কিংবদন্তি নায়ককে দেখে ফেলেছিলাম সে কিংবদন্তি হওয়ার আগেই!
১৯৬০-এর রোম অলিম্পিক্স। গেমস ভিলেজে দেখা সেই ছেলেটার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে। পরবর্তী সময়ে দুনিয়া যাকে চিনবে মহম্মদ আলি নামে। রবিবার সেই মহম্মদ আলি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে শোনার পর ছাপ্পান্ন বছর আগের এক সন্ধ্যার কথা মনের ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরেফিরে আসছিল বার বার।
আমার সতীর্থদের মধ্যে আমি আর প্রদীপ (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) সব সময়েই মিশুকে। সুযোগ পেলেই অন্য দেশের ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে আলাপ করতাম গেমস ভিলেজে। আমাদের কোচ রহিম সাহেবও বলতেন বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের হাতের সামনে পাচ্ছ। ওদের থেকে ভালটা শিখে নাও।
সে বার অলিম্পিক্স ফুটবলে ২৬ অগস্ট ল’কিলায় আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে। তার ঠিক তিন দিন আগের ঘটনা। দুপুরে গেমস ভিলেজে লাঞ্চ সারছি। একটু পরেই সেখানে হইহই করতে করতে ঢুকে পড়ল মার্কিন অ্যাথলিটদের তিন-চার জনের একটা দল। ওদেরই একজন এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে বসে পড়ল। আমরা ফুটবলার শুনে নিজেই শুরু করল গল্প। এ কথা, সে কথার পর ওই অ্যাথলিট কিছুটা দূরে হাত দেখিয়ে বলল, ‘‘গেমস ভিলেজের মেয়রকে দেখবে। ওই যে।’’
চোখ ফিরিয়ে দেখি এক আফ্রো-আমেরিকান গাট্টাগোট্টা ক্রীড়াবিদ। একটু তফাতে তার কোচের সঙ্গে বসে কোনও গভীর আলোচনা করছে। তখন কি জানতাম কয়েক বছরের মধ্যে সে দিনের ওই ‘মেয়র’ কিংবদন্তি হয়ে উঠবে! খেলাধূলার জগৎ তাকে চিনবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট— মহম্মদ আলি’ বলে! জি়জ্ঞাসা করলাম মেয়র কেন? মার্কিন বন্ধুটি বলল, ‘‘যাকে দেখবে তার সঙ্গেই জুড়ে দেবে গল্প। চেনা-অচেনা সবার সঙ্গে। যেন এখানকার মেয়র। তাই আমরা ওকে এই নাম দিয়েছি।’’
কিন্তু ও কে? লাঞ্চ টেবলে আমাদের সেই মার্কিন বন্ধু তখন গড়গড় করে বলছে, ‘‘ওর নাম ক্যাসিয়াস ক্লে। খুব মজার ছেলে। প্লেনে উঠতে ভয় পায় বলে অলিম্পিক্সের ট্রায়ালেই যেতে চাইছিল না। রোমে আসার সময় প্লেনে উঠেছে হ্যান্ড ব্যাগেজে প্যারাসুট নিয়ে। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই পেশাদার বক্সিংয়ে দুনিয়া কাঁপাবে। এ বার আমাদের বক্সিং টিমের হয়ে সোনা জিতবেই ও। তোমরা চলে এসো এক দিন আলাপ করিয়ে দেব।’’
হাঙ্গেরি ম্যাচের আগের দিন ডাইনিং লাউ়ঞ্জে এ বার একদম কাছ থেকে দেখলাম মহম্মদ আলিকে। লাঞ্চ করছিল। দশ গজ দূরত্বে বসে। পেটানো পেশিবহুল শরীরটা যেন কষ্টিপাথরে ভাস্কর্যের মতো কেউ যত্ন নিয়ে তৈরি করেছে। চোখ দু’টো যেন যাবতীয় সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে।
হাঙ্গেরি ম্যাচটা হেরে গেলাম আমরা। পরদিন রহিম সাহেব কোনও প্র্যাকটিস রাখেননি। দিনটা ছিল ২৭ অগস্ট। তার পর দিন আমরা যাব গ্রসেটো। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলতে। সে দিন দুপুরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমেরিকার সেই বক্সার ক্যাসিয়াস ক্লে সন্ধেবেলা লাইট হেভিওয়েট বিভাগে লড়বেন চার বছর আগে মিডল ওয়েটে সোনাজয়ী রুশ বক্সার শাটকভের বিরুদ্ধে। প্রদীপ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম। গেমস ভিলেজ থেকে শাটল বাসে করে গেলাম বক্সিং এরিনায়। শুরু হল লড়াই। দেখলাম রিংয়ের মধ্যে ক্ষিপ্রতা আর শক্তির মিশেল কাকে বলে। রুশ বক্সার দাঁড়াতেই পারল না ক্যাসিয়াসের সামনে। বাউট শেষ। হাজির মার্কিন অ্যাথলিটরা পিলপিল করে ছুটল ওর দিকে। আমি আর প্রদীপও সে দিকে এগোনোর পথেই দেখি প্রথম দিন আলাপ হওয়া সেই মার্কিন অ্যাথলিট বন্ধু। ও-ই নিয়ে গেল ক্লে-র কাছে। হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে বুঝলাম রুশ বক্সারকে এতক্ষণ কী দুর্ভোগ-ই না পোহাতে হয়েছে। মনে আছে, সোনা জয়ের আগাম শুভেচ্ছা জানানোর পর ১৮ বছরের তরুণের মুখের সেই হাসি। এক সপ্তাহ পরেই সেই বহু কাঙ্খিত অলিম্পিক্স সোনার পদকের মালিক হয়ে গিয়েছিল ক্যাসিয়াস ক্লে।
সে দিন ফেরার তাড়া ছিল। তাই বেশি সময় থাকা হয়নি। সব মিলিয়ে মিনিট দু’য়েকের শুভেচ্ছা বিনিময়। কিন্তু সেটাই মনের সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো থাকবে চিরকাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy