Advertisement
E-Paper

শুভমন-পন্থদের বিস্তর অভিযোগ ‘ডিউক’ বল নিয়ে, ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে বিতর্কিত বল তৈরি হয় কী ভাবে, কেন পড়ে যাচ্ছে মান

ভারতের ক্রিকেটারেরা বার বার অভিযোগ করেছেন ‘ডিউক’ বলের মান নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বার বার বদলে ফেলতে হয়েছে বল। সত্যিই কি মান খারাপ হচ্ছে ২৬৫ বছরের পুরনো ‘ডিউক’ বলের?

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০২
cricket

আম্পায়ারের কাছে ডিউক বল নিয়ে অভিযোগ করছেন ভারতের টেস্ট অধিনায়ক শুভমন গিল। ছবি: পিটিআই।

আম্পায়ার পল রাইফেলের সামনে চামড়ার বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ঋষভ পন্থ। ভারতীয় উইকেটরক্ষকের অভিযোগ, বলের আকারই বদলে গিয়েছে। সঙ্গে অনুরোধ, বল পাল্টে দিন। রাইফেল রাজি হলেন না। ক্রুদ্ধ পন্থ বল ছুড়ে ফেললেন মাঠে। ম্যাচে জরিমানা হল তাঁর। পেতে হল ‘ডি-মেরিট’ পয়েন্টও। অধিনায়ক শুভমন গিল বার বার অভিযোগ করার পর দশম ওভারে বল বদল করেছিলেন আম্পায়ারেরা। কিন্তু যে বল দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও আপত্তি ভারতীয় বোলারদের। মহম্মদ সিরাজ বললেন, “সত্যিই কি এটা ১০ ওভারের পুরনো বল?” জসপ্রীত বুমরাহকে দেখে মনে হল, তিনিও খুশি হতে পারেননি।

বস্তুত, ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ়ে দু’দলের খেলার মান, লড়াই, ব্যক্তিগত ও দলগত নজিরের পাশাপাশি যে বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে, তা হল ডিউক বল। ভারতীয় ক্রিকেটারেরা বার বার বলের আকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অভিযোগ করেছেন, বল তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে বোলারদের কিছু করার থাকছে না। সুবিধা পাচ্ছেন ব্যাটারেরা। ভারত-ইংল্যান্ড পাঁচ টেস্টের সিরিজ়ে দু’দল মিলিয়ে রেকর্ড রান সেই অভিযোগকে আরও যৌক্তিক করেছে। ঘটনাচক্রে, ইংল্যান্ডও একই কথা বলেছে। অধিনায়ক বেন স্টোকস মনে করিয়ে দিয়েছেন, গত কয়েক বছরে যে দলই তাঁদের দেশে খেলতে এসেছে, তারাই বল নিয়ে অভিযোগ করেছে।

cricket

আম্পায়ারের কাছে বল নিয়ে অভিযোগ করছেন ঋষভ পন্থ। ছবি: পিটিআই।

ডিউক বল নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ২০২২ সালে। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড প্রথম আপত্তি তুলে বলেছিলেন, “দেখে মনে হচ্ছে এই বলে জোরে চাপ দিলেই আকার বদলে যাবে।” তিন বছর পরে আবার সেই বিতর্ক তৈরি হল। পাঁচ টেস্টের সিরিজ়ে প্রথম তিনটি টেস্টে অনেক বার বল বদলাতে বাধ্য হয়েছেন আম্পায়ারেরা। শেষ দু’টি টেস্টে অবশ্য কোনও অভিযোগ ভারতীয় দল করেনি। ডিউকের ইতিহাস ২৬৫ বছরের পুরনো। ১৭৬০ সালে জুতো প্রস্তুতকারক টিমোথি ডিউক এই বল তৈরি শুরু করেন। ‘ডিউক অ্যান্ড সন্স’ নামে এক সংস্থা খোলেন তিনি। কারখানা ছিল কেন্টে। ১৭৭৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের লোগো ব্যবহারের অনুমতি পায় ডিউক।

এখন ডিউকের মালিক দিলীপ জাজোদিয়া। ভারত থেকে ১৯৭০ সালে লন্ডনে যান তিনি। সেখানে সিটি অফ লন্ডনে চাকরি করতেন। তিন বছর পরে চাকরি ছেড়ে ‘মোরান্ট স্পোর্টস’ নামে একটি সংস্থা খোলেন। ১৯৮৭ সালে ‘ব্রিটিশ ক্রিকেট বলস্‌ লিমিটেড’-এর সর্বোচ্চ পদে বসেন দিলীপ। সেই বছরেই ‘ডিউক অ্যান্ড সন্স’ কিনে নেন। তার পর থেকে তিনিই এই সংস্থা চালাচ্ছেন। এখন পুত্র সুনীলও তাঁর সঙ্গে ব্যবসা সামলান। ২৬৫ বছরের পুরনো এই বল নিয়ে আগে এত বিতর্ক হয়নি যা এখন হচ্ছে। যার ফলে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন দিলীপ। প্রসঙ্গত, এখন ক্রিকেটে ডিউকই একমাত্র হাতে সেলাই করা বল। কোকাবুরা এবং এসজি বল সেলাই করা হয় মেশিনে। ফলে নিজের সংস্থার বল নিয়ে গর্বই রয়েছে দিলীপের। তাঁর কথায়, “ক্রিকেট বল তৈরি করা আমার রক্তে। প্রক্রিয়াটা জটিল। অনেক সময় লাগে। কিন্তু শেষে যে বলটা হাতে আসে, সেটা দেখে মন ভরে যায়।” ইংল্যান্ডে সিরিজ় হলে যে সব বলে খেলা হয়, তা নিজে হাতে বেছে দেন দিলীপ। ঘটনাচক্রে, তাঁর বেছে দেওয়া বলই বিতর্কের কেন্দ্রে।

ডিউক বল তৈরি হয় গরুর চামড়া থেকে। এক একটি গরুর চামড়ায় মাত্র ১৫টি বল তৈরি হয়। কারণ, গরুর পুরো শরীরের চামড়া ব্যবহার করা হয় না। দিলীপ বলেন, “আমরা শুধু শরীরের উপর দিকের চামড়া ব্যবহার করি। কারণ, সেখানেই চামড়া সবচেয়ে মোটা আর ভাল মানের। ফলে ভাল মানের বল তৈরি করা যায়।” তা হলে কেন এত বিতর্ক? ২০২২ সালে ব্রড যখন বলের সমালোচনা করেছিলেন, তখনও নিজের অবস্থানে অনড় থেকে সেই অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছিলেন দিলীপ। কিন্তু ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ের পরে একটু গুটিয়ে গিয়েছেন তিনি। দিলীপের মতে, কোভিডকালের প্রভাব তাঁর সংস্থার বলের মানের উপর পড়েছে। কী ভাবে?

cricket

ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে বল বদলাচ্ছেন আম্পায়ারেরা। ছবি: পিটিআই।

যে কোনও গরুর চামড়া থেকে ডিউক বল তৈরি করা যায় না। স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের ‘আবেরদিন আঙ্গুস’ প্রজাতির গরুর চামড়া থেকে এই বল তৈরি করা হয়। একটি নির্দিষ্ট খামার থেকে সেই চামড়া আসে। দিলীপের মতে, কোভিডের পর থেকে চামড়ার মানে তফাত হয়েছে। তিনি বলেন, “মানুষ বোঝে না যে, বিভিন্ন কারণে বলের মান খারাপ হতে পারে। গরুরা কোন ধরনের ঘাস খাচ্ছে, তার উপর তাদের চামড়ার মান নির্ভর করে। কী ভাবে সেই চামড়া কাটা হচ্ছে, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি বলের মানের পিছনে এ সবের সমান ভূমিকা রয়েছে।”

গরুর চামড়া কাটার পর তা থেকে বল তৈরি করতে ৯ মাস সময় লাগে। প্রথমে চামড়া কেটে তা কতটা চওড়া, তা মাপা হয়। সমান মাপের চামড়া অ্যালুমিনিয়াম সালফেটে ডুবিয়ে রাখা হয়। তার পর তাতে রং যোগ করা হয়। সেই চামড়া পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে। কয়েক মাস সেখানে রোদে শুকনোর পর আবার তা ফেরত পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। পূর্ব লন্ডনে দিলীপের কারখানায় সেই চামড়া থেকে বল তৈরি হয়। দিলীপের কারখানায় এখন যাঁরা বল সেলাই করেন, তাঁরা অনেকেই তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের। বাবা-ঠাকুরদার কাছ থেকে কাজ শিখেছেন। ডিউক বলে মোট ৮০টি সেলাই থাকে। একটি বল সেলাই করতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। ফলে এক জন দিনে ছয় থেকে সাতটি বলের বেশি তৈরি করতে পারেন না।

তবে সেখানেও কাজ শেষ হয় না। বলে লোগো ছাপানোর পরে গ্রিজ় ব্যবহার করা হয়। সেই গ্রিজ় আগুনে গলানো হয়। শেষে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেই বল পালিশ করা হয়। তার পর তা শুকোতে দেওয়া হয়। গ্রিজ় এবং পালিশের কারণেই বল সুইং করে। ৫০ বছর ধরে ক্রিকেটবল তৈরি করছেন দিলীপ। তাঁর মনে হয়েছে, আগে বোলারেরা এত অভিযোগ করতেন না। তাঁরা যে বল পেতেন, সেটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন। দিলীপের কথায়, “এ বছর ধরে দেখছি। আগে বোলারেরা আম্পায়ারের কথা মেনে নিতেন। যে বল পেতেন, তা দিয়ে উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন তো ১০ ওভার উইকেট না পড়লেই বলের দিকে আঙুল তোলা শুরু হয়। আম্পায়ারদের ক্ষমতাও কমে গিয়েছে। ক্রিকেটারদের কাছে তাঁরা নতিস্বীকার করেন।”

cricket

এ ভাবেই ডিউক বলের উপরে লাগানো গ্রিজ় গলানো হয়। ছবি: সংগৃহীত।

দিলীপের বরং প্রশ্ন, ইস্পাত বা লোহা দিয়ে তৈরি কোনও জিনিসও যে দীর্ঘ দিন চলবে, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে। তা হলে বলের ক্ষেত্রে কী ভাবে সেই নিশ্চয়তা থাকবে? তাঁরা সব সময় ভাল মানের বল তৈরিরই চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষমাত্রেই ভুল হয়। সেই বিষয়টিও ভাবতে অনুরোধ করেছেন তিনি। এখনকার ব্যাটারদের গায়ের জোর ও ব্যাটের মান নিয়েও কথা বলেছেন দিলীপ। তিনি বলেন, “এখনকার ব্যাটারদের গায়ের জোর অনেক বেশি। ব্যাটগুলোও দারুণ। তাই বলের উপর মার বেশি পড়ে। অনেক বেশি চার-ছক্কা হয়। গ্যালারির কংক্রিট বা লোহায় বল ধাক্কা খায়। ইংল্যান্ডে এখন গরম বেশি। পিচ রুক্ষ। সেখানে বোলারেরা গায়ের জোরে বল ড্রপ করায়। সে সবের কারণেও বল তাড়াতাড়ি খারাপ হতে পারে।”

তা হলে কি বলের মান ক্রমশ খারাপই হতে থাকবে? দিলীপের দাবি, তাঁরা সমস্যার অভিযোগ পেলে সমাধান করার চেষ্টা করেন। ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ়ে যে বলগুলি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে সেগুলি তিনি নিজে পরীক্ষা করে দেখছেন। কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা নিজে খতিয়ে দেখছেন। তিনি বলেন, “সমালোচনা নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আমরা নিজেদের সেরাটা দিচ্ছি। ভাল মানের বল তৈরির চেষ্টা করছি। শেষ দুটো টেস্টে তো বল নিয়ে কোনও অভিযোগ আসেনি।”

cricket

এই ডিউক বল নিয়েই যত বিতর্ক। —ফাইল চিত্র।

চলতি মরসুমের পরে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন দিলীপ। সম্ভাব্য বদল নিয়ে কথা হবে। বোর্ড চাইলে বলে প্রয়োজনীয় বদল করতেও তৈরি তিনি। এমন বল কি তৈরি করা যায়, যার আকার কোনও ভাবেই বদলাবে না? দিলীপ জানিয়েছেন, বোর্ড চাইলে তেমন বল তৈরি করতেও তাঁরা রাজি। তবে তাতে ব্যাট ভাঙার সম্ভাবনা থাকবে। সম্ভাবনা বাড়বে ব্যাটারের আঙুলে চিড় ধরার। সেই বলের আঘাতে আরও বেশি ক্রিকেটার হাসপাতালে যেতে পারেন। দিলীপ চান ব্যাট-বলের সমান লড়াই।

India vs England 2025 Duke Ball
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy