Advertisement
E-Paper

সেমেনিয়ার ‘গোপী স্যর’ হতে চান প্রতিবাদী দ্যুতি

সদ্য প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের নতুন নিয়মে, যে সব মহিলা অ্যাথলিটের রক্তে প্রতি লিটারে পাঁচ ন্যানোমোল-এর বেশি টেস্টোস্টেরন রয়েছে, তাঁরা ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে অংশ নিতে পারবেন না।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:০৭
ক্ষুব্ধ: নতুন নিয়মে আপত্তি তুললেন দ্যুতি। ফাইল চিত্র

ক্ষুব্ধ: নতুন নিয়মে আপত্তি তুললেন দ্যুতি। ফাইল চিত্র

চার বছর আগে কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নেওয়ার জন্য ভারত ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তাঁর অ্যাথলিট জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির নির্দেশে তিনি পুরুষ না মহিলা অ্যাথলিট, তা জানার জন্য পরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাঁকে। যেখানে রক্তে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেশি থাকায় আর গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে নামা হয়নি এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী ভারতীয় স্প্রিন্টার দ্যুতি চন্দের।

সুদূর হায়দরাবাদ থেকে সে দিনের কথা বলতে গিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় গলা কেঁপে যায় দ্যুতির। বলেন, ‘‘ওই দিনগুলো আজও ভুলিনি। চরম অসম্মানের মধ্যে ফেলা হয়েছিল আমাকে। ট্রেনে, বাসে, শপিং মলে গেলেও কানে ভেসে আসত নানা টিপ্পনী। দম বন্ধ হয়ে আসত কখনও। ভাবতাম আর ট্র্যাকে নামব না।’’

পরে যদিও এক বছরের মধ্যেই লোজানের ক্রীড়া আদালতে মামলা জেতেন দ্যুতি। তিনি মহিলা নন, পুরুষ—তা আর প্রমাণ করা যায়নি আদালতে। ফলে রিও অলিম্পিক্সে অংশ নিতে সমস্যা হয়নি ভারতীয় এই মহিলা অ্যাথলিটের।

কিন্তু বুধবার আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন যে নতুন নিয়ম জানিয়েছে, তাতে এ বার সমস্যার কালো মেঘ দ্যুতির দক্ষিণ আফ্রিকান অ্যাথলিট বন্ধু কাস্তের সেমেনিয়ার কেরিয়ারে। যিনি গত দুই অলিম্পিক্সেই ৮০০ মিটারে সোনাজয়ী। সদ্য সমাপ্ত গোল্ড কোস্ট কমনওয়েলথ গেমস থেকেও ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে সোনা জিতে ফিরেছেন। অতীতে দ্যুতির মতো তাঁকেও লিঙ্গ-পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। তাঁর শরীরেও পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন বেশি।

কিন্তু সদ্য প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের নতুন নিয়মে, যে সব মহিলা অ্যাথলিটের রক্তে প্রতি লিটারে পাঁচ ন্যানোমোল-এর বেশি টেস্টোস্টেরন রয়েছে, তাঁরা ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু ১০০ ও ২০০ মিটার-সহ লং জাম্প, হাই জাম্প, জ্যাভলিন থ্রো, শটপাট-এ অংশ নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের দাওয়াই, হয় ওযুধ খেয়ে ছয় মাস চিকিৎসা করিয়ে টেস্টোস্টেরন কমাও। তার পরে মহিলাদের বিভাগে অংশ নাও। না হলে পুরুষদের সঙ্গে দৌড়োও।

১০০ ও ২০০ মিটারে অংশ নেওয়ায় দ্যুতির সমস্যা নেই। কিন্তু এই নিয়মের ফাঁদে পড়ে অ্যাথলিট জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধু সেমেনিয়ার। তা নিয়েই আসন্ন এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতির মাঝেও চিন্তিত ওড়িশার মেয়ে দ্যুতি। বলছেন, ‘‘সেমেনিয়া দারুণ লড়াকু মেয়ে। আমার ভাল বন্ধু। রিও অলিম্পিক্সে অনুশীলনের সময় আমাদের পরিচয়। তার পর থেকেই ইমেলে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। শুক্রবারই নিয়মটা জানার পরে ওকে ফের মেল পাঠিয়েছি।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘ভাবুন, এ রকম দুরন্ত পারফর্মার একটা মেয়ে কিনা ট্র্যাক থেকে একটা অদ্ভুতুড়ে নিয়মের জন্য হারিয়ে যাবে!’’

আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তা সেবাস্তিয়ান কো ইতিমধ্যেই বলছেন, ‘‘মহিলাদের অ্যাথলেটিক্সকে স্বচ্ছ করার জন্যই এই নিয়ম।’’ তা হলে আপনি এই নিয়মের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন কেন? ফোনের ও পার থেকে এ বার ফুঁসে ওঠেন দ্যুতি। ঝাঁঝিয়ে বলেন, ‘‘আমি বা সেমেনিয়ার মতো অ্যাথলিটরা কি হরমোন ইঞ্জেকশন নিয়ে ডোপিং করেছি? শরীরে স্বাভাবিক ভাবেই যদি টেস্টোস্টেরন বেশি থাকে, তা হলে আমরা কী করতে পারি? আমরা তো পুরুষ নই। এ ভাবে মহিলাদের অসম্মান করা হবে কেন? বিশেষ কয়েক জনকে ট্র্যাকের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা কি মানবিকতা? ভাবুন তো, ওর মানসিক অবস্থা! আজ যদি ও আত্মহননের মতো কিছু করে বসে, তা হলে কে দায়ী থাকবে? আমি নিজে ছাড় পেয়ে গেলেও এই নিয়মের বিরুদ্ধে সেমেনিয়াকে লড়তে সাহায্য করব।’’

কী ভাবে সাহায্য করবেন? দ্যুতির জবাব, ‘‘ওকে বলেছি, আমার মতো ক্রীড়া আদালতে মামলা করো। তা হলেই সুবিচার পাবে। আগে লিঙ্গ পরীক্ষা করা হত। আমার মামলা জেতার পরে সেটা বন্ধ করেছে। এ বার বলছে, কিছু কিছু ইভেন্টে নামা যাবে আর কিছু কিছু ইভেন্টে নামা যাবে না। এটা হাস্যকর নিয়ম ছাড়া আর কী?’’ যোগ করেন, ‘‘তিন বছর আগে আমাকে মামলা জিতিয়েছিলেন কানাডার ক্রীড়া-আইনজীবী জি এম বন্টিং। দুর্দান্ত মানুষ। মামলা হাতে নিয়েই কানাডা থেকে ফোন করে বলেন, ট্র্যাকে নেমে পড়ুন। আপনি জিতবেন। মামলাটা মন থেকে সরিয়ে মন দিয়ে অনুশীলন করুন। মামলা নিয়ে বরং আমি ভাবি। এই মানসিক জোরেই আন্তর্জাতিক স্তরে নির্বাসিত থাকলেও জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটারে সোনা জিতি। সেই বন্টিং স্যারের নম্বর, ইমেল সব পাঠিয়েছি সেমেনিয়াকে।’’

কিন্তু এ সব করতে গিয়ে যদি শাস্তির মুখে পড়েন? প্রশ্ন শুনে এ বার অট্টহাসি শুরু করে দেন দ্যুতি চন্দ। বলতে শুরু করেন তাঁর জীবনের ঘটনা। ‘‘আমি যখন লিঙ্গ-পরীক্ষার জাঁতাকলে পড়ে সমাজের একটা অংশের কাছে হাস্যকর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম তখন আমার কোনও হস্টেলে জায়গা হত না। কেউ আমার সঙ্গে অনুশীলন করতে চাইত না। তখন একটা ফোন এসেছিল আমার কাছে। যিনি ফোনটা করেছিলেন তিনি বলেন, হায়দরাবাদে আমার অ্যাকাডেমিতে একটা ঘর ফাঁকা আছে। সেখানে চলে এস। তোমার থাকা, খাওয়া, অনুশীলনের সব দায়িত্ব আমার। কোনও চিন্তা নেই।’’

কে এই মহানুভব?

দ্যুতি বলছেন, ‘‘উনি পুল্লেলা গোপীচন্দ। ব্যাডমিন্টন তারকা সাইনা নেহওয়াল, পি ভি সিন্ধুদের কোচ। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে সাহায্য করেছেন। দেখি এ বার আমি গোপী স্যরের মতোই সেমেনিয়ার মনের অন্ধকার কিছুটা হলেও দূর করতে পারি কিনা।’’

Dutee Chand Athletics দ্যুতি চন্দ Caster Semenya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy