Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ও তো যথেষ্ট করেছে

পরম মমতায় হাসিখুশি মুখটার উপর হাত বুলিয়ে চলেছেন তিনি, চোখ দিয়ে জল ঝরছে অঝোরে। না, মেয়ে এখন নেই তাঁর সামনে। ছবি শুধু। তাতেই আদর করে চলেছেন গৌরীদেবী, অকাতর অপত্য স্নেহে।

সেই মুহূর্ত। কত পয়েন্ট পাবেন দীপা? অধীর অপেক্ষায় বাবা-মা। রবিবার আগরতলার বাড়িতে। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

সেই মুহূর্ত। কত পয়েন্ট পাবেন দীপা? অধীর অপেক্ষায় বাবা-মা। রবিবার আগরতলার বাড়িতে। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

প্রীতম সাহা
আগরতলা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১২
Share: Save:

পরম মমতায় হাসিখুশি মুখটার উপর হাত বুলিয়ে চলেছেন তিনি, চোখ দিয়ে জল ঝরছে অঝোরে। না, মেয়ে এখন নেই তাঁর সামনে। ছবি শুধু। তাতেই আদর করে চলেছেন গৌরীদেবী, অকাতর অপত্য স্নেহে।

কাঁদছেন কেন? আজ তো আপনার গর্বের দিন?

কথাটা শুনে প্রশ্নকর্তার দিকে চকিত ঘুরে গেলেন গৌরী কর্মকার। পরিচয়ে, ইনি দীপা কর্মকারের মা। কর্মকার-বাডির ছাদের চারপাশে ভিড়টা তখন আর নেই। আস্তে-আস্তে পাতলা হচ্ছে, বিষণ্ণ মেজাজে বাড়ি ফিরছে যে যার মতো। অথচ সন্ধে থেকে কী ভিড়টাই না ছিল এখানে। আত্মীয়, পরিচিত, অর্ধ পরিচিত, মিডিয়াকুল। একবার সে দিকে দেখে গৌরীদেবী বলে ফেললেন, ‘‘দুঃখে কাঁদছি কে বলল? মেয়ে আমার যথেষ্ট করেছে। প্রথম দিকে খারাপ লাগছিল একটু। কিন্তু এখন আর ও সব নেই। দেখবেন, রিওর এই আক্ষেপটাই ওর পরের অলিম্পিক্সের জ্বালানি হবে!’’

রাত বারোটা নাগাদ দেখা গেল, টিভিটা আবার খোলা হয়েছে। ভুল হল। আবার নয়, এই প্রথম টিভি খুলে বসেছে দীপার পরিবার। বাড়ির ছাদে প্রোজেক্টর দিয়ে ঘরের মেয়ের ইভেন্ট দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। লোকজন চলে যাওয়ার পর সে সবের পাট চুকিয়ে খুলে ফেলা হয়েছে টিভি, দেখে নেওয়া চলছে কে কী বলছে মেয়ের সম্পর্কে। দীপার বাবা দুলালবাবুকে পাওয়া গেল ওখানে। বলছিলেন, ‘‘ল্যান্ডিংয়ের সময় কোমরটা যদি মাটি না ছুঁত, পদক আজ নিশ্চিত ছিল জানেন? যা-ই হোক, অলিম্পিক্সের মতো মঞ্চে চতুর্থ হওয়া মুখের কথা নয়। আমাদের মেয়ে তো সে ভাবে পরিকাঠামোও পায়নি। সেখান থেকে ফোর্থ!’’

ঠিকই। দীপা কর্মকার রবিবার ভারতীয় সময়ে মধ্যরাত নাগাদ যা করে গেলেন, তাকে পদক দিয়ে মাপা যায় না। পিটি উষার ফোটোফিনিশে চতুর্থ হওয়ার মতোই দীপার কীর্তিও ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে ঢুকে যাবে। আর সেই সোনার মেয়েকে ঘিরে স্বপ্নের রাতের আকাঙ্খায় যে পরিবেশ সৃষ্টি হল, তাকেও ভোলা যাবে কি?

