Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
FIFA World Cup Qatar 2022

নাচো ভিনি নাচো, সোনালি কাপের অপেক্ষায় সম্রাট

হলুদ-সবুজ জার্সিধারী বংশধরদের অমন মায়াবী ফুটবল, সাম্বার অর্কেস্ট্রা চলবে আর তিনি— পেলে ঘুমিয়ে থাকবেন? বিশ্বাস করাই কঠিন। 

প্রার্থনা: পেলের সুস্থতার কামনায় ব্যানার নিয়ে নেমাররা। ফাইল চিত্র

প্রার্থনা: পেলের সুস্থতার কামনায় ব্যানার নিয়ে নেমাররা। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২২ ০৭:৩০
Share: Save:

সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে সত্যিই কি কোনও সাড়াশব্দ নেই তাঁর? কোনও ওষুধ, কোনও থেরাপিতেই আর কাজ হচ্ছে না?

নাকি সোমবার ক্ষণিকের জন্য পা দু’টো নড়ে উঠেছিল সম্রাটের? আচমকা চিকিৎসকদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল কি? নার্সদের মধ্যে কেউ কি বলে উঠেছিলেন— আরে, স্যরের চোখ দু’টো খুলল না?

হলুদ-সবুজ জার্সিধারী বংশধরদের অমন মায়াবী ফুটবল, সাম্বার অর্কেস্ট্রা চলবে আর তিনি— পেলে ঘুমিয়ে থাকবেন? বিশ্বাস করাই কঠিন।

ওই যে ভিনিসিয়াস জুনিয়র। দক্ষিণ কোরিয়ার দু’তিন জন ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষককে সামনে ডেকে এনে চিপ করে মাথার উপর দিয়ে গোল করে গেলেন। দেখে কে বলবে বিশ্বকাপের মতো হাইপ্রেশার প্রতিযোগিতা হচ্ছে! মনে হবে স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে বল নিয়ে চোর-পুলিশ খেলতে বেরিয়েছিলেন!

তখন কে ভেবেছিল, শুধু ট্রেলার দেখা গেল। পিকচার অভি বাকি হ্যায়। নেমারের পানেনকা পেনাল্টি কিক। দক্ষিণ কোরিয়ার গোলকিপার কখনও আত্মজীবনী লিখলে নিশ্চয়ই জানাবেন, কত রাত ঘুমোতে পারলেন না নেমারের পেনাল্টি-চাবুকে রক্তাক্ত হয়ে।

কিছুক্ষণ পরে রিচার্লিসন। বক্সের গোড়ায় বল নিয়ে তিনি যা করলেন, কে বলবে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ চলছে! মনে হল, সাও পাওলোর রাস্তায় বল-জাগলারি দেখাতে নেমেছে কেউ। প্রথমে মাথায় নাচালেন, তার পরে পায়ে, তার পরে পাস, তার পরে দ্রুত জায়গা নিয়ে দুর্ধর্ষ প্লেসিংয়ে গোল। সেই রিচার্লিসন, শূন্য পকেটে যিনি একদিন নোভা ভেনেসিয়ার দরিদ্র শহরতলি থেকে সাও পাওলোর উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। বাস ভাড়াটুকুও পকেটে ছিল না। রাস্তায় লোকের কাছে ভিক্ষা করে পয়সা তোলেন। তা দিয়ে বাস গুমটিতে সস্তার খাবার খেয়ে ড্রাইভারের কাছে আকুতি-মিনতি করে বাসে চাপেন। সাও পাওলোয় ট্রায়াল দিতে যাচ্ছিলেন। পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে বাকি জীবন ভিক্ষা করেই হয়তো কাটাতে হত। বিশ্বকাপের সেরা ‘গলি থেকে রাজপথ’ কাহিনি তিনি।

নেমার যে ভাবে তিন জনকে ছেলেখেলা করে ড্রিবল করছিলেন, দেখে কার মাথায় আসবে কুড়ি বছর বিশ্বকাপ জেতেনি ব্রাজিল! কে বলবে, অ্যাটলাসের মতোই পৃথিবীর চাপ তাঁর কাঁধের উপরে! চোট পাওয়ায় নিজের দেশে আক্রান্ত, রক্তাক্ত হচ্ছিলেন। চোটের জন্য কয়েকটা ম্যাচ না খেললেই যদি এই হয়, কাপ না জিতলে তো গিলোটিনে চড়ানোর দাবি উঠবে!

সেই নেমার আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে ফিরলেন। ফিরল ব্রাজিল। পুরনো ব্রাজিল। যেন সেই সত্তরের পেলের ব্রাজিল, যারা ফুটবল বিশ্বকে রাঙিয়ে দিয়েছিল হলুদ বসন্তে। যেন বিরাশির জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিল, যারা কাপ হারিয়েও জিতেছিল হৃদয়। যাদের ফুটবলের নামকরণ হয়েছে ‘হোগো বোনিতো’ অর্থাৎ সুন্দর খেলা। ৩৬ মিনিট, চার গোল, চারটি ডান্স শো। অনেক ব্রাজিল ভক্তের নিশ্চয়ই তখন মনে হচ্ছিল, অবশেষে আজ সেই ২০১৪-র বেলো অরিজন্তের অপমানের জবাব দেওয়ার রাত। সেদিন জার্মানি ১-৭ দুরমুশ করে দিয়ে গিয়েছিলে। এ বারে দ্যাখ জার্মানরা দ্যাখ— তোদের বিখ্যাত জাত্যাভিমানই কিছু করতে পারল না। আর আমরা গোলের ফোয়ারা ছোটাচ্ছি! হাফটাইমে চার গোলে এগিয়ে থাকার পরে ব্রাজিলকে দেখে মনে হল, জ্বালানি ধরে রাখতে চায় নক-আউটের বাকি অভিযানের জন্য। এর পরে ক্রোয়েশিয়া, জিতলে মেসির আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল। তারা নিশ্চয়ই কোরিয়ার মতো এমন আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলার জায়গা ছেড়ে রাখবে না।

রিচার্লিসন বলেছেন, দশ রকম নাচ তৈরি করে কাতারে এসেছেন। এটাই ব্রাজিল। যারা শুধু ঘ্যানঘ্যানে ফুটবল নকশা নিয়েই উপস্থিত হয় না, আনন্দ করতেও আসে। হাসপাতালে শায়িত কিংবদন্তির মন্ত্র মেনে চলে যে, ‘‘ফুটবল মানে খুশির ডানায় উড়তে থাকা। ফুটবল ইজ় ডান্স। ফুটবল ইজ় পার্টি।’’ কোচ তিতেকে যে নাচানো হল, তারও নাকি মহড়া হয়েছে। সোমবার রাতে যেটা বারবার দেখা গেল, তার নাম ‘পিজিয়ন ডান্স’। মহড়া চলেছিল অন্য এক ধরনেরও— ‘মোলেজ়াও’। অনেক চেষ্টার পরেও তিতে বুঝতে পারছেন না দেখে তা বাতিল করে ‘পিজিয়ন’ বাছা হয়।

ব্রাজিল যেদিন তার নিজস্ব সাম্বার তালে খেলে, এক ধরনের মায়াজাল তৈরি হয়। সেই উন্মাদনায় ম্যাচের গভীর ছবিগুলি হারিয়ে যেতে পারে। সোমবার যেমন সকলে ব্যস্ত থাকল ভিনিসিয়াসের গোল নিয়ে। গোলের উৎসবটা অনেকেই হয়তো খেয়াল করলেন না। শূন্যে হাত ছুড়ে যে ভাবে লাফ দিলেন, তা ফুটবল ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে ‘পেলে সেলিব্রেশন’ হিসেবে। ভিনিশিয়াস ও পেলে— ছোট্ট ইতিহাসও আছে। গত সেপ্টেম্বরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলতে নেমে বর্ণবিদ্বেষী বিদ্রুপে আক্রান্ত ভিনিশিয়াস। পেলে টুইট করেন, ‘‘ডান্স ভিনি, ডান্স। বর্ণবিদ্বেষ যেন আমাদের মুখের হাসি কেড়ে না নিতে পারে।’’ শুধু ভিনির পেলে-ভঙ্গিতে গোল উৎসর্গ কেন, ম্যাচ শেষে নেমারের নেতৃত্বে গোটা ব্রাজিল দল সম্রাটের ছবি-সহ ব্যানার নিয়ে এসে প্রার্থনা করল তাঁর জন্য!

সেই আবেগপূর্ণ ছবি ওঠার আগে একটার পর একটা গোল করে ভিনিসিয়াস, রিচার্লিসনরা নাচের এমন বন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন যে, সময়-সময় গুলিয়ে যাচ্ছিল— ডান্স রিয়্যালিটি শো দেখছি না তো? নাকি আমরা খুব উপর-উপর দেখছিলাম? এই ব্রাজিল, তাঁদের বল নিয়ে প্রতিপক্ষকে নাচানো আর গোল করে নাচের উৎসব— এ সবের তাৎপর্য কি আরও অনেক গভীরে নিক্ষিপ্ত?

দূর থেকে ভেসে আসা কোনও কণ্ঠের আর্তি কি তাতাচ্ছে তাঁদের? সাও পাওলোর হাসপাতালে শুয়ে কোনও ফুটবল সম্রাট কি নেমারদের বলছেন, ‘‘সময় ফুরিয়ে আসছে আমার, ওই সোনালি কাপটা জেতো। দেখে শান্তিতে ঘুমোতে যেতে পারি। ডান্স ভিনি, ডান্স!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

FIFA World Cup Qatar 2022 pele Brazil
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE