ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ়ে তাঁর উইকেটসংখ্যা ১৭। ঋষভ পন্থ, কে এল রাহুলরা তাঁর ঘূর্ণির নাগাল পাননি। কুলদীপ যাদব, রবীন্দ্র জাডেজাদের পেছনে ফেলে চর্চায় উঠে এসেছেন। সিরিজ়ের সেরা ক্রিকেটারও তিনি। গুয়াহাটিতে দ্বিতীয় টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে বলকে যেন কথা বলাচ্ছিলেন। যেন কোনও জাদুকাঠি ছিল তাঁর হাতে। যা বলের উপরে ছুঁয়ে দিতেই ঘায়েল করছিল ব্যাটসম্যানদের। তিনি সাইমন হার্মার। ২৫ বছর পরে ভারতের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজ় জয়ের অন্যতম কান্ডারি।
মুম্বইয়ের স্পিন বোলার উমেশ পটওয়ালের কাছে ২০১৬ থেকে প্রশিক্ষণ নেন হার্মার। সচিন তেন্ডুলকরের জিমখানায় থেকেই অনুশীলন করতেন। এমনকি নেটে সচিনকে বলও করেছেন। পাকিস্তানে টেস্ট সিরিজ় খেলতে যাওয়ার আগে উমেশের কাছে এসেছিলেন হার্মার। তাঁর কাছে ট্রেনিং করেই উপমহাদেশে দু’টি টেস্ট সিরিজ়ের প্রস্তুতি সেরে নেন দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা অফস্পিনার।
সিরিজ়ে ১৭ উইকেট পাওয়ার পরে কোচকে ফোন করেন হার্মার। জানান, সময়ের অভাবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা উড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু উপহার তৈরি করে রেখেছেন কোচের জন্য। আনন্দবাজারকে ফোনে উমেশ বলছিলেন, ‘‘পাকিস্তান সিরিজ়ের আগে থেকেই আমার কাছে অনুশীলন করত। ওকে বুঝিয়েছিলাম, উপমহাদেশে লাল মাটির পিচে কখনও জোরের উপরে বল করতে নেই। এই ধরনের পিচে এমনিই গতি ও বাউন্স থাকে। বল ঘোরানোর চেষ্টা করা উচিত। গতিকমিয়ে বল করলে অনেক বেশি বাউন্স আদায় করে নেওয়া যায়। ইডেনে যে ধরনের পিচ ছিল, সেখানে গতির সঙ্গে বল করলে সমস্যা হত না। কিন্তু বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামের পিচের মাটি শক্ত। সেখানে গতি কমিয়েই সাফল্য পেয়েছে হার্মার।’’
কোচকে ফোন করে কী বললেন? উমেশের উত্তর, ‘‘ধন্যবাদ জানাল। বলল, ‘তোমার জন্য একটি উপহার আছে কোচ। এই সিরিজ়ের আগে অনেক সাহায্য করেছ।’ ও খুব বড় মনের মানুষ। যখনই মুম্বইয়ে আসে, অটোয় যাতায়াত করে। গাড়ি চড়তে পছন্দ করে না। অনেক সময় বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ত। মুম্বইয়ের সব ক’টি জিমখানা ওর চেনা। শিবাজী পার্কেও অনুশীলন করেছে। প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছেলে।’’ সচিন তেন্ডুলকরকে নেটে বল করার কাহিনিও শোনালেন কোচ। বলছিলেন, ‘‘সচিন তেন্ডুলকরের জিমখানা ক্লাব ওকে থাকার অনুমতি দিয়েছিল। সেখানে থেকেই অনুশীলন করত। এক বার সচিন স্যরকেও বল করেছে। সচিন স্যর ওকে পরামর্শও দিয়েছিল। বলেছিল টানা অফস্পিন করে উইকেট পাওয়া মুশকিল। প্রয়োজনে ফ্লোটার, স্ট্রেটারও দিতে হবে। ও তার পরে বৈচিত্রের উপরে জোর দেয়। সাফল্যের খিদে ওর মধ্যে মারাত্মক।’’
ইডেন টেস্টে হার্মারের বলের গড় গতি ছিল ৮৮ কিমি প্রতি ঘণ্টা। দ্বিতীয় টেস্টে ৮২ কিমি প্রতি ঘণ্টায় বল করেছে।ভারতীয় স্পিনারদের গড় গতি অনেকটা বেশি ছিল। ওয়াশিংটন সুন্দর বল করেছেন ৮৯ কিমি প্রতি ঘণ্টায়। কখনও ৯৮ কিমি প্রতি ঘণ্টাতেও তাঁকে বল করতে দেখা গিয়েছে। পিচের ক্ষতও সে ভাবে ব্যবহার করেননি। হার্মার কিন্তু ব্যাটসম্যানের নাগালের বাইরে বল রেখেছেন। ব্যবহার করছেন পিচের ক্ষত। ব্যাটসম্যানকে শট খেলার আহ্বান জানিয়েছেন। সেটাই বাকিদের থেকে তাঁকে আলাদা করে দিয়েছে।
উমেশ বলছিলেন, ‘‘বল অনেকেই ঘোরাতে পারে। কিন্তু একজন স্পিনারের সব চেয়ে বড় গুণ, সে ফ্লাইটের ব্যবহারে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে পারছে কি না। হার্মার কিন্তু রাহুলকে ফ্লাইটের ব্যবহারেই পরাস্ত করেছিল। হাওয়ায় বল ভাসিয়ে রাহুলকে ক্রিজ়ের বাইরে টেনে আনে। ঘূর্ণির কথা ভেবে অফস্টাম্প থেকেই কব্জির মোচড়ে বল ঠেলতে যায় মিড উইকেটে। ওর ব্যাট ও পায়ের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকেই স্টাম্পে আছড়ে পড়ে বল। হার্মার এই ধরনের বলই অনুশীলন করত।’’
কুলদীপকে যে বলে আউট করেছেন, সেটা আবার সম্পূর্ণ অন্য রকম একটি ডেলিভারি। বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানদের বিরুদ্ধে হার্মার নাকি এই ধরনের বল আগেও করতেন। কোচের কথায়, ‘‘ও যখন দেখে কোনও বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের রক্ষণ মজবুত, ও তখন শুরুতে বাইরের দিকে তাঁকে বল ফেলে শট খেলার আহ্বান জানায়। একই জায়গায় বল ফেলতে ফেলতে ব্যাটসম্যান ভাবে অফস্টাম্পের বাইরেই হয়তো বল ফেলবে ও। ঘূর্ণি এড়াতে ব্যাটসম্যান তখন পেছনের পায়ে গিয়ে অপেক্ষা করে। কুলদীপকে ও সেই ফাঁদেই ফেলেছে। কুলদীপ পেছনের পায়ে অপেক্ষা করছিল ওর ঘূর্ণির। সেই বলটাই ও ৯৩ কিমি প্রতি ঘণ্টায় করেছিল। একই রকম অ্যাকশনে এত গতিতে যে একটি বল করা যায় ও-ই দেখাল। সোজা মিডল স্টাম্প ছিটকে দিয়েছিল। আমাকে ফোনে বলেছিল, কুলদীপের বলটাই ওর সব চেয়ে প্রিয় ছিল।’’
কোচের আফসোস, ব্যাট হাতে নিজের প্রতিভা মেলে ধরতে পারেননি হার্মার। বলছিলেন, ‘‘ও কিন্তু খুব ভাল ব্যাটসম্যান। আমি তো অবাক যে ও একটিও অর্ধশতরান করতে পারল না। ওকে বলেছি, পরের বার অনুশীলন করতে এলে শুধু ব্যাটিংই করাব। বোলিংয়ে আর তোমাকে কিছু শেখানোর নেই। টেস্টে তোমার ব্যাট থেকে শতরান দেখতে চাই।’’
শুধুমাত্র বল করেই সিরিজ় সেরা। আগামী টেস্ট সিরিজ়ে ব্যাট হাতে তাঁর একটি বড় ইনিংসের অপেক্ষায় থাকবেন কোচ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)