মনে তো হয় না।

রবিবার গোটা দিন ধরে কী কী হচ্ছিল নয়, প্রশ্নটা হওয়া উচিত কোনটা হয়নি। সকালে দীপার বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা গেল। ঠাকুরঘরে হনুমানজির মূর্তির সামনে অন্তত আড়াইশো মোমবাতি রাখা। গৌরীদেবী বলে যাচ্ছেন, ‘‘টিনা থাকলে পাঁচশোটা জ্বালাত। তা ছাড়া ও আমাকে বলে গিয়েছিল যে আমি ফাইনালে উঠলে মা তুমি মোমবাতি জ্বালাবে ঠাকুরের সামনে।’’ আলোচনা চলছে, মেয়ে ফিরলে মেনুটা কী হবে? শোনা গেল, ভাপা ইলিশ আর চিংড়ির মালাইকারি। দীপার বর্তমান কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীর স্ত্রী সোমা নন্দীকে ধরা গেল। পরিচয় হওয়া মাত্র যিনি মনে করিয়ে দিলেন, ল্যান্ডিংটা নিখুঁত করতে হবে শুধু। তা হলে হয়ে যাবে। সুবিমল ভট্টাচার্য নামের এক প্রৌঢ় দেখা গেল, আস্ত একটা গানও বেঁধে ফেলেছেন দীপাকে নিয়ে— সোনার মেয়েটি জিতে নিক সোনা/বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে,/দীপা যার নাম জ্বালালো যে দীপ/বিশ্ববাসীর মনে/ ত্রিপুরার এই কৃতী জিমন্যাস্ট/নেই তার কোনও ভয়,/বাজি রেখে প্রাণ চির অম্লান/ছিনিয়ে নিল যে জয়।

আর রাত? তার মাধুর্য আলাদা, মোহ আলাদা। ইভেন্ট শুরু হওয়ার আগে থেকে আতসবাজির যে ‘শো’ দেখা যাচ্ছিল, তা সাধারণত ভারত ক্রিকেটে বড় কোনও টুর্নামেন্ট জিতলে দেখা যায়! প্রথম দিকে দীপার প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন একে একে চোদ্দো পয়েন্টের আশেপাশে আটকে যাচ্ছেন, তখন যে চিৎকারটা চার দিক থেকে ছুটে এসে কানে তালা ধরিয়ে দিল তার পাশে একটাই বিশেষণ বসে। নারকীয়! সিমোন বাইলস— তিনি পর্যন্ত রেহাই পেলেন না। ঘরের মেয়ের পদক পাওয়া না পাওয়া বাইলসের ভল্টের উপর নির্ভর করছে বুঝতে পেরে যে শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ শুরু হল, তাকে শাপ-শাপান্তের বাইরে কিছু বলা যায় না।

শাপ-শাপান্তে কাজ হয়নি শেষ পর্যন্ত। বাইলসই স্বর্ণপদকটা নিয়ে গেলেন দীপাকে নিঃস্ব করে। কিন্তু তাই বলে বাঙালি মেয়ে যে খালি হাতে ফিরছেন, তা তো নয়। গর্ব তো বটেই, আরও একটা জিনিস ভল্টে নিয়ে ফিরছেন দীপা কর্মকার। তাঁর পরিবার যা বলে দিল। বলে দিল, রবিবার রাত থেকেই আরও একটা স্বপ্নের দৌড় শুরু করে দিয়েছে তাঁদের আদরের টিনা। শুরু করে দিয়েছে অপ্রাপ্তির জমিতে দাঁড়িয়ে।

টার্গেট— টোকিও।

টার্গেট—অলিম্পিক্স ২০২০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dipa Karmakar Rio Olympics Produnova
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE