Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিদায়ের দিনে অনুপস্থিত থেকে গেল বঙ্গ ক্রিকেট

ঋজু, সৌম্যকান্ত, চেনা শরীরটা আজ নেই। বড় জরাজীর্ণ, খুব অচেনা লাগে। চোখ বন্ধ, গাল ঝুলে পড়েছে, এত লম্বা-চওড়া শরীরটা কুঁকড়ে আজ এতটুকু। একটা পাঁচ বাই ছয় বাঁশের কঞ্চির স্বল্প পরিসর খাটে অনায়াসে ধরে যায়!

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০৩:৫২
Share: Save:

ঋজু, সৌম্যকান্ত, চেনা শরীরটা আজ নেই। বড় জরাজীর্ণ, খুব অচেনা লাগে। চোখ বন্ধ, গাল ঝুলে পড়েছে, এত লম্বা-চওড়া শরীরটা কুঁকড়ে আজ এতটুকু। একটা পাঁচ বাই ছয় বাঁশের কঞ্চির স্বল্প পরিসর খাটে অনায়াসে ধরে যায়! শায়িত মানুষটার পাশে এখন আরও একজন ঘুরছেন। এক বার..দু’বার... তিন বার। আত্মজ তাঁর। জল পড়ছে চোখ থেকে, তবু আচার মেনে শায়িত মুখের কাছে নিয়ে যেতে হচ্ছে অগ্নিপিণ্ড।

প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের মুখাগ্নি চলছে।

টালা ব্রিজ পার্শ্ববর্তী হলদেটে বাড়িটার সামনে খুব ভিড় আজ। পাড়া-প্রতিবেশী, চেনা-আধচেনা। এত দিন কেউ খুব একটা আসত না। আট মাস হয়ে গিয়েছিল হলদে দালানের মালিক দেখতে পেতেন না এত দিনের চেনা মুখগুলো। ইডেনে দেখা হত রোজ, পরিচয়-বন্ধুত্ব-সখ্য বহু দিনের। তবু, কেউ আসত না। কিন্তু আজ এসেছে। তাঁর ছোট্ট ঘরের বাইরে গিজগিজে লোক। সার সার চেয়ার পাতা। সেখানে সিএবির লোকজন। আত্মীয়-স্বজন। গাড়ি আসছে, দাঁড়াচ্ছে। লোকে নেমে ভেতরের ছোট্ট ঘরটায় শায়িত শরীরে ফুল দিয়ে আসছে। আজ প্রচুর লোক, অনেক ভিড়।

শ্রদ্ধেয় প্রবীরদা আজ থেকে নিরুদ্দেশ। আজীবনের মতো।

দুই সিএবি কর্তার মাথা নিচু, খুব অসহায় দেখাচ্ছে এখন। সন্ধের কাশী মিত্র শ্মশানঘাটে হাহাকারের মতো শোনায় প্রবীর-পুত্র প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথাগুলো। ‘‘খুব অপমান পেলেন শেষ জীবনে। বাবাকে লা়ঞ্ছিত হয়ে চলে যেতে হল,’’ অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে যখন বলে যান, সেই দুই ক্রিকেট কর্তার একজনের দেখা গেল দৃষ্টি মাটিতে নিবদ্ধ। অন্য জন অন্য দিকে তাকিয়ে। বলার কিছু নেই, যুক্তি দেওয়ার কিছু নেই, আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিধানে পড়ে নেই কোনও শব্দ আজ।

প্রবীর মুখোপাধ্যায় একটু আগে চুল্লিতে চলে গিয়েছেন।

জীবদ্দশায় প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহও আর ইডেনে কোনও দিন ঢুকবে না। প্রয়াণের পরে সেই শপথ রেখে দিলেন প্রাক্তন ইডেন কিউরেটর। মৃত্যুর উনিশ ঘণ্টা পর তাঁর অন্ত্যেষ্টি হল, শিলিগুড়ি থেকে উড়ে আসা ছেলের জন্য মৃতদেহ অপেক্ষা করল, কিন্তু ইডেন ঢুকল না। বরং রেখে গেল চাপ-চাপ অভিমান। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বাষ্প। বঙ্গ ক্রিকেটমহলের বড় অংশের অনুপস্থিত থেকে যাওয়া নিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।

বৃহস্পতিবার সকালে প্রবীরবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ক্ষোভ-অভিমান-বিলাপ-স্মৃতিচারণ সব পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছে। কেউ বলে যাচ্ছেন ইডেন যদি মন্দির হয়, প্রবীর ছিলেন তার পুরোহিত। কেউ বলছেন, ইডেন মালিদের জন্য লোকটা কী লড়ে গেল দেখো। টাকা বাড়ানো থেকে বাসস্থান— প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে সিএবির সঙ্গে মুহুর্মুহু যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এমনকী নার্সিংহোমে শুয়েও আইপিএল ম্যাচে মালিদের ভিজতে দেখে সিএবির একজনকে সাফ বলে দিয়েছেন, ‘‘কী রে, তোরা একটা ওয়াটারপ্রুফও দিতে পারিসনি ওদের?’’

বাড়ির বাইরে আরও একটা দৃশ্য একই সঙ্গে চোখে পড়ল। বর্তমান ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কয়েক জন সিএবি কর্তা। যাঁরা অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছেন পরিবারকে রাজি করানোর। চেষ্টা করছেন, একবারের জন্যও অন্তত প্রাক্তন কিউরেটরের মৃতদেহ ইডেনে নিয়ে যেতে। বলছেন, সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় চাইছেন সেটা করা হোক। কিন্তু উত্তরে পরিবার থেকে একটা লাইনই ঘুরেফিরে বারবার আসছে— প্লিজ, আপনারা আর অনুরোধ করবেন না। লাভ নেই। কারণ প্রবীরবাবুর শেষ ইচ্ছে মানা হবে।

‘‘কেন বলব না বলুন? কতটা দুঃখ পেলে একটা মানুষ ওই কথা বলে যেতে পারে? বাবা এত দিন মাঠ করে কী পেলেন তো দেখলাম,’’ কান্নার সঙ্গে ক্রোধ মিশে থাকে প্রবীরের পুত্রবধু মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের গলায়। জড়ানো কণ্ঠস্বরে যিনি ফের বলতে থাকেন, ‘‘খেলার দুনিয়ায় ওঁর চলে যাওয়াটা কত প্রভাব ফেলবে জানি না। বিশেষ ফেলছে বলেও মনে হয় না। কিন্তু আমাদের উপর ফেলছে। ওঁর মৃতদেহ সিএবি পাঠিয়ে আর অপমানিত হতে দিতে পারব না।’’

প্রবীর মুখোপাধ্যায়কে শেষ বিদায় ময়দানের মাঠ কর্মীর।

শোকে মূহ্যমান প্রবীর-পরিবার মনে করে, মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে স্ত্রী-কন্যা হারিয়ে ইডেন কিউরেটরের একমাত্র জীবনীশক্তি ছিল ইডেন। অক্টোবরে বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়া টি-টোয়েন্টির পর সিএবি সেটাও কেড়ে নিল। ছেলে প্রণব বলছিলেন, ‘‘ইডেন থেকে যে তাঁকে চলে যেতে হতে পারে, বাবা ভাবতেও পারেননি।’’ শোনা গেল, ছিয়াশি বছরের প্রবীর প্রথম দিকে নাকি গুমরোতেন ভেতরে ভেতরে। অপেক্ষা করতেন সিএবি থেকে একটা ডাকের। যে কষ্ট, যে যন্ত্রণা ধীরে-ধীরে গত ডিসেম্বর থেকে তাঁকে অবসাদের গ্রহে ঠেলে নিয়ে যায়। একটু-একটু করে কমিয়ে আনে চিন্তাশক্তি, বোধবুদ্ধি, বিলুপ্তির পথ ধরে স্মৃতি। শেষের দিকে বরাবরের হাসিখুশি প্রবীর বেশির ভাগ সময় কাছের লোককেও চিনতে পারতেন না। একটা-একটা করে বন্ধ হতে থাকে জীবনের জানলাগুলো। আর মঙ্গলবার রাতে সব বন্ধ, সব শেষ। চিরতরে।

দুঃখের হল, বঙ্গ ক্রিকেটের বর্ণময় এক চরিত্রের চিরবিদায়ের দিনে ক্ষোভ-অভিযোগের স্রোতে সিএবি ভাবমূর্তি যেমন কলুষিত হল, তেমনই শোকমঞ্চে ক্রিকেটমহলের আশ্চর্য অনুপস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। তবু তো সিএবি কর্তাদের একটা বড় অংশকে এ দিন দেখা গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, কিন্তু অনেকে ছিলেন। রাতে শহরে ফিরে প্রবীরবাবুর বাড়ি চলে গেলেন সিএবি যুগ্ম সচিব অভিষেক ডালমিয়া। মহেশ্বর মালি থেকে গঙ্গা মালি— শ্রদ্ধার্ঘ্য তর্পণে তাঁরাও অনুপস্থিত থাকেননি। কিন্তু ক্রিকেটমহল মানে তো শুধু কর্তা নয়। মাঠকর্মী নয়। ভীষণ ভাবে ক্রিকেটারও। কিন্তু সদ্য ক্রীড়াপ্রতিমন্ত্রী পদপ্রাপ্ত লক্ষ্মীরতন শুক্ল এবং সৌরাশিস লাহিড়ী ছাড়া তো কাউকে দেখা গেল না! বাকি প্রাক্তনরা নেই, বর্তমানরাও নেই। শহরে থাকা বাংলা কোচ সাইরাজ বাহুতুলে— তিনিও আসেননি। এটা ঘটনা যে, গত রাতে সিএবি-র অনেকের কাছে প্রবীরের মৃত্যুর কথা জানা ছিল না। কিন্তু এ দিন সকাল থেকে চ্যানেলে চলেছে, ফেসবুকে ঘুরেছে। তা হলে? বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি শোনা গেল বাংলাদেশে খেলতে ব্যস্ত। তাঁরটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু বাকিরা? পরে বিখ্যাত এক প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ককে বলতে শোনা গেল, তাঁর গাড়ি ছিল না বলে নাকি যেতে পারেননি! সত্যি, কলকাতায় যানবাহন এখন ডাইনোসরের মতোই বিলুপ্ত বস্তু!

ক্রিকেটারদের দুই প্রতিনিধির এক, লক্ষ্মীরতন শুক্লর শ্রদ্ধার্ঘ্য। বুধবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

অথচ বোর্ডের ফেসবুক পেজে প্রবীর প্রয়াণের খবর আপলোড হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরে গিয়ে বোর্ড প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুর সিএবি যুগ্ম সচিব অভিষেক ডালমিয়াকে বলে ফেলেছেন, খবরটা শুনে তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। সন্ধেয় বোর্ডের প্রধান কিউরেটর দলজিৎ সিংহ দেখা গেল মিডিয়ায় একটা বিবৃতি পাঠিয়েছেন। যেখানে প্রবীরকে ভারতীয় কিউরেটরকুলের পিতামহ ভীষ্ম হিসেবে সম্বোধন করেছেন দলজিৎ।

এক দিক থেকে ভাবলে শুধু ক্রিকেটের বাইশ গজে নয়, জীবনের বাইশ গজেরও ভীষ্ম তিনি। জীবনের স্লগ ওভারে স্ত্রী-কন্যা হারালেন, ইডেন হারালেন, বিদায়ের দিনেও পড়ে থাকলেন একাকী, প্রস্থান ঘটল যন্ত্রণা নিয়ে।

এত নির্মম শরশয্যা আর কার কবে জুটেছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal cricket Prabir Mukherjee Eden
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE