার। ফিরলেন টিমকে এই অনিশ্চয়তার দড়িতে দাঁড় করিয়ে, যেখানে শেষ ম্যাচ জিততে না পারলে সব শেষ। মেসি সেখানে গোল করলেন, গোলের পাস দিলেন, ভেনেজুয়েলাকে ধ্বংস করে দেশকে তুলে দিলেন শতবার্ষিকী কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে। বাজি রেখে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে খেলার সময় কোনও ভেনেজুয়েলা সমর্থক সাহসই পাননি এলএমটেনের মনঃসংযোগ নষ্ট করার জন্য ‘রোনাল্ডো রোনাল্ডো’ বলে চেঁচাতে। পার্ক দে প্রিন্সেসে সেটা হল। রোনাল্ডোকে সহ্য করতে হল তাঁকে ব্যঙ্গ করে অস্ট্রিয়া সমর্থকদের ‘মেসি, মেসি’ চিৎকার।

এই পরিমাণ আঘাত রোনাল্ডোকে পেতে হচ্ছে একটাই কারণে, কারণ তাঁর ক্যারিশমাও যে অতটাই গগনচুম্বী! বড় ফুটবলার আসে, কিন্তু বড় ফুটবলারের সঙ্গে বড় ক্যারিশমা সব সময় পাওয়া যায় না। পর্তুগালেরই ইউসেবিও, লুই ফিগো কম বড় ফুটবলার ছিলেন না। কিন্তু এঁদের কাউকে অন্তর্বাসের মডলে ভাবা যায়নি। কল্পনা করা যায়নি পর্ন সিনেমার অনুপ্রেরণা হিসেবে। রোনাল্ডো নিয়ে? যায়। ফ্রি-কিক নেওয়ার সময় তাঁর দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়ানো, চুলের নিত্যনতুন স্টাইল, গোল করে আকাশ ছুঁয়ে আবার রকস্টারের মতো ভূখণ্ডে আছড়ে পড়া— কত তরুণীর যে রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, ঈর্ষায় পুড়িয়েছে কত পুরুষকে! পাথুরে শরীর, চকচকে চেহারা, বাচ্চাদের মতো মিষ্টি— প্রশংসা নয়, এক-একটা ফুল যেন। ব্যর্থতার রোনাল্ডো, আতঙ্কের রোনাল্ডো— তাঁদের আছে আলাদা আলাদা বিশেষণ। বার্সেলোনা সমর্থকদের জিজ্ঞেস করুন শুনবেন— রোনাল্ডো ‘স্যাটানিক’। আস্ত শয়তান!

বিলেতের মিডিয়া ইদানীং পান থেকে চুন খসলে রোনাল্ডোকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ফুটবল-ইতিহাসে রোনাল্ডোই সর্বপ্রথম পেনাল্টি মিস করেছেন, এমন নয়। ডেভিড বেকহ্যাম করেছেন। রোনাল্ডিনহো করেছেন। রবার্তো বাজ্জো বিশ্বকাপ ফাইনালে করেছেন। তা হলে? তাঁর টিম তো ইউরো থেকে ছিটকেও যায়নি। তবু দেখা গেল, ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত দৈনিক আজ লিখেছে রোনাল্ডো শেষ। বিশ্বের এক নম্বর ফুটবলারের দৌড়ে তাঁকে আর রাখা যায় না।

একত্রিশ বছরের কোনও ফুটবলারের জীবনে এই পতন অস্বাভাবিক নয়, হতেই পারে। কিন্তু এরা লিখেছে, এক সময় রোনাল্ডো মাঠ জুড়ে যে খেলাটা খেলতেন, তা আর নেই। এখনও লিওনেল মেসি গোটা মাঠ ছুটে বেড়ান বল পেতে। বিশ্বাস করেন যে, প্রতিপক্ষকে মাঠের যে কোনও জায়গা থেকে আঘাত করার ক্ষমতা তাঁর আছে। রোনাল্ডো সেখানে খোঁজেন নিরাপদ আশ্রয়। যেখান থেকে গোল করা সহজ হবে। ফুটবল নয়, সাইডশো-ই নাকি এখন ক্রিশ্চিয়ানোর মূলধন!

সোশ্যাল মিডিয়ায় গত রাত থেকে সমর্থনের দুই গোলার্ধে খুব হইচই চলছে। মেসি-গোলার্ধ তীব্র ধিক্কারে শুইয়ে দিচ্ছে মারাদোনা-পেলেকে। যাঁরা কয়েক দিন আগে মেসি নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা বলেছিলেন। পেলে তো রোনাল্ডোকেই শ্রেষ্ঠ বলে দিয়েছিলেন। আসলে মাঠ শুধু নয়, পারফরম্যান্স চার্ট শুধু নয়, রেকর্ডের যুদ্ধেও রোনাল্ডোকে শনিবার নিঃস্ব করে দিয়েছেন মেসি। রোনাল্ডো পর্তুগাল জার্সিতে ১২৮-তম ম্যাচটা খেলতে নেমেছিলেন। যা জাতীয় রেকর্ড। মেসি আবার একই রাতে নেমে আর্জেন্তিনার হয়ে সর্বাধিক গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেললেন। ৭৮ ম্যাচে ৫৪ গোল করেছিলেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। ‘বাতিগোল’ ছুঁয়ে মেসিরও এখন তাই। দেশের জন্য মেসি কিছু করেন না, এর পর তো আর সেটা বলা যাবে না।

ম্যাচের পরে মেসি বলে গেলেন, ‘‘বাতিকে ছুঁয়েছি মাত্র। টপকে যাইনি এখনও। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে বাতির পরে থাকতেই পছন্দ করব!’’ রোনাল্ডোকে সেখানে বলতে হল, ‘‘মন খুব খারাপ আমার। চাইনি এ ভাবে রেকর্ডটা ভাঙতে। সবচেয়ে ভাল হত যদি...’’ বলে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন। একটু সামলে আবার বললেন, ‘‘এ ভাবে রেকর্ড আমি চাইনি। নিজেও এত সুযোগ নষ্ট করলাম। পেনাল্টি, আরও কয়েকটা।’’ রোনাল্ডো চান, তাঁর টিম এখন শুধু নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখুক। ‘‘আর কত খারাপ হবে? আমরা কেবল ভাবছি, একটা ম্যাচ, একটা জয়। আর সেকেন্ড রাউন্ড।’’

সব বললেন পর্তুগাল অধিনায়ক, শুধু আসল কথাটা বললেন না। পর্তুগাল কেন, গোটা পৃথিবী যা এই মুহূর্তে শুনতে চায়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর উপর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বিশ্বাস— তার কী হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